শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

মেয়েদের পৈতৃক বাড়ি বণ্টনে আইনি বাঁধা বনাম বাস্তবতা

এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক | প্রকাশের সময় : ১৫ জুলাই, ২০২২, ১২:০৩ এএম

আমাদের সমাজে একটি ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত রয়েছে, বোনেরা বাবার পৈত্রিক ভিটার অংশ পায় না আবার বাপের বাড়ির সম্পত্তি ভাগ নিলে স্বামীর সংসারে অভাব অনটন নেমে আসে। আবার অনেকে বলে থাকেন ভাইদের সাথে বোনদের সম্পর্কের অবনতি এবং বোনেরা ভাইদের বাড়িতে এবং ছেলেমেয়েরা মামার বাড়িতে যাবার অধিকার বঞ্চিত হয়। ভাইয়েরা বোনকে ফাঁকি দিয়ে পৈতৃক সম্পত্তি ভাগাভাগি করে ভোগ-দখল করলে যদি অভিশপ্ত না হয়, সম্পর্ক অবনতি না হয়, তাহলে বোনদের অপরাধ কোথায়?

বোনদের প্রাপ্য সম্পত্তি ভাই ভোগদখল করবে, ফুফুর সম্পত্তি ভাইপো ভোগদখল করবে, তাতে অপরাধ হবে না, অথচ পিতামাতার সম্পত্তির বৈধ অংশ কন্যা ভোগদখল করলেই ‘অভিশপ্ত’ হবে। প্রকৃতপক্ষে মেয়েদের স্থায়ীভাবে ঠকানোর এগুলো একটি চতুর কৌশল ছাড়া আর কিছুই না। শুধু বোনের প্রাপ্ত অংশই নয়, যদি কোন বোন তার স্বামীর অব্যাহত অত্যাচারে ভাইয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেয়, তাহলে ভাই ভরণপোষণ দেবে। জোর করে বোনের ভরণ পোষণের ভয়ে উপযুক্ত সুরাহা ছাড়া ওই স্বামীর বাড়িতে পৌঁছে দেবেন না।

তবে কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে। একজন নারী বিবাহ পর্যন্ত পৈত্রিক ভিটার সহ-অংশীদার হিসেবে বিবেচ্য হবেন। কিন্তু বিবাহের স্বামীর বাড়িতে বসবাস কালে তিনি আগন্তুক হিসেবে বিবেচিত হবেন। তাই তিনি উক্ত পৈত্রিক ভিটায় অবস্থিত বসতগৃহ বা কুটিরের কোন একচ্ছত্র অংশ দাবী করতে পারেন না। এ কারণে বাটোয়ারা মামলায় স্বামী গৃহে বসবাসরত বিবাহিত কন্যা পিতৃগৃহ বা কুটিরের অংশ বিশেষ প্রাপ্তির বিষয়টি বিবেচিত হয় না। কারন উক্ত সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারী (পুত্র সন্তান) গণের মধ্যে বিবাদ বা বিরোধ বৃদ্ধি পাবে বলে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত রয়েছে। (১৩ ডি.এল.আর, ২৩০ পৃষ্ঠা)।

জমি বন্টন বা ভাগবাটোয়ারা সম্পর্কিত যে মামলা আদালতে করা হয় সেগুলো বিভাগ বন্টন মামলা বা বাটোয়ারা মামলা বা পারটিশান স্যুট বা বিভাগ মামলা নামে পরিচিত। পৈত্রিক সম্পত্তি ওয়ারিশদের মাঝে সমবন্টন না হলে কিংবা ফিতা বন্টন চিহ্নিত না হলে কিংবা জমির সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত বিরোধ হলে কিংবা সম্পত্তি অন্যান্য শরীকরা জোর করে দখলে রাখলে কিংবা প্রাপ্য অংশ কম দিলে কিংবা প্রাপ্য অংশ দিতে অস্বীকার করলে কিংবা অন্যান্য শরীকরা দাবীকৃত অংশ বন্টন অস্বীকার করলে সাধারণত এ মামলার উদ্ভব হয়।

মেয়ের বিবাহ হলে মেয়ে যদি স্বামীর বাড়িতে বসবাস করে, তাহলে বাটোয়ারা আইনের ৪ ধারা মতে পৈত্রিক বাড়ি বাটোয়ারা করতে পারবে না। কারণ, সে একই পরিবারভূক্ত নয়। (৩৪ ডিএলআর ২৪৫ পৃষ্ঠা)

একটি উদাহরণ দিলেই আজকের আলোচ্য বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। রহিমরা চার ভাই ও এক বোন। রহিমের বাবা মারা গেছেন। তাঁর মা বেঁচে আছেন। এখন রহিমরা চার ভাই মিলে বাবার সম্পত্তি নিজেদের নামে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিয়েছেন। ভাইয়েরা কিছুতেই বোনের বাবার সম্পত্তির অংশ দিতে চাচ্ছেন না। এখন বোন কি করবেন?

মুসলিম আইনে বাবা বা মা মারা গেলে মৃত ব্যক্তির যদি ছেলে এবং মেয়ে উভয়ই থাকে তাহলে রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে ছেলেরা যা পাবেন, মেয়ে বা মেয়েরা তার অর্ধেক পাবেন। অর্থাৎ ভাইয়েরা ইচ্ছা করলেই বোনদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে পারবেন না। এ ক্ষেত্রে বোনের বিয়ে হোক বা না হোক, সেটি বিবেচ্য নয়। বঞ্চিত বোনেরা বাঁটোয়ারা বা বণ্টনের মোকদ্দমা করতে পারেন। মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পত্তির ভাগ-বণ্টন নিয়ে উত্তরাধিকারীদের নিজেদের মধ্যে বনিবনা না হলে- বাঁটোয়ারা মামলা করে অধিকার ফিরে পাওয়া যায়। এই মোকদ্দমা চলাকালে কেউ মারা গেলে তাঁদের উত্তরাধিকারীরা অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন এবং অংশ চাইতে পারেন। অর্থাৎ শুধু বোনেরা নন, বোনেরা মারা যাওয়ার পর তাঁর উত্তরাধিকারীরাও এই মামলায় পক্ষ হতে পারেন।

তবে বিবেচিত বিষয় হচ্ছে এই যে, যেহেতু মেয়েদের ঠিকানা হয় শশুর বাড়ি তাই বাপের বাড়ির গৃহের অংশ তাদের ব্যবহার করার দরকার পড়েনা। এছাড়াও একটা পর্যায় বোনেরা বাপের বাড়ির জমি পেলেই জমি অন্যের কাছে বিক্রি করে চলে যায়। অন্যদিকে ছেলেদের বাপের গৃহই সম্বল। সামাজিক আর পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনায় পিতৃগৃহের ভিটে বাড়ির জমি ব্যতীত সমপরিমান জমি অন্য জায়গা থেকে দেয়া হয়। অর্থাৎ বোনের হক যাতে কোনো ভাবেই বিনষ্ট না হয় এমন জমি থেকে তার অংশ বুঝিয়ে দেওয়া। সেটাও যদি ভাইয়েরা বা ভাইপো’রা বুঝিয়ে দিতে অস্বীকার করে তাহলে রীতিরকম বাটোয়ারা মামলা করে অংশ বুঝিয়ে নেয়া সম্ভব।

এ মামলা করতে হলে কিন্তু সম্পত্তির মালিকানা সংশ্লিষ্ট সব কাগজপত্র যেমন ভূমি জরিপ খতিয়ান, নামজারি খতিয়ান, মালিকানা দলিল, উত্তরাধিকার সনদ ইত্যাদির প্রয়োজন হয়। কারণ নালিশী আর্জিতে সম্পত্তির মালিকানা অর্জনের বিবরণ যেমন খরিদ, দানসূত্রে কিংবা ওয়ারেশ সূত্রে কিনা, উত্তরাধিকার সূত্রে কি-না, যৌথ মালিকানার মাধ্যমে কি-না, দখলের প্রেক্ষিতে স্বত্ব অর্জন কি-না, বন্ধক বা অন্য কোনভাবে স্বত্ব অর্জন কি-না ইত্যাদি বিষয়সমূহ ধারাবাহিকভাবে উল্লেখ করতে হয়।

বাটোয়ারা মামলা করার পূর্বে নিশ্চিত হতে হবে যে, সম্পত্তি আগে উইল বা হেবা করা হয়েছে কিনা। যদি হয়ে থাকে তাহলে উইলের ক্ষেত্রে ১/৩ অংশ বাদ দিয়ে কিংবা হেবা করা হলে হেবার দলিলে যে পরিমাণ মালিকানা আছে সেটা বাদ দিয়ে অন্য সহ শরীকের অংশ বের করতে হবে। এ মামলায় দু’বার ডিক্রি হয়।

প্রাথমিক ডিক্রির পর বণ্টন না করা হলে আদালত এ্যাডভোকেট কমিশনার নিয়োগ করে অংশ নির্ধারণ করে দেন এবং চূড়ান্ত ডিক্রি প্রদান করেন। মামলা চলাকালীন আদালতের মাধ্যমে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ রয়েছে। বণ্টন ডিক্রি পাওয়ার পরও দখল না পেলে কিংবা পক্ষগণ দখল বুঝিয়ে না দিলে কিংবা হিস্যা বুঝিয়ে না দিলে ‘উচ্ছেদের মামলা’ করা যেতে পারে, স্বত্ব দখলের মামলা করা যেতে পারে।

এজমালি ও বিভাগযোগ্য সম্পত্তি যে এলাকায় অবস্থিত, সে এলাকার উপযুক্ত আদালতে এ মামলা দাখিল করতে হয়। দেওয়ানী কার্যবিধি আইনের ১৬ ধারা অনুযায়ী, নিম্নতম এখতিয়ার সম্পন্ন আদালতে এ জাতীয় মামলা দাখিল করতে হয়। তবে সম্পত্তির মালিক যিনি তার সম্পত্তি দুটি মৌজায় স্থিত হলে, তিনি দেওয়ানী কার্যবিধি আইনের ১৭ বিধি অনুযায়ী যে কোন প্রকার মৌজায় এখতিয়ার সম্পন্ন আদালতে মামলাটি দাখিল করা যায়। যেক্ষেত্রে স্থানীয় অধিক্ষেত্র মূল্যায়ন নির্দিষ্ট না হয়, সেই ক্ষেত্রে দেওয়ানী কার্যবিধি আইনের ১৮ বিধি অনুযায়ী যেকোন আদালতে মোকদ্দমাটি দাখিল করা যাবে। কোর্ট ফি আইনের বিধান অনুযায়ী ৩০০ টাকা কোর্ট ফিস দিয়ে এ মোকদ্দমা করতে হয়।

লেখকঃ আইনের শিক্ষক, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও আইনগ্রন্থ প্রণেতা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
মোহাম্মদ নেসার উদ্দিন ২০ নভেম্বর, ২০২২, ৭:৪৩ এএম says : 0
২-৩ বছরের মধ্যে বাটোয়ারা মামলা চূড়ান্ত করতে হলে কি করতে হবে
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন