রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

নড়াইলের ঘটনার দায় কার?

| প্রকাশের সময় : ১৯ জুলাই, ২০২২, ১২:০৪ এএম

নড়াইলের লোহাগাড়া উপজেলার দীঘলিয়া গ্রামের সাহাপাড়ার আকাশ সাহার ফেসবুক পোস্টে মহানবী সা.কে কটূক্তি করা হয়, যার নিন্দা জানানোর ভাষা হয় না। আবার ওই ঘটনার জেরে সাহাপাড়ায় যা কিছু ঘটেছে তাও নিন্দনীয় ও অসমর্থনযোগ্য। গত শুক্রবার ফেসবুক পোস্টের বিষয়বস্তু জানাজানি হলে প্রতিবাদ ওঠে। সন্ধ্যায় সাহাপাড়ায় দুটি বাড়িতে ভাংচুর ও একটি বাড়িতে আগুন দেয়া হয়। এছাড়া বাজারের তিনটি দোকানে আগুন দেয়া ও চারটি মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটে। প্রশাসন নিরাপত্তার আশ্বাস দিলে পরিস্থিতির বিশেষ অবনতি ঘটেনি। যারা বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছিল তাদের অনেকে বাড়িঘরে ফিরে এসেছে, অনেকে আসেনি। ইতোমধ্যে ফেসবুকে পোস্ট দেয়া আকাশ সাহাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আদালত তার তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে। ওদিকে সাহাপাড়ায় হামলার ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে যে মামলা করেছে সেই মামলায় দুই শতাধিক অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে এবং তাদের মধ্যে দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এটি হলো নড়াইলে একই ধরনের দ্বিতীয় ঘটনা। এর আগে গত ১৮ জুন সদর উপজেলার ইউনাইটেড কলেজের ছাত্র রাহুল দেব রায় মহানবী সা.কে কটাক্ষকারী ভারতের নূপুর শর্মার বক্তব্যকে সমর্থন করে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেয়। ওই ফেসবুক পোস্টেরও ব্যাপক প্রতিবাদ হয়। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে চরমভাবে অপদস্ত করা হয়। স্মরণ করা যেতে পারে, মহানবী সা.কে কটাক্ষ করে নূপুর শর্মার দেয়া বক্তব্য বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়েছে। ওআইসি ও মুসলিম দেশসমূহ তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। ভারতের শাসক দল বিজেপি নূপুর শর্মাকে দলীয় পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছে। তার বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে।

নড়াইলে এ ধরনের দুটি ঘটনা কেন ঘটলো, সেটা একটা প্রশ্ন। এর পেছনে কি অন্য কোনো উদ্দেশ্য বা মতলব আছে? নূপুর শর্মার বক্তব্য সমর্থন করে ফেসবুকে পোস্ট দেয়া কিংবা নতুনভাবে মহানবী সা.কে কটাক্ষ করার উদ্দেশ্য কি এমন যে, ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি তৈরি হোক, হিন্দুরা মুসলমানদের হামলার শিকার হোক। সেটা হলে অন্তত বলা যাবে, ভারতের মতো বাংলাদেশও সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতার দেশ এবং সংখ্যালঘুদের জানমালের কোনো নিরাপত্তা সেখানে নেই। মতলববাজদের মতলব যাই থাক, ওই দুই হিন্দু তরুণের বুঝা উচিত ছিল, মহানবী সা.কে নিয়ে কুৎসা-কটাক্ষ করে আজ পর্যন্ত কেউ পার পায়নি। ভারতকে পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে হয়েছে। এর ফলাফল বা পরিণাম কী হতে পারে, তা আন্দাজে থাকলে তারা এটা করতে পারতো না। ওই দুই ঘটনায় এ পর্যন্ত যা কিছুই ঘটেছে, তাতে মতলববাজদের মতলব সিদ্ধ হয়েছে বৈকি! এখন দেশের তথাকথিত প্রগতিবাদীরা সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে শোর তুলেছে। অতীতে হিন্দুদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মন্দির ইত্যাদিতে বিচ্ছিন্ন যত হামলা ও ক্ষতি হয়েছে তার ফিরিস্তি তুলে ধরে উচ্চকণ্ঠে কোরাস ধরতে পারছে। তাদের এই বোলচালে বাংলাদেশ কিছুটা বিব্রত হলেও যাদের খুশি হওয়ার কথা, তারা খুশি। সাম্প্রতিককালে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিছু শিক্ষকের ওপর হামলা ও নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার শিকার যেমন মুসলমান শিক্ষক হয়েছেন, তেমনি হিন্দু শিক্ষকও হয়েছেন। অথচ, দেশের একদল বিবৃতিবাজ হিন্দু শিক্ষকদের প্রসঙ্গ সামনে এনে বলছেন, হিন্দু হওয়ার কারণেই তারা হামলা ও নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। তাদের এ বক্তব্য সাম্প্রদায়িক এবং বলাই বাহুল্য, তারা বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতাই সন্ধান করেন। একজন বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষক অনেকটা বাধ্য হয়েই বলেছেন, শিক্ষক লাঞ্ছনার বিষয়টিকে সাম্প্রদায়িক বিবেচনায় না নেওয়াই শ্রেয়।

বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির রোল মডেল হিসেবে খ্যাত। এখানে সাংবিধানিকভাবে, সামাজিকভাবে, রাজনৈতিকভাবে মুসলামান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানের কোনো ফারাক নেই। শত শত বছর ধরে বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষ এখানে শান্তি, সম্প্রীতি, সহমর্মিতা ও সহযোগিতার উচ্চ সংস্কৃতি নিয়ে বসবাস করছে। বিশ্বজুড়ে সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবাদ, উগ্রবাদ ইত্যাদির যখন দ্রুত প্রসার ঘটছে, তখন সর্ব সম্প্রদায় ও সর্ব ধর্মের মানুষের নিরাপদ ও অভয়স্থল হিসেবে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিবেশী ভারতে মুসলমানসহ অন্যান্য সংখ্যালঘুর এতটুকু নিরাপত্তা নেই। তারা সেখানে নানা ক্ষেত্রে অধিকারবঞ্চিত, নিপীড়িত ও অত্যাচারিত হচ্ছে। অথচ, বাংলাদেশে হিন্দুসহ কোনো সংখ্যালঘুই বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার নয়। চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, পেশা, পদ-পদবি, সামাজিক অবস্থান প্রভৃতি ক্ষেত্রে সংখ্যাগুরুদের থেকে তারাই বরং এগিয়ে আছে। বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রশংসা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, সংস্থা ও সংগঠন করেছে। ভারতের নেতা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও গবেষকদের অনেকেই একই প্রশংসা করেছেন। সম্প্রতি ভারতের মন্ত্রী রাজানাথ শিং ভারতের চির বৈরী পাকিস্তানে ধর্মান্ধ ও কট্টরপন্থীদের অশান্তি সৃষ্টির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেছেন, বাংলাদেশের কাছ থেকে পাকিস্তানের শিক্ষা নেয়া উচিত। উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন যে, এ দেশের সরকার ও জনগণ সব সময় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সুরক্ষায় একাট্টা। এটাই স্বাভাবিক প্রত্যাশা যে, সব ধর্মের মানুষ সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে থাকবে। কেউ কোনো দিক দিয়ে কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অনুভূতিতে আঘাত দিলে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায় অন্য কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা উপাসনালয়ে হামলা চালালে তারও যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। যে কোনো বিষয়ে নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। যারা নড়াইলের দুই ঘটনাকে কেন্দ্র করে অন্য দেশের হাতে একটা অজুহাত বা তীর তুলে দিতে চাইছে তাদের বিরুদ্ধেও যথোচিত ব্যবস্থা নিতে হবে। এই সঙ্গে তাদের সম্পর্কে সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন