মাড়ি রোগের সাথে হার্টের রোগের যেমন সম্পর্ক রয়েছে তেমনি ডায়াবেটিসের সাথে পেরিওডন্টাল রোগের সম্পর্ক রয়েছে। ডায়াবেটিসের কারণে অথবা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে না রাখলে পেরিওডন্টাল রোগ বা মাড়ি রোগ অবশ্যই দেখা দিবে। কিন্তু পেরিওডন্টাল রোগের কারণে ডায়াবেটিস হয়েছে এমন কোনো তথ্য আজ পর্যন্ত কোথাও পাওয়া যায়নি। কিন্তু ডায়াবেটিসের সাথে মাড়ি রোগের একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে যা সর্ব সাধারণের জানা প্রয়োজন। আপনার যদি অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থাকে তাহলে অবশ্যই মাড়ির রোগ দেখা দিবে। আর পেরিওডন্টাল রোগ বা মাড়ির রোগ থাকলে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স হবে যার কারণে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রন করা কঠিন হবে। ফলে জনগনকে এসব বিষয়ে সচেতন হতে হবে।
ডায়াবেটিস একটি মেটাবলিক ডিজিজ। আমরা যে কার্বোহাইড্রেড বা সুগার জাতীয় খাবার খাই তা মেটাবলিজমের জন্য ইনসুলিন হরমোনের প্রয়োজন। ইনসুলিন হরমোন নিঃসৃত হয় অগ্ন্যাশয় থেকে। অগ্ন্যাশয়ের বিটা সেল ইনসুলিন নামক হরমোন নিঃসরন করে থাকে। যদি কোনো কারণে দেখা যায় অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন মোটেই বের হচ্ছে না তখন রক্তে সুগারের পরিমান বৃদ্ধি পেয়ে যে ধরনের ডায়াবেটিস হবে তা টাইপ-১ ডায়াবেটিস নামে পরিচিত। শিশু-কিশোররাও টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। আবার যখন দেখা যায় অগ্ন্যাশয় থেকে পর্যাপ্ত পরিমানে ইনসুলিন হরমোন নিঃসরন হচ্ছে। হরমোনের কোনো অভাব নেই। কিন্তু শরীর সেই ইনসুলিন হরমোনকে কাজে লাগাতে পারছে না। অর্থাৎ ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স হয়ে গেছে। তখন রক্তে সুগারের পরিমান বৃদ্ধি পেয়ে যে ধরনের ডায়াবেটিস দেখা যায় তা টাইপ-২ ডায়াবেটিস নামে পরিচিত। টাইপ-২ ডায়াবেটিস সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এছাড়া গর্ভকালীন অবস্থায় মেয়েদের ডায়াবেটিস পরিলক্ষিত হয় যা গ্যাসটেশনাল ডায়াবেটিস নামে পরিচিত। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস সাধারনত ডেলিভারীর পর এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে ডেলিভারীর পরেও ডায়াবেটিস থেকে যেতে পারে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে না রাখলে পেরিওডন্টাল বা মাড়ির রোগ দেখা দিবে। মাড়ি রোগে মুখে দুর্গন্ধ, মাড়ি থেকে রক্ত পড়া, নড়া দাঁত, মাড়ি লাল হয়ে যাওয়া, মাড়ির প্রদাহ এবং পেরিওডন্টাল পকেট ইত্যাদি দেখা যায়। আপনার যখন ডায়াবেটিস হয় তখন আপনার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যেতে থাকে। এই সুযোগে মাড়ি রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া মাড়িতে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করে থাকে। তাই আপনার মাড়ির রোগ থাকলে অবশ্যই তার চিকিৎসা করে নিতে হবে। মাড়ির রোগের চিকিৎসা করে নিলে একদিকে যেমন আপনার মাড়ির স্বাস্থ্য ভালো থাকবে আর অন্য দিকে রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রন করা সহজ হয়ে যাবে। একইভাবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে রাখলে আপনার মাড়ির রোগের সম্ভাবনা অনেক কমে যাবে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে রাখার কোনো বিকল্প নেই। আমরা সবাই চাই আমাদের দাঁত ও মাড়ি ভালো থাকুক। মাড়ি রোগ অবশ্যই প্রতিরোধ করা যায়। যখন ডায়াবেটিস বাড়ে তখন মাড়ির রোগ বৃদ্ধি পায়। আবার মাড়ির রোগ বৃদ্ধি পেলে গ্লাইসেমিক কন্ট্রোল ঠিকভাবে হয় না। গ্লাইসেমিক কন্ট্রোল ঠিকভাবে না হলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে রাখা কষ্টসাধ্য হয়ে দাড়ায়। ফলে দেখা যাচ্ছে পেরিওডন্টাল রোগের সাথে মাড়ি রোগের একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।
টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে যেমন-মাড়ি রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায় তেমনি টাইপ-১ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রেও শিশুরা একই ধরনের সমস্যা নিয়ে ডাক্তারের নিকট উপস্থিত হতে পারে। ডায়াবেটিসের কারণে যেহেতু লালা নিঃসরন কমে যায় তাই শুস্ক মুখের সৃষ্টি হয়। শুস্ক মুখের কারণে খাদ্য কণা ঠিকভাবে অপসারিত না হওয়ায় দন্তক্ষয় সৃষ্টি হবে। তাছাড়া মাড়ির স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে আর পকেট থাকলে মাড়ি থেকে কিছু খারাপ ব্যাকটেরিয়া রক্তের মাধ্যমে হার্টের সমস্যা সৃষ্টি করে থাকে। আমাদের দেশে অনেক সময় রোগী মাড়ির বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে ডাক্তারের কাছে আসেন। রোগী আগে থেকে জানেনই না যে তার ডায়াবেটিস রয়েছে। মাড়ির সংক্রমন অনেক বেশি হলে রক্তের সুগার লেভেল পরীক্ষা করে দেখা যায় যে, রোগীর রক্তে সুগার অনেক বেশি। এছাড়া মাড়িতে প্রদাহ দেখা দিলে সি রিয়াক্টিভ প্রোটিনের পরিমান বেশি থাকে। এভাবে দেখা যায় মাড়ির চিকিৎসা করতে এসে অনেকেই জানতে পারেন যে, তার ডায়াবেটিস আছে। তাই মাড়ির রোগকে কখনও অবহেলা করবেন না। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থাকলে ধীরে ধীরে আপনার দাঁত নড়ে যাবে। এমনকি দাঁত পড়ে যেতে পারে। ডায়াবেটিসের কারণে রক্তনালীর এথেরোস্কেলেরোসিস হয়ে রক্তনালী সরু হয়ে যায়। ফলে রক্তচাপ বৃদ্ধি পেতে পারে। ডায়াবেটিস আছে এমন অনেক রোগী উচ্চ রক্তচাপের জন্য ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার ড্রাগ সেবন করেন যেমন এমলোডিপিন ও নিফিডিপিন। এর ফলে কিছু ক্ষেত্রে মাড়ির অতি বৃদ্ধি ঘটে থাকে।
ডায়াবেটিস হলে মাড়ির রক্তনালীগুলো পুরূ হয়ে যায়। ফলে রক্তনালীর অভ্যন্তরভাগ সরু হয়ে যায়। ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার অন্যতম উপাদান শে^ত রক্তকণিকা ঠিকভাবে রোগ সৃষ্টি ব্যাকটেরিয়ার সাথে পূর্ণ মাত্রায় যুদ্ধ করতে পারে না। শরীরের যে কোনো প্রদাহে কিছু কেমিক্যাল মেডিয়েটর নিঃসৃত হয়। পেরিওডন্টাইটিস অথবা মাড়ির প্রদাহে এমন কিছু কেমিক্যাল মেডিয়েটর নিঃসৃত হয়ে থাকে। এরা সাইটোকাইন নামে পরিচিত। সাইটোকাইনগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ইন্টারলিউকিন ১, ইন্টারলিউকিন ৬ এবং টিএনএফ আলফা। এছাড়া রক্তে সি রিয়াক্টিভ প্রোটিনের পরিমান বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। মাড়ির প্রদাহে এসব কেমিক্যাল মেডিয়েটরসের কারণে ডায়াবেটিস রোগীর গ্লাইসেমিক কন্ট্রোল ঠিকভাবে হয় না। গ্লাইসেমিক কন্ট্রোল ঠিকভাবে না হলে রক্তের সুগার কমানো সম্ভব হয় না। তাই দেখা যাচ্ছে মাড়ি রোগ থাকলে আপনার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে রাখার ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হবে। একারণেই ডায়াবেটিস এবং পেরিওডন্টাল রোগের একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে যা সাধারন জনগনের অবশ্যই জানা উচিত।
ডায়াবেটিস রোগীদের হঠাৎ করে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে। রোগী দাঁত ও মাড়ির চিকিৎসা করতে এসে মাথা ঘুরে যেতে পারে। পড়ে যেতে পারে। অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। এমনকি ডায়াবেটিক কমা পর্যন্ত হতে পারে। তাই ডায়াবেটিস রোগীদের মাড়ির চিকিৎসা সকাল বেলা করা সবচেয়ে ভালো। কারণ সকাল বেলা খাবার গ্রহণ করে ঔষধ খেয়ে আসলে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। তবে রোগীকে চিকিৎসার জন্য বেশিক্ষন বসিয়ে রাখা যাবে না। ডায়াবেটিস রোগীর চিকিৎসা করার আগে ব্লাড সুগারের পাশাপাশি রক্তের এইচ.বি.এ.ওয়ান.সি বা হিমোগ্লোবিন সি পরীক্ষা করে নিলে ভালো হয়। এই টেস্টের মাধ্যমে বুঝা যায় একজন ডায়াবেটিস রোগীর ডায়াবেটিস কতটুকু নিয়ন্ত্রনে আছে। বছরে কমপক্ষে দুই বার এই টেস্ট করা উচিত। ডায়াবেটিসের কারণে মাড়ি রোগ দেখা দিলে অথবা মাড়ি রোগ প্রতিরোধে নিয়মিত ব্রাশ করতে হবে। শক্ত টুথব্রাশ ব্যবহার করা যাবে না। শক্ত টুথব্রাশ ব্যবহার করলে মাড়ি ও দাঁতের ক্ষতি হতে পারে। দুই থেকে তিন মাস পরপর টুথব্রাশ পরিবর্তন করে ব্যবহার করা উচিত। ধুমপান পরিহার করতে হবে। ধুমপানের অভ্যাস থাকলে মাড়ি রোগ বৃদ্ধি পাবে। সবুজ শাকসবজি এবং ফলমুল খেতে হবে। ছয় মাস পরপর ডাক্তার দেখাতে হবে। প্রয়োজন অনুযায়ী দাঁতের স্কেলিং অথবা রুট প্ল্যানিং করিয়ে নিতে হবে।
মাড়ির রোগের সাথে যেমন ডায়াবেটিসের সম্পর্ক রয়েছে তেমনি মাড়ির রোগের সাথে হার্টের কিছু রোগের রয়েছে। তাছাড়া গর্ভবতী মায়ের মাড়ির চিকিৎসা ঠিকভাবে না করলে আগত সন্তানের ওজন কম হতে পারে। এছাড়াও বিভিন্ন জটিলতা নিয়ে শিশু জন্মগ্রহণ করতে পারে। শুধু তাই নয় মাড়ির রোগ থাকার কারণে অনাকাঙ্খিত এবরশন হতে পারে। শিশু স্বাভাবিক সময়ের আগে জন্মগ্রহণ করলে ফুসফুসের সমস্যা থাকতে পারে। শিশুর শ^াস নিতে কষ্ট হতে পারে। শিশুর নিওন্যাটাল জন্ডিস হতে পারে। শিশুর শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা বজায় রাখা কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়ায় যেহেতু শিশুর মস্তিস্কের হাইপোথ্যালামাসের গঠন ঠিকভাবে হয় না। এসব শিশু বড় হলেও পরবর্তীতে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে। শুধুমাত্র গর্ভবতী মায়ের দাঁতের স্কেলিং ঠিকভাবে করিয়ে নিলে গর্ভকালীন জটিলতা অনেক কমে যাবে এমনকি থাকবে না।
ডাঃ মোঃ ফারুক হোসেন
ইমপ্রেস ওরাল কেয়ার
বর্ণমালা সড়ক, ইব্রাহিমপুর, ঢাকা।
মোবাইল ঃ ০১৮১৭৫২১৮৯৭
ই-মেইল ঃ ফৎ.ভধৎঁয়ঁ@মসধরষ.পড়স
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন