রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং রাশিয়ার ওপর বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়েনের নিষেধাজ্ঞার কারণে বিশ্বজুড়ে জ্বালানি তেলসহ খাদ্য সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে। সারাবিশ্বে বিশেষ করে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন দেশে মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ বিক্ষোভ করেছে। এমনকি এ যুদ্ধের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে পদত্যাগ পর্যন্ত করতে হয়েছে। দীর্ঘ পাঁচ মাস ধরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলমান থাকায় বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় সংকটে পড়েছে। আমাদের দেশেও এর প্রভাব তীব্র হয়ে উঠছে। প্রত্যেক দেশই জ্বালানি ও খাদ্য সংকট নিরসনে কৃচ্ছ্রসাধন প্রক্রিয়া অবলম্বন করছে। এমতাবস্থায়, বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংকট নিরসনে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। এই চুক্তির মূল উদ্যোক্তা তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েপ এরদোগান। তার উদ্যোগের সাথে সম্পৃক্ত হয় জাতিসংঘ। গত শুক্রবার তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুলে রাশিয়া, ইউক্রেন, তুরস্ক ও জাতিসংঘের প্রতিনিধিরা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তির ফলে রাশিয়া কৃষ্ণসাগরে তার অবরোধ শিথিল করবে যাতে ইউক্রেন থেকে জাহাজে করে খাদ্য রফতানি করা যায়। শুধু ইউক্রেন নয়, রাশিয়ার খাদ্য রফতানিও সহজ হবে। এরদোগান এই চুক্তির প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, আমরা একটি চুক্তিতে সহায়ক হতে পেরে গর্বিত। এ চুক্তি বৈশ্বিক খাদ্য সংকট সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তা এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরাস এ চুক্তিকে ‘বিশ্বের জন্য একটি চুক্তি’ হিসেবে উল্লেখ করেন। চুক্তি বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করায় তিনি তুরস্কের প্রশংসা করেছেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ এই চুক্তি সম্পাদনে কার্যকর ভূমিকা রাখায় আমরা প্রেসিডেন্ট এরদোগান ও জাতিসংঘ মহাসচিবকে অকুণ্ঠ ধন্যবাদ জানাই।
খাদ্য রফতানি ও সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিতে যুদ্ধ চলাকালীন রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যকার চুক্তি অত্যন্ত ইতিবাচক। এর ফলে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট ও মূল্যস্ফীতি কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আসবে। বলা বাহুল্য, পাঁচ মাস আগে যুদ্ধ শুরুর পরপর রাশিয়া ইউক্রেনের উপকূলে কৃষ্ণসাগরে নৌ অবরোধ দিলে ইউক্রেনের রফতানি মুখ থুবড়ে পড়ে। ইউক্রেনের গুদামে খাদ্যশস্য মাসের পর মাস পড়ে থাকে। কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী ইউক্রেনের ওডেসা বন্দরের গুদামেই এখন দুই কোটি টনের মতো খাদ্যশস্য মজুদ রয়েছে। ইউক্রেনে শীত মৌসুমী আসন্ন এবং এ সময় তার প্রধানতম রফতানি পণ্য গম জমি থেকে সংগ্রহ করা হয়। রফতানি করতে না পারলে এ গম জমিতেই পচে যাবে। এ প্রেক্ষিতে, যে চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে, তা ইউক্রেন থেকে বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্য রফতানির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ইউক্রেন বিশ্বে গম উৎপাদনের ক্ষেত্রে চতুর্থ স্থানে রয়েছে। করোনা মহামারিতে বিধ্বস্ত বিশ্ব অর্থনীতি যখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে, তখনই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বড় ধরনের আঘাত হয়ে আসে। পর্যবেক্ষকরা বিশ্লেষণ করে বলেছেন, এ যুদ্ধের পেছনে ইন্ধন রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের। শুধুমাত্র গুটিকয় অস্ত্র ব্যবসায়ীর স্বার্থে এবং অস্ত্রের বাজার সৃষ্টি করতে তারা এ যুদ্ধ বাঁধাতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলনস্কিকে ব্যবহার করে। জেলনস্কিকে ইতোমধ্যে পর্যবেক্ষরা ‘যুক্তরাষ্ট্রের পাপেট’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের উসকানিতে নিজের দেশকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে দ্বিতীয় কোনো চিন্তা করেনি। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা এ যুদ্ধ শুধু অস্ত্রের বাজার তৈরির জন্যই সৃষ্টি করেনি, এর পেছনে বিশ্বরাজনীতিতে তাদের আধিপত্য বজায় রাখার জন্যও সৃষ্টি করেছে। যুক্তরাষ্ট্র তার প্রবল প্রতিপক্ষ রাশিয়াকে কোনঠাসা করার জন্য অর্থনৈতিক অবরোধসহ গ্যাস, জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এর অনিবার্য বিরূপ প্রতিক্রিয়া স্বরূপ বিশ্বব্যাপী খাদ্য, জ্বালানি তেল ও গ্যাসের সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে। শত শত কোটি মানুষ দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছে। এ সংকট থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেশগুলোও রেহাই পায়নি।
বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট নিরসনে যে চুক্তি হয়েছে তা অবিলম্বে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া জরুরি। শুধু এই চুক্তিই নয়, জ্বালানি তেল ও গ্যাসের ক্ষেত্রেও এ ধরনের চুক্তি হওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ‘ম্যাজিক’ দেখানোর সুযোগ রয়েছে। তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে বৈঠক করে যুদ্ধ বন্ধ করে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং খাদ্য ও জ্বালানি সংকট নিরসনে ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখতে পারেন। যেহেতু অভিযোগ রয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররাই এ যুদ্ধের নেপথ্যে রয়েছে, তাই জো বাইডেন এগিয়ে এলে যুদ্ধ বন্ধ করা অনেকটা সহজ হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে জাতিসংঘকেও উদ্যোগী এবং কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। এরদোগান একক উদ্যোগে যে কাজ করেছেন, জো বাইডেনও একই ধরনের উদ্যোগ নিয়ে বিশ্বে প্রশংসিত হতে পারেন। যুদ্ধ এক সময় থেমে যাবে, তবে যুদ্ধ বন্ধে যারা উদ্যোগী হয়েছেন এবং ভূমিকা রাখছেন, তারা ইতিহাসে নায়ক হিসেবে ঠাঁই পাবেন। আমরা আশা করি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন