মানুষ সামাজিক জীব। জীব মাত্রেরই খাদ্যের চাহিদা রয়েছে। খাদ্য ছাড়া কোনো জীব বা প্রাণী বাঁচতে পারে না। এজন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একান্ত আবশ্যক। মানুষের মৌলিক চাহিদার (খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য) মধ্যে খাদ্য একটি প্রধান ও অন্যতম মৌলিক চাহিদা। জীবন ধারণের জন্য খাদ্যের কোনো বিকল্প নেই। সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রতিটি মানুষের প্রয়োজন বিশুদ্ধ ও পুষ্টিকর খাদ্য। আর এ বিশুদ্ধ খাদ্য সুস্থ ও সমৃদ্ধশালী জাতি গঠনে একান্ত অপরিহার্য। কিন্তু আমাদের দেশে বিশুদ্ধ খাবার প্রাপ্তি কঠিন করে ফেলেছে কিছু বিবেকহীন ব্যবসায়ী ও আড়তদার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও এদের নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খাচ্ছে।
খাদ্যে ভেজাল থেকে মানুষ মুক্তি চায়- এমন একটি প্রতিবেদন সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে ছাপা পড়েছি। শুধু এই রিপোর্টই নয় খাদ্যে ভেজালের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন নেই, এমন একটি পত্রিকা খুঁজে পাওয়া দুস্কর। নির্ভেজাল খাদ্য গ্রহণ মানুষের মৌলিক অধিকার। এই অধিকারকে গলা টিপে হত্যা করছে কিছু সংখ্যক মানুষরূপি দানব। এই দুষ্ট চরিত্রের লোকদের হাত থেকে জাতীকে মুক্ত করা এখন সময়ের দাবি। শুধু ভেজাল দিয়ে ক্ষান্ত হচ্ছেন না এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী, এবার নকল দুধ উৎপাদন ও বাজারজাত করছেন তারা। এ দুধ সংগ্রহে কোনো গাভীর প্রয়োজন পড়ে না, কষ্ট করে গড়ে তুলতে হয় না গবাদি পশুর খামারও। ছানার পানির সঙ্গে কেমিক্যাল মিশিয়ে সহজেই তৈরি করা হচ্ছে এমন ‘বিষ’। পরে ‘খাঁটি দুধ’ হিসেবে তা চালান হয়ে আসছে রাজধানীতে। দীর্ঘ সময় সতেজ রাখতে এতে মেশানো হচ্ছে ফরমালিন। জানা গেছে, পানি গরম করে তাতে অ্যারারুট মিশিয়ে সহজেই নকল দুধ তৈরী করা যায়। তবে প্রয়োজন পড়ে আরও কয়েক পদের রাসায়নিক পাউডারের। যা পানিতে মিশিয়ে একেবারে সাদা দুধের আকার ধারণ করে। খালি চোখে তা ধরা অসম্ভব। এর শিকার হচ্ছেন পূর্ণ বয়স্ক থেকে শিশু।
চিকিৎসকরা বলছেন, কৃত্রিম উপায়ে তৈরি নকল দুধ পানে পেটের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এর প্রভাব পরতে পারে কিডনি বা লিভারের মতো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেও। নকল দুধ তৈরির কারখানাগুলোতে ছানার ফেলনা পানি, খাবার পানি, থাইসোডা, পার অক্সাইড, ময়দা, ভাতের মাড় ও চিনি মিশিয়ে আগুনে ফোটানো হয় এবং পরে কাটিং অয়েল ও এসেন্স মিশিয়ে দুধের সুবাস দেয়া হয়। ধলেশ^রী ঘাট থেকে নকল দুধের চালান পাঠানো হয় দুটি নামিদামি ডেইরি প্রজেক্টে। পরে ওই প্রজেক্টের প্লাস্টিক মোড়কে প্যাকেটজাত দুধ হিসেবে বাজারে বাজারে পৌঁছে যায়। আইসিডিডিআরবি হাসপাতালের ডা. এস কে রায় জানান, রাসায়নিক মিশ্রিত নকল দুধ পানের কারণে মানবদেহে ডায়রিয়া, জটিল পেটের পীড়া, কিডনি ও লিভার রোগে আক্রান্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। শিশুদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি আরো মারাত্নক। বাজারে চলামান একমাত্র হোমমেড রসগোল্লা নামের পণ্যটি আগাগোড়াই ভেজাল প্রমাণিত হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বিশুদ্ধ খাবার আদালতে মামলা রজু করা হয়েছে। আমাদের দেশে সম্প্রতি জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট আটটি ব্র্যান্ডের প্যাকেটজাত তরল দুধের নমুনা পরিক্ষা করে জেনেছে যে, শতভাগ প্যাজেটজাত তরল দুধেই অত্যধিক মাত্রায় টেট্রাসাইক্লিন নামের অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি রয়েছে, যা গর্ভবতী মায়েদের জন্য খুবই বিপজ্জনক। এতে জন্মগত ক্রটি নিয়ে শিশুর জন্ম হতে পারে।
জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ‘ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির পরিক্ষায় আরো দেখা গেছে, দুধে ন্যূনতম যেটুকু ফ্যাট থাকা প্রয়োজন, অধিকাংশ প্যাকেটজাত তরল দুধে তাও থাকে না। ধারণা করা হচ্ছে, প্যাকেট করার আগেই দুধ থেকে ফ্যাট বা ননি তুলে নিয়ে অন্য খাবারে ব্যবহার করা হয়। এই দুধ কোনোভাবেই বাড়ন্ত শিশুদের শারীরিক প্রয়োজন মেটাতে পারবে না। অথচ দেশে এসব দেখার বা নিয়ন্ত্রণ করার কার্যত কোনো উদ্যোগই নেই। এমনিতেই দেশের মানুষ খাদ্যে ভেজাল বা নিম্নমানের খাদ্য সামগ্রী নিয়ে খুবই উদ্ধিগ্ন। এখন মা ও শিশুদের স্বাস্থ্য নিয়েও যদি এমন শংকা তৈরি হয়, তাহলে মানুষ যাবে কোথায়? খাদ্য অনিরাপদ হলে জনস্বাস্থ্যের ওপর তার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন গবেষণায়ও তেমন প্রমাণ উঠে এসেছে। ক্যান্সার, লিভার, ফুসফুস, কিডনির রোগসহ খাদ্য সংশ্লিষ্ট অন্যান্য রোগে অস্বাভাবিক হারে মেশানোকেই সর্বাধিক পরিমাণে দায়ী করছেন।
শুধু তাই নয়, মানুষ রোগাক্রান্ত হলে যে ওষুধ খেয়ে রোগ মুক্তির চেষ্টা করবে, তাও ভেজাল বা নিম্নমানের হয়ে পড়েছে বলে বিস্তর অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এ অবস্থায় দেশের জনস্বাস্থ্য যে ভয়ংকর হুমকির মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সরকার ও নীতি নির্ধারকদের বিষয়টি নিয়ে অতি জরুরি ভিত্তিতে ভাবতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। সম্প্রতি চীনে দুধে ভেজাল করার অপরাধে বেশ কয়েকজনকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফুড এন্ড ড্রাগস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অত্যন্ত কঠোরভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। ভেজাল তো দূরের কথা, খাদ্য সমগ্রী নির্ধারিত মানসম্পন্ন না হলে বাজারে বিক্রি করতে দেয়া হয় না। পৃথিবীর প্রায় সবদেশেই জনস্বাস্থ্যকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বাংলাদেশে এ ক্ষেত্রে নৈরাজ্যকর অবস্থা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আশা করি, জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে সরকার এ বিষয়ে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
মাও: লোকমান হেকিম
চিকিৎসক- কলামিস্ট।
মোবা: ০১৭১৬-২৭০১২০।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন