শেয়ারবাজার মনে হয় বাংলাদেশের ক্রিকেটের মতো, কখন কী হয় ঠিক আঁচ করা মুশকিল। শেয়ারবাজারে শনির দশা এ-তো নিত্যসঙ্গী। ক্রিকেট খেলার উইকেট পতনের যেমন নিশ্চয়তা নেই, শেয়ারবাজারের সূচকের পতন আরো অনিশ্চিত। বাজেট ও শেয়ারবাজার ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাজেট নিয়ে বরাবরের মতো অনেকেই চিন্তিত। তবে এবারের এই দুশ্চিন্তার কারণ একটু ভিন্ন, সেটি হলো বাজেটে রাজস্ব নীতি, মুদ্রানীতি, আমদানি-রফতানি বাণিজ্য, মোট জাতীয় উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ও সর্বোপরি সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার লক্ষ্যগুলো সরাসরি শেয়ারবাজারকে প্রভাবিত করে। কিন্তু এই বিষয়গুলো বরাবরই উপেক্ষা করে, বিনিয়োগকারীদের কালোটাকা বিনিয়োগের বিষয়টি একটি মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে দাঁড়ায়। অথচ, দেখা যায়, এই কালোটাকা বা অপ্রদর্শিত আয় খুব কমই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ হয়। লক্ষণীয় বিষয় হলো, এবারের বাজেটের আগেই শেয়ারবাজার অস্থিতিশীল। এটি ঠিক কালোটাকা বিনিয়োগ সম্পর্কিত নয়। গত ফেব্রুয়ারি থেকে অর্থাৎ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বা শ্রীলঙ্কা নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করার আগেই শেয়ারবাজারে ঘটে চলছে লঙ্কাকান্ড। এ বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি ডিএসইএক্স সূচক ছিল ৭ হাজার ৮৯ পয়েন্ট। ওই অবস্থান থেকে শুরু হয় সূচকের পতন। তা চলতে থাকে ২২ মে পর্যন্ত। ধারাবাহিক এই পতনে সূচক ৯৪৭ পয়েন্ট কমে দাঁড়ায় ৬ হাজার ১৪২ পয়েন্টে। ঢালাওভাবে কমেছে ভালো-মন্দ সব শেয়ারের দর। ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সব শ্রেণির বিনিয়োগকারী। বাজার মূলধন হারিয়েছে প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে শেয়ারবাজারে অনেক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে, বিশেষ করে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর করপোরেট ট্যাক্স আড়াই শতাংশ কমানো হয়েছে। ফলে ওই সব কোম্পানির শেয়ারদর বেড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু বাজারে ঘটছে ঠিক এর উল্টো। শেয়ারবাজারে অর্থনীতির প্রচলিত সূত্রগুলো ঠিক কাজ করছে না। কেউ কেউ মনে করেন, এবারের এই দীর্ঘ পতনের কারণÑ বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়া। গত এক দেড় বছরে বার-তের হাজার কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করেছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। অনেকের ভাবনা, পাঁচ ছয় লাখ কোটি টাকার মূলধনী বাজারে টাকার এই অঙ্ক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে খুব বেশি বড় নয়। তবে এর একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব রয়েছে, এটি উপেক্ষা করা যায় না। আমাদের শেয়ারবাজার ক্ষুদ্র বিনিয়োগনির্ভর। এরা সবসময়ই দেশি-বিদেশি বড় বিনিয়োগকারীদের অনুসরণ করেন। তাই ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের বিবেচনাহীন সিদ্ধান্ত বাজারের পতন আরও ত্বরান্বিত করে। আর প্রাতিষ্ঠানিক সুষ্ঠু বিনিয়োগ আমাদের শেয়ারবাজারে কখনোই ছিল না। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ও ব্যক্তিশ্রেণির বড় বিনিয়োগকারী এক কথায় কারসাজিই আমাদের শেয়ারবাজারের অস্থিরতার অন্যতম কারণ। বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, গত দুই বছরে বাজারে যতসংখ্যক কোম্পানি নিয়ে কারসাজি হয়েছে, তা ২০১০ সালকেও হার মানায়। বিস্ময়ের ব্যাপার, কারসাজিচক্রের কারও কারও সঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সখ্যের খবর শোনা যায়। অথচ, এই কমিশনই বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ সুরক্ষা নিশ্চিত করবে বলে বারবার আশ^স্ত করেন। এর প্রতিফলন আপাতত বাজারে দেখা যাচ্ছে না।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা পতন ঠেকাতে ঘুরেফিরে একই কৌশল ব্যবহার করছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়াতে সরকারের ৯০০ কোটি টাকার ঘূর্ণায়মান ঋণ তহবিলের মেয়াদ ২০২৮ সাল পর্যন্ত বাড়িয়েছে। আইপিওতে কোটাসুবিধা পেতে হলে সেকেন্ডারি বাজারে আগের চেয়ে দ্বিগুণ বা কোনো ক্ষেত্রে তিনগুণেরও বেশি বিনিয়োগ থাকার বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে। আইসিবির বিনিয়োগ সক্ষমতা বাড়াতে, ভালো মৌলভিত্তি কোম্পানিতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আগের বেঁধে দেওয়া সীমা তুলে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া আইসিবির কাছে ব্যাংকগুলোর ঋণ শেয়ারবাজার এক্সপোজার লিমিটের বাইরে রাখা ও শেয়ারবাজার বিনিয়োগে ব্যাংকের ২০০ কোটি টাকা বিশেষ তহবিলের আকার বাড়িয়ে ৩০০ কোটি টাকার কথা শোনা যাচ্ছে। পাশাপাশি আগে থেকেই নিয়ন্ত্রক সংস্থার ব্যাংকগুলোর সঙ্গে চিঠি চালাচালি তো রয়েছেই। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী ফলপ্রসু কোনো প্রভাব বাজারে পড়ছে বলে মনে হয় না। কারণ, অভিজ্ঞতা বলে নির্দেশনা অমান্য করা এখন বাংলাদেশে অপসংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। এসব কোনো পদক্ষেপই যখন বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি, তখন বাধ্য হয়ে বাজারের পতন ঠেকাতে সেই পুরোনো পন্থায়, শেয়ারদরে নিচের সার্কিট ব্রেকার বেঁধে দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এই টোটকা ওষুধ বাজারের পতন ঠেকাতে সাময়িক কাজ করলেও এটি দীর্ঘমেয়াদী কোনো সমাধান নয়। এর আগে বাজার স্থিতিশীলতায় তারল্য বাড়াতে মার্জিন লোন রেশিও বাড়িয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা, যা কই এর তেলে কই ভাজার মতো।
অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় শেয়ারবাজারে বিভিন্ন সংস্কারমূলক পদক্ষেপসহ আধুনিক শেয়ারবজারের বিভিন্ন ইন্সট্রুমেন্টের কথা বলেছেন। এর মধ্যে রয়েছে, ট্রেজারি বন্ড, সুকুক, ডেরিভেটিভ, এসএমই ও এটিবি বোর্ড চালু করা, ইটিএফ চালু করা, ওপেন ইন্ড, মিউচুয়াল ফান্ড তালিকাভুক্ত করা, শেয়ারবাজারে সহায়ক ইকোসিস্টেম ও সার্বিক সুযোগ সুবিধার উন্নয়ন। লক্ষণীয় বিষয় হলোÑএই পদক্ষেপগুলো চলতি অর্থবছরের বাজেটেও ছিল। ইতোমধ্যে কিছু বাস্তবায়ন হয়েছে, আবার কিছু বাস্তবায়নের পথে। এগুলো নিঃসন্দেহে শেয়ারবাজারের জন্য যুগান্তকারী পদক্ষেপ। কিন্তু এটা অনেকের মাথায় ঢুকছে না, এবারের বাজেটে অর্থমন্ত্রী দেশের মধ্যে থাকা কালোটাকা বিনিয়োগের পথ বন্ধ করে দিয়ে, বিদেশে পাচারকৃত অর্থকে সুযোগ দিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছেন। পাচারকৃত অর্থÑ প্রথমত এটি কালোটাকা বা অপ্রদর্শিত আয়। ইতোমধ্যে দেশ থেকে পাচার হয়েছে, কিন্তু কেন? টাকার ধর্ম অনুযায়ী সুখে শান্তিতে থাকার জন্য। আবার ওই টাকা বিদেশে বসেও নেই। আর দেশে ফিরিয়ে আনা, সেখানে প্রশ্ন হলো, কেন বিলাসী জীবন উপেক্ষা করে এই অশান্তিতে ফিরে আসবে। এরপর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ- এটি বিনিয়োগকারীদের কাছে দিবাস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়। ভেবে দেখার বিষয় হলো। নিজেরা দুঃশাসন করে টাকা পাচার করলেও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পাচারকারীরা বিনিয়োগের আদর্শ বা নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে সুশাসন খুঁজে বেড়াবে। এটি একটি অদ্ভুত ও হাস্যকর বিষয়। শেয়ারবাজারে কালোটাকা বিনিয়োগের ইতিহাস মোটেও সুখকর নয়। চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত নামমাত্র ৪৯ জন কালোটাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছেন। আশার কথা হলো, গতবারের মতো এবারেও শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর করপোরেট ট্যাক্স আড়াই শতাংশ কমিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তবে স্বচ্ছতা বাড়াতে, নির্দিষ্ট কিছু শর্ত আরোপ করেছেন।
গত দুইবছরে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর করপোরেট ট্যাক্স মোট ৫ শতাংশ কমে ২০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ফলে কোম্পানিগুলোর লভ্যাংশ বেড়ে সুফল পাবে বিনিয়োগকারীরা। আশা করা যায়, নতুন বাজেটের পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন হলে শেয়ারবাজার গতিশীল হবে। সে ক্ষেত্রে সব পক্ষকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে- শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে ব্রেনের চেয়েও চরিত্রের বৈশিষ্ট্যের গুরুত্ব অনেক বেশি। শেয়ারবাজারে ভিড়ের মধ্যে স্রোতে গা না-ভাসিয়ে পরের আবেগকে নিজের বিচার বুদ্ধির উপর স্থান দেওয়া যাবে না। আমাদের দেশে বিনিয়োগকারীদের সমস্যা হলো- এরা ইতিহাস তথা ভুল থেকে শিক্ষা নেয় না, নিজেদের অলক্ষ্যে একই ভুল বারবার করেন। মোহকে সঙ্গী করে আলেয়ার পেছনে ছোটে। এ যেন রবীন্দ্রনাথের পোষ্টমাষ্টার গল্পের শেষাংশ- ‘হায় বুদ্ধিহীন মানব হৃদয়। ভ্রান্তি কিছুতেই ঘোচে না, যুক্তিশাস্ত্রের বিধান বহুবিলম্বে মাথায় প্রবেশ করে, প্রবল প্রমাণকেও অবিশ্বাস করিয়া মিথ্যা আশাকে দুই বাহুপাশে বাঁধিয়া বুকের ভিতরে প্রাণপণে জড়াইয়া ধরা যায়, অবশেষে একদিন সমস্ত নাড়ী কাটিয়া হৃদয়ের রক্ত শুষিয়া সে পলায়ন করে, তখন চেতনা হয় এবং দ্বিতীয় ভ্রান্তিপাশে পড়িবার জন্য চিত্ত ব্যাকুল হইয়া উঠে।’
লেখক: পুঁজিবাজার বিশ্লেষক
monirulislammi888@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন