রেলের অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, নিম্নমানের সেবার বিষয়গুলো নতুন কিছু নয়। যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে। বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা এ খাতে বরাদ্দ ও ব্যয় করা হলেও ন্যূনতম উন্নতি দেখা যায় না। মনে হয়, অর্থ বরাদ্দ দেয়াই হয় একটি চক্রের লুটপাটের জন্য। রেলে কতটা দুর্নীতি হয় তা এ সরকারের এক সময়ের রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত বলেছিলেন, রেলে দুর্নীতির ‘কালো বিড়াল’ রয়েছে। সেই ‘কালো বিড়ালে’র তালিকায় তিনি নিজেও পড়ে মন্ত্রীত্ব হারিয়েছিলেন। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, রেলের দুর্নীতি সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নিম্নপর্যায় পর্যন্ত কিভাবে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। সম্প্রতি টিকিটের অনিয়মের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের কমলাপুর রেলস্টেশনে অবস্থান করে একক প্রতিবাদ এবং তার সাথে সহপাঠীদের একাত্মতাকে সামনে রেখে রেলের চিরাচরিত দুর্নীতির বিষয়টি আবারও সামনে এসেছে। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়। বিষয়টি উচ্চ আদালতেরও দৃষ্টিগোচর হয় এবং আদালত তা আমলে নিয়ে সরকারপক্ষের আইনজীবীদের বিষয়টি খোঁজ নিতে বলেন। এ প্রেক্ষিতে, গত বৃহস্পতিবার রেলের তিন কর্মকর্তা হাইকোর্টের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও খিজির হায়াতের ডিভিশন বেঞ্চে হাজির হন। রেলের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি নিয়ে কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে হাইকোর্ট বলেছেন, রেলে এত অব্যবস্থাপনা থাকবে কেন? কেন টিকেট কালোবাজারি হবে? আপনারা কি রেলকে গ্রাস করতে চাইছেন? হাইকোর্টের এই মন্তব্য থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, রেলের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি কতটা বৃদ্ধি পেয়েছে।
যাতায়াতের ক্ষেত্রে সবচেয়ে আরামদায়ক, সাশ্রয়ী ও নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে উন্নতবিশ্বসহ প্রায় সবদেশ যখন ুরেলকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে উন্নত করছে, তখন আমাদের দেশে এর উল্টোচিত্র দেখা যাচ্ছে। সরকার বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করলেও এর উন্নতি একেবারেই দৃশ্যমান নয়। বরঞ্চ উন্নতির বদলে অবনতির দিকে ধাবিত। রেলের একশ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী বেশুমার দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। তাদের দুর্নীতির বিষয়টি ‘ওপেন সিক্রেটে’ পরিণত হয়েছে। এর প্রতিকারের কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। রেলকে ঐ শ্রেণীর কর্মকর্তা ও কর্মচারি অনেকটা পারিবারিকীকরণ করে ফেলেছে। এছাড়া টিকেটের নানা ধরনের ‘কোটা’ প্রথার কারণে সাধারণ যাত্রীদের জন্য টিকেট পাওয়ার ক্ষেত্রটি সংকুচিত করে ফেলেছে। কয়েক মাস আগে রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর আত্মীয়র ট্রেন ভ্রমণ নিয়ে তার প্রভাব বিস্তারের ঘটনায় বেশ তোলপাড় হয়। সমালোচনার মুখে পড়েন মন্ত্রী। এতদসত্ত্বেও রেলের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। হলে টিকেট নিয়ে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কিছুটা হলেও কমত। গত ঈদে ঘরমুখো মানুষের ভোগান্তি থেকেই তা প্রমাণিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী টিকেট সংক্রান্ত দুর্নীতির প্রতিবাদ না করলে বিষয়টি আড়ালেই থেকে যেত। বলার অপেক্ষা রাখে না, যখন যে মন্ত্রী রেল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন, তাদের কেউই তেমন সাফল্য দেখাতে পারেন না। ব্যর্থতার পরিচয় দেন। বর্তমান মন্ত্রীর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। রেলকে কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত মানে উন্নীত করা যাচ্ছে না। বলা হয়ে থাকে, রেলের যাতে উন্নতি না হয়, এজন্য নানা মহল বিশেষ করে সড়ক পরিবহন খাত সংশ্লিষ্টদের কালো হাত রয়েছে। রেলের উন্নতি হলে সাধারণ মানুষ এর প্রতি বেশি আকৃষ্ট হবে এবং তাদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অভিযোগ রয়েছে, রেলকে অনিরাপদ এবং এর যাত্রীদের মধ্যে ভীতি ও নিরুৎসাহী করে তোলার জন্য পরিকল্পিতভাবে চলন্ত ট্রেনে ঢিল ছোঁড়া হয়। বিগত কয়েক বছরে ঢিলের আঘাতে শিশু থেকে পরিণত বয়সের বেশ কিছু যাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া সময়মতো ট্রেন না ছাড়া, সিডিউল বিপর্যয়, নিম্নমানের সেবা, অপ্রতুল নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনেকটা ইচ্ছাকৃতভাবে বজায় রাখা হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। উচ্চ আদালত ইতোমধ্যে রেলের ছাদে যাত্রী ভ্রমণ নিষিদ্ধ করেছে। এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা এরশাদ সরকারের আমলেও দেয়া হয়েছিল। এখনও রেলের ছাদে যাত্রীপরিবহন করার দৃশ্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে রেল কর্তৃপক্ষ যদি আন্তরিক না হয়, তাহলে এই বিপজ্জনক রেল ভ্রমণ বন্ধ করা যাবে না। বাস্তবতা হচ্ছে, সর্ষের ভেতর যদি ভূত বসবাস করে, তাহলে সে ভূত কখনোই তাড়ানো যায় না। বছরের পর বছর ধরে রেলের একশ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারিসহ বাইরের একটি মহলের স্বার্থসংশ্লিষ্ট যোগসাজস থাকায় রেলকে কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত মানে উন্নীত কারা যাচ্ছে না।
উন্নত বিশ্ব তো বটেই, পার্শ্ববর্তী ভারতে রেল ব্যবস্থা এতটা উন্নত করা হয়েছে যে, সাধারণ মানুষ এক শহর বা জেলা থেকে গিয়ে আরেক শহরে অফিস করছে। দিনের কাজ দিনে শেষ করে বাসায় ফিরতে পারছে। দুঃখের বিষয়, আমাদের রেলকে নিয়ে দিন দিন কেবল অভিযোগের পাহাড় জমছে। এ নিয়ে রেল কর্তৃপক্ষ অনেকটা নির্বিকার হয়ে রয়েছে। আমাদের কথা হচ্ছে, সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনায় প্রতিদিন যেভাবে মানুষের প্রাণ যাওয়ার মাধ্যমে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে, তা কিছুটা হলেও রোধ করতে পারে রেল ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে। রেলের সেবার মান ও নিরাপত্তা বিশ্বমানের করতে পারলে মানুষের নিরাপদ যোগাযোগ যেমন নিশ্চিত হবে, সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস পাবে, তেমনি অর্থনীতিতেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। সরকারকে অবিলম্বে রেলের উন্নয়ন ও যাত্রীসেবার মানের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। রেলের সার্বিক বিষয় তদন্ত করতে হবে এবং তার এ অবনতি পরিস্থিতির জন্য যারা দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। রেলকে মেগাপ্রকল্প হিসেবে বিবেচনা করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এর উন্নয়ন করতে হবে। অনিয়ম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখিয়ে এর যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন