পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে এদেশের সামর্থ্যবান মুলনমানরা পশু কোরবানি দিয়ে থাকে। কোরবানিতে সাধারণত গরু, ছাগল, মহিষ এবং ভেড়া জবাই করা হয়ে থাকে। সরকারের মৎস্য ও প্রাণী স¤পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, এ বছর কোরবানিতে ৯৯ লক্ষ ৫০ হাজার ৭৬৩টি পশু জবাই করা হয়। অর্থাৎ প্রায় এক কোটি পশু জবাই হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই বিক্রিযোগ্য পশুর চামড়ার সংখ্যা প্রায় এক কোটি এবং ঈদুল আজহাই হচ্ছে এই চামড়া কালেকশানের প্রধান সময়। এ সময়ে সংগৃহীত চামড়াই প্রক্রিয়াজাত করে সারা বছর ব্যবহার করা হয়। যারা পশু কোরবানি দেন, তারাই হচ্ছেন পশুর চামড়ার প্রথম যোগানদাতা। এসব ব্যক্তিদের ঘরে ঘরে গিয়ে এলাকার কিছু ব্যবসায়ী পশুর চামড়া ক্রয় করে থাকে। তাদের কাছ থেকে আরেক পক্ষ এসব চামড়া ক্রয় করে এবং আড়তদারদের কাছে বিক্রি করে। আড়তদাররা প্রাথমিকভাবে এইসব কাঁচা চামড়া লবণ এবং প্রয়োজনীয় কেমিক্যাল দিয়ে সংরক্ষণ করে। ট্যানারি মালিকরা আড়তদারদের কাছ থেকে এসব চামড়া কিনে থাকে। সাধারণত চামড়ার উৎসস্থল থেকে ট্যানারিতে পৌঁছা পর্যন্ত যত বার হাত বদল হয়, ততবারই দাম বাড়ে। মধ্যস্বত্ত্বভোগী যত, ততবার এই চামড়া বিক্রি হয়। আর এই মধ্যস্বত্ত্বভোগীরাই মূলত চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করে থাকে। অন্যান্য পণ্যের মতো এই চামড়া দাম কম বলে বিক্রি না করে উপায় থাকে না এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বিক্রি করতে হয়। কারণ, এই চামড়া নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করতে হয়। আর আমজনতা যারা পশু কোরবানি দিয়ে থাকেন, তাদের পক্ষে একটি বা দুটি পশুর চামড়া সংরক্ষণ করা সম্ভব হয় না। আবার চামড়া অতিদ্রুত পরিষ্কার করে লবণ এবং অন্যান্য কেমিক্যাল দিয়ে সংরক্ষণ না করলে এর কোয়ালিটি নষ্ট হয়ে যায় এবং পচন শুরু হয়। এছাড়া এইসব চামড়া থেকে মারাত্মক দুর্গন্ধ বের হয়, যা বসবাসের পরিবেশকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে যারা পশু জবাই করেন, তাদের অতি দ্রুত এই চামড়া বিক্রি করে দিতে হয়। এ অবস্থায় পশু কোরবানি দেয়া ব্যক্তিদের পক্ষে চামড়া বিক্রির জন্য দরকষাকষি এবং অপেক্ষার সুযোগ থাকে না। আর এই সুযোগটাই মধ্যস্বত্বভোগীরা কাজে লাগায় এবং তারা তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী দাম নির্ধারণ করে। এই সব মধ্যস্বত্ত্বভোগী সবাই একত্রিত হয়ে সিন্ডিকেট করে কারসাজির মাধ্যমে কাঁচা চামড়ার বাজার মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে। এ কারণেই উৎসস্থলে চামড়ার মূল্য আশাব্যাঞ্জক হয় না, যা খুবই দুঃখজনক।
বিগত কয়েক বছর থেকে সরকার কোরবানির পশুর চামড়ার একটা মূল্য নির্ধারণ করে থাকে এবং এবারো করেছে। বর্গফুট হিসাবে সে মূল্য নির্ধারিত হয়। এবছর সরকার কর্তৃক প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়ার নির্ধারিত মূল্য হচ্ছে ঢাকা শহরে ৪৭-৫২ টাকা আর ঢাকার বাইরে ৪০-৪৪ টাকা। আর প্রতি বর্গফুট খাসির চামড়ার মূল্য হচ্ছে ১৮-২০ টাকা আর বকরির চামড়ার মূল্য ১২-১৪ টাকা। সরকার কর্তৃক বর্গফুট প্রতি চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করে দেয়ায় ওপেন মার্কেটে চামড়ার মূল্য নির্ধারণের সুযোগটা কমে যায়। আবার পুরাপুরি আয়তকার বা বর্গাকার না হবার কারণে চামড়ার প্রকৃত সাইজ নির্ধারণ করা আমজনতার পক্ষে সম্ভব হয় না, যার কারণে চামড়ার মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতাটা ক্রেতার হাতে চলে যায়। এবার আকার অনুসারে গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে অনেক কমে। বাজারে বিদ্যমান অধিকাংশ পণ্যের দাম ওপেন মার্কেটে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নির্ধারিত হলেও, কোরবানির পশুর চামড়ার দাম বর্গফুট হিসাবে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত। অথচ যে পশুটি জবাই করা হয়েছে তার মূল্য প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই নির্ধারিত হয়েছে। সাত/আট বছর আগেও চামড়া কেনার জন্য একাধিক ব্যবসায়ী গ্রুপ, যারা কোরবানির জন্য পশু কিনেছে তাদের বাড়ি আসত এবং পশুর আকৃতি, রঙ এবং চামড়ার কোয়ালিটি দেখে চামড়া কেনার জন্য আগ্রহ দেখাত। এমনকি অনেক সময় পশু জবাইয়ের আগেই চামড়া বিক্রি হয়ে যেত এবং অনেক সময় ব্যবসায়ীরা চামড়ার মূল্য অগ্রিম পরিশোধ করে যেত অথবা বুকিং মানি প্রদান করত। কিন্তু সেই দৃশ্য এখন আর নেই। এখন পশু জবাইয়ের পর কয়েক ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও চামড়া ক্রয়ের জন্য ক্রেতা আসে না।
সামর্থ্যবান মুসলমানরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু কোরবানি দিয়ে থাকেন। জবাইকৃত পশুর মাংসের তিন ভাগের একভাগ গরীব, ফকির এবং মিসকিনদের জন্য, এক ভাগ গরীব আত্মীয়-স্বজনদের জন্য এবং বাকি একভাগ নিজের জন্য। একইভাবে কোরবানি দেয়া পশুর চামড়ার বিক্রয় লব্ধ অর্থ গরীব, ফকির, মিসকিন এবং অসহায় দুস্থ মানুষের মাঝে বণ্টন করতে হবে। কখনো এই অর্থ যে ব্যক্তি পশু কোরবানি দিয়েছে সেই ব্যক্তি ভোগ করতে পারবে না। স্বাভাবিকভাবেই পশু কোরবানি দেয়া ব্যক্তিটি যথাযথ মূল্যে কোরবানি দেয়া পশুর চামড়া বিক্রয় করতে না পারার কারণে তিনি অপেক্ষাকৃত কম টাকা পেল। আর এই টাকা যেহেতু গরীব এবং অসহায় মানুষেরা পেত, সেহেতু এক্ষেত্রে এসব অসহায় মানুষেরা বঞ্চিত হলো। সুতরাং কোরবানির পশুর চামড়ার মূল্য কমে যাবার কারণে দেশের গরীব মানুষেরাই বঞ্চিত হলো এবং তারাই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো। সামর্থ্যবান মুসলমানরা, যারা পশু কোরবানি দিয়েছেন, চামড়া মূল্য কম বা বেশি হবার কারণে তাদের আর্থিক কোনো পরিবর্তন হয়নি। চামড়ার মূল্যটা যেহেতু সমাজের অসহায় মানুষদেরই প্রাপ্য, সুতরাং চামড়ার মূল্যের সাথে তাদের ভাগ্যেই জড়িত। তাই চামড়ার মূল্য ন্যায়ানুগ হওয়া উচিত।
পশুর শরীর থেকে চামড়া আলাদা করার পর সাধারণত এটিকে পরিষ্কার করে ৬/৭ ঘণ্টার মধ্যে লবণ এবং কেমিক্যাল দিয়ে সংরক্ষণ করতে হয়। তা না হলে সেই চামড়া নষ্ট হতে শুরু হয়। এজন্য চামড়াটির মালিক তাড়াতাড়ি কাঁচা চামড়া বিক্রির জন্য বাধ্য হয়। একইভাবে মৌসুমি চামড়া ক্রেতারা সেই চামড়া আড়তদারের কাছে বিক্রির জন্য তাড়াহুড়া করে। কারণ, আমাদের দেশে এখনো আড়তদারেরাই কেবল কাঁচা চামড়া লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করে। সুতরাং আড়তদারের হাতেই চামড়ার বাজারের নিয়ন্ত্রণ। আড়তদারেরা সেই চামড়া সংরক্ষণ করে এবং পরবর্তীতে সেই চামড়া বাজারের চাহিদা অনুযায়ী বিক্রি করে। ফলে তাদের লোকসান হয় না। কিন্তু কোরবানির দিন প্রায় এক কোটি চামড়া ৬/৭ ঘণ্টার মধ্যে ক্রয় বিক্রয় করতে হয় বিধায় চামড়ার মূল্য ওই দিন বেশ কমে যায়। আর যোগান বেশি হলে চাহিদা এবং দাম কমে যাওয়াটাতো অর্থনীতির মূলনীতি। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য একদিনে সব চামড়া বিক্রি না করে পর্যায়ক্রমে বিক্রির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ জন্য গ্রামে গ্রামে চামড়া সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া যায়। একটি গ্রাম বা এলাকার চামড়া যদি একত্র করে লবণ এবং প্রয়োজনীয় কেমিক্যাল দিয়ে সংরক্ষণ করা যায়, তাহলে চামড়া নিয়ে লংকাকান্ড বন্ধ হবে এবং চামড়ার ভালো দামও পাওয়া যাবে।
লেখক: প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক।
omar_ctg123@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন