প্রবাসীরা অনেকেই দেশে এসে নিগৃহীত হচ্ছেন, হয়রানির শিকার হচ্ছেন। হামলা, মামলা ও অনিরাপত্তার সম্মুখীন হচ্ছেন। এ বাস্তবতাকে দুঃখজনক বললেও কম বলা হয়। প্রবাসী শ্রমিক-কর্মীদের আমরা ‘রেমিট্যান্স যোদ্ধা’ বলে অবিহিত করি। বিদেশে-বিভূয়ে থেকে তারা তাদের উপার্জিত অর্থ দেশে পাঠাচ্ছেন। দেশ তার সুফল লাভ করছে। ইনকিলাবে প্রকাশিত খবর মতে, প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রমিক বা কর্মী হিসেবে কাজ করছেন। তারা প্রতি বছর দেড় হাজার কোটি ডলারেরও বেশি রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। আমাদের জাতীয় অর্থনীতির প্রধান দুটি স্তম্ভের মধ্যে রেমিট্যান্স একটি। আপরটি হলো রফতানি আয়, যার ৮০ শতাংশই তৈরি পোশাক শিল্পের অবদান। প্রবাসী আয় ও রফতানি আয় যদি এভাবে না আসতো তবে দেশ ও দেশের অর্থনীতির হাল কী হতো, তা বিশদ ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। রেমিট্যান্স যোদ্ধারা, যাদের কাছে আমাদের অশেষ ঋণ, দেশে এলে বিশেষ গুরুত্ব পাবেন না, যথাযথ সম্মান পাবেন না, উল্টো নিগৃহীত হবেন, অপমানিত হবেন, সহায়-সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবেন, এমনকি জীবন সংশয়ে পতিত হবেন, এসব কীভাবে মেনে নেয়া যায়? ইনকিলাবের খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের মাটিতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে তারা বহুমাত্রিক নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। তাদের সম্পত্তি আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের দ্বারা বেহাত হয়ে যাচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হচ্ছে মিথ্যা মামলা। এ ছাড়া দেশে অবস্থানকালে তারা অন্তত ৭ ধরনের সংকট ও হয়রানি- পেরেশানির মুখে পড়ছেন। এর মধ্যে পাসপোর্ট অফিসের দুর্নীতি-অনিয়ম, মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট পেতে ভোগান্তি, ইমিগ্রেশন, কাস্টমস ও বিমানযাত্রায় দুর্ভোগ ইত্যাদি যেমন আছে, তেমনি আছে জমি-জমা সংক্রান্ত বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি, ভোগান্তি ও হয়রানি।
প্রবাসীরা যখন বিমানবন্দরে এসে নামেন তখনই তাদের দুর্ভোগের শুরু। বিমানবন্দরে তারা কোনো বিশেষ সুবিধা পান না। ইমিগ্রেশন, কাস্টমস থেকে শুরু করে সবাই তাদের অবহেলা-অবজ্ঞার চোখে দেখে, নানাভাবে তাদের বিলম্বের শিকারে পরিণত করে। এরপর বিমানবন্দর থেকে গন্তব্যে পৌঁছানো পর্যন্ত তাদের বিভিন্ন রকম ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়, হুমকি ও অনিরাপত্তার আশঙ্কার মধ্যে থাকতে হয়। ঘরেও তাদের ভয় ও অনিরাপত্তার আশঙ্কা থাকে। অনেক সময় চোর-ডাকাতের কবলেও পড়তে হয়। প্রবাসীদের জমি-জমা, সহায়-সম্পত্তি, বাসা-বাড়ি বেহাত বা অন্যের দখলে চলে যাওয়া অনেকটাই সাধারণ ব্যাপার। নিজের ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন কিংবা প্রতিবেশীরা তাদের অনুপস্থিতির সুযোগে অথবা ভুয়া কাগজপত্র করে এসব দখলে নিয়ে নেয়। এই দখল ছুটাতে বা ভুয়া কাগজপত্র রদ করতে মামলা ছাড়া অনেক সময় দ্বিতীয় পথ খোলা থাকে না। প্রবাসীদের মামলা-মোকাদ্দমা করার সময় ও সুযোগ সীমিত। ফলে দাবি অমীমাংসিত রেখে কিংবা বঞ্চনা নিয়ে তাদের ফিরতে হয় প্রবাসের কর্মক্ষেত্রে। ফেরাটাও সবার ক্ষেত্রে সহজ হয় না। পাসপোর্ট পেতে ব্যাপক ভোগান্তি ও বাড়তি খরচের মধ্যে পড়তে হয়। আর শেষ পর্যন্ত বিমানবন্দরে বিভিন্ন সংস্থার অসহযোগিতা ও হয়রানির শিকার হতে হয়। বিমানবন্দরে প্রবাসীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা কিংবা পাসপোর্ট অফিসে তাদের জন্য আলাদা ডেস্ক প্রতিষ্ঠা করা মোটেই কোনো কঠিন কাজ নয়। কঠিন কাজ নয় জাতীয় পরিচয়পত্র দ্রুততম সময়ে প্রদান করার। বিভিন্ন সময় শোনা গেছে, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হবে, যাতে তারা প্রয়োজনীয় সেবা সহজে ও দ্রুত পেতে পারেন। এ কথার বাস্তবায়ন বা প্রতিফলন দেখা যায় না। সবচেয়ে বড় কথা, প্রবাসীদের দেশে অবস্থানকালে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা দরকার, যাতে তাদের নিরাপদে থাকা ও চলাফেরা সম্ভব হয়। দ্বিতীয়ত, তাদের জমিজিরাত, সহায়-সম্পত্তি, বাসা-বাড়ি কেউ যাতে দখল করে নিতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
রেমিট্যান্স যোদ্ধারা দেশের ও দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। বিদেশে অনেক কষ্ট করে তারা রোজগার করেন। তাদের সেই কষ্টার্জিত রোজগারের অর্থে দেশে তাদের পরিবার ও স্বজনরা চলে। দেশের উৎপাদন ও উন্নয়নে সেই অর্থ কাজে লাগে। আজকে দেশের প্রায় প্রতিটা গ্রামে পাকা বাড়ি দেখা যায়, আধুনিক জীবন যাপনের উপকরণ প্রত্যক্ষ করা যায়। এসব বাড়িঘর ও উপকরণের একাংশের যোগানদার প্রবাসীরা। মানুষের জীবন-যাপনের উন্নতি, ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি ইত্যাদিতে তাদের অবদান অবিস্মরণীয়। এসব দিকের বিবেচনায় রেমিট্যান্স যোদ্ধারা যথোচিত সম্মান, মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা পাবেন, এটা প্রত্যাশিত। মনে রাখতে হবে, তাদের প্রতি এটা কোনো অনুগ্রহ নয়। আমরা আশা করবো, সরকার প্রবাসীদের জমি-সম্পত্তি ও বাসা-বাড়ির নিরাপত্তা, তাদের দেশে অবস্থানকালে নিরাপত্তা, বিভিন্ন অফিস-আদালতে বিশেষ কর্মসুবিধা প্রাপ্তি ইত্যাদি নিশ্চিত করার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন