১৬ জুলাই ১২ ঘণ্টায় সড়কে প্রাণ গেছে ৩১ জনের। পানিতে নৌডুবিতে নিখোঁজ ৬ জন। এটা পত্রিকার সংবাদের পরিসংখ্যান। এই মৃত্যু হয়েছে অনেকটা খুনের মতো। সড়কে এখন রোধ হচ্ছে না। বেপরোয়া গতির যান চলাচল বন্ধ হচ্ছে না। যে যার মতো গতিতে চলছে ওভারট্রেকিং করছে। তাই দুর্ঘটনা বাড়ছে। বাড়ছে মানুষের জীবন কেড়ে নেওয়ার ঘটনা। বাড়ছে পঙ্গুত্ব।
মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে মনে, ‘জীবন তুই এতো সস্তা কেন?’ পথেঘাটে মানুষের জীবন যাচ্ছে অকাতরে। আমরা কি জীবন নিয়ে মোটেও ভাবি? সংশ্লিষ্টদেরও ভাবনা নেই। সর্বনাশ হয়ে যাবার পর ক্ষণিকের জন্য ভাবি আমরা। আহ্ উহ্ করি। তারপর একদম মুখে কুলুপ আঁটা থাকে। চোখে থাকে টিনের চশমা।
অকারণে নয়, কারণেই যাচ্ছে প্রাণ। বহু কষ্টের পর সড়ক আইন-২০১৯ হয়েছে। আইনের প্রয়োগের প্রস্তুতি চলছিলো। পরিবহন নেুা আর শ্রমিকদের আন্দোলন আর ধমকিতে আইন থমকে গেছে। আইন সংশোধন হয়েছে তাও বলা যায় পরিবহন শ্রমিকদের খুশি করেই। আইনের প্রয়োগ না থাকলে মানুষ পথেঘাটে মরলে চমকে যাবারতো কিছু নেই। কারণ, আর ইচ্ছা থেকেই মরছে মানুষ। সড়কে যেমন আইনের প্রয়োগ নেই; নদ-নদীতেও নেই। লঞ্চ, নৌকা, বোটে ক’জন চড়লো দেখার কেউ নেই। ডিঙ্গি নৌকা ধারণ ক্ষমতার চেয়ে ৪ গুণ যাত্রী নিয়ে চলে নদীতে। যা হবার তাইতো হয়। ধারণ ক্ষমতা না থাকলে নৌকাতো ডুববেই। সড়কে নিয়ম না মানলে, গতি বেপরোয়া থাকলে, আনাড়ি চালকের হাতে পরিবহন থাকলে সড়কে মানুষতো মরবেই।
সড়ক দুর্ঘটনার কথা লিখতে আর ভালো লাগে না। লজ্জা বোধ করি; কষ্ট পাই। সড়কে মানুষ প্রতিদিন মরছে। গড়ে দেশে ২০ জন মানুষ সড়কে মারা যাচ্ছে। সারাবিশ^কে আতংকিত করা করোনা ভাইরাসে মৃত্যুর হারও এতো ছিল না। আমরা লিখতে লজ্জাবোধ করলেও সংশ্লিষ্টদের এব্যাপারে কোনই লাজলজ্জা নেই। মাঝে মধ্যে ভাবি, ওরা মানুষ কি না! মানুষ যদি হয় তাহলে খুনে মানুষ। এসব মৃত্যুর জন্য তাঁদের দায় আছে। এসব মৃত্যু যারা রোধ করতে পারতো তারা তাঁদের দায়িত্ব পালন করছে না বলেই প্রতিদিন এভাবে মানুষ মরছে। যাদের কারণে মানুষ মরছে; যারা আইনের প্রয়োগ করছে না, তারাতো বলা যায় মানুষ নয়; খুনে মানুষই।
আগে পত্রিকায় ফলাও করে সড়ক দুর্ঘটনার সংবাদ ছাপা হতো। এখন কোনটা ছাপে; কোনটা আবার ডাস্টবিনে স্থান পায়। পত্রিকা ক’টা ঘটনা ছাপবে? এ সংবাদ অনেকের কাছে গুরুত্বহীনও বটে! ভাবটা এমন যেন কারো কোনো দায় নেই। এমন বিষয়ে সেদিন ইংলেন্ডের জাতীয় স্বাস্থ্য সার্ভিসে কর্মরত আমার ডাক্তার ছেলেটা পত্রিকা পড়ার ফাঁকে নাস্তার টেবিলে বলছিলো, ‘বাবা লক্ষ করেছ দুর্ঘটনা এখন কোনো বিষয় নয়। এ ব্যাপারে সবাই যেন স্বাভাবিক। অথচ, হাসপাতালগুলোতে প্রতিনিয়তই দুর্ঘটনার রোগীতে ভরপুর।’ বলছিলো, আমাদের যাদের গাড়ি আছে সবার ড্রাইভার হয়ে যাওয়া দরকার। উন্নত বিশে^ অধিকাংশই নিজেদের গাড়ি নিজেরা চালায়। শিক্ষিত মানুষ অর্থাৎ সচেতন জনগোষ্ঠির হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং। ওরা আইন মানে। ওদের আইন মানতে বাধ্য করে। তাই ওদের সড়কে মৃত্যুর হার খুবই কম।
শিক্ষিত মানুষ ড্রাইভিংয়ে এলে আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনা কমবে। এও বলেছি ড্রাইভিং বা ড্রাইভারি এদেশে মর্যাদার কোনো কাজ নয়। তাই শিক্ষত মানুষ এ পেশায় আসতে চায় না। ইংলেন্ড, আমেরিকা, সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইলেন্ড এমনকি ভারতের মতো দেশেও এ পেশায় শিক্ষিত লোকজন রয়েছে অনেক। সেখানে এ পেশাটিতে মর্যাদা আছে বলেই সবাই স্বাচ্ছন্দে এ কাজ করছে। আমাদের দেশে একজন বেকার শিক্ষিত মানুষ না খেয়ে পথে পথে ঘোরে। চাকরি না পেয়ে ৫/১০ হাজারর টাকার একটি অফিস সহকারীর চাকরিতে তুষ্ট থাকে, অনায়াসে ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা সহজেই আয় করা যায় যে ড্রাইভিং পেশায় সেখানে কেউ আসতে চায় না। সবাই ড্রাইভার বলে নাক শিটকায় বলে। ড্রাইভারের কাছে কেউ মেয়েকে বিয়ে দিতে চায় না। এ অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। এ পেশাকে মর্যাদাশীল করতে হবে, তাহলে আমাদের দেশেও শিক্ষিত মানুষ ড্রাইভিং পেশায় যুক্ত হবে। আমি সেদিন আমার দেশে থাকা কম্পিউটার সাইন্সে পড়ুয়া ছেলেকে পার্টাইম ড্রাইভার হতে অনুরোধ করলে, সে উল্টো বললো, ‘তুমিওতো অবসরে ড্রাইভার হতে পার? তুমি এ কাজ করলে মানুষ আরও বেশি উদ্বুদ্ধ হবে। এ পেশার মর্যাদা অবশ্যই বাড়বে।’ ওর কথাটা ঠিকই। আমরা যারা সমাজের কিছুটা সামনে আছি তারা সবাই মিলে ড্রাইভিং পেশাকে মর্যাদাশীল করতে ভূমিকা রাখতে পারি।
রাজধানী ঢাকায় উবার টেক্সিসহ বেশ কিছু সার্ভিস আমাকে বেশ আশাম্বিত করে। আমি নিজেই এ সার্ভিস নিই মাঝে মাঝে। এতে আমি খুবই উদ্দীপ্ত বোধ করছি। এ সার্ভিসে এখন শিক্ষিত মানুষ যুক্ত হচ্ছে। উবারের লক্ষ্য হচ্ছে প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষিত বেকার গেষ্ঠিকে সম্পৃক্ত করা, শহরগুলোতে চলাচল সুগম করা এবং যানজট ও বাযুদূষণ কমানো। যদিও উবার সার্ভিসের ব্যাপারে শুরুতে সরকারের যথেষ্ট আপত্তি ছিলো। সরকার ভালোটা বুঝতে পেরে উবারের কার্যক্রমে আর বাঁধ সাদনি। আসলে ‘উবার’ নামের ‘অন-ডিমান্ড’ ট্যাক্সি সেবা সারা পৃথিবীর বড় শহরগুলোতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। বাংলাদেশেও তা সাড়া ফেলবে। এ ট্যাক্সি সার্ভিসের মাধ্যমে শিক্ষিত মানুষ ড্রাইভিং পেশায় যুক্ত হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাছাড়া অনেকেই নিজে নিজেদের গাড়ি চালান। সড়কে দ্বায়িত্ব থাকে অনেক। প্রশ্ন হলো শিক্ষিত মানুষ ড্রাইভিং পেশায় এলে কি লাভ, যাবা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পার করে তারা একটু বেশিই বোধ-বিবেক শক্তি সম্পন্ন হয়। আইন মানার প্রবণতা তাদের মধ্যে অনেক বেশি থাকে। ড্রাইভিং যথেষ্ট জ্ঞানের সাথে করতে হয়। একটু এদিক সেদিক হলেই জানমালের ক্ষতি হয়।
এদেশে সড়ক দুর্ঘটনা স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক নয়, তা হচ্ছে মানবসৃষ্ট কারণে। এই হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতরা কার্যত হত্যারই শিকার। কিন্তু হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনার উদ্যোগ নেই। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা না কমে জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলেছে। এরশাদ সরকারের আমলে সড়ক দুর্ঘটনা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেলে সরকার গাড়ির চালকের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করে। এতে চালকের দায়িত্বে অবহেলার কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় কারো মৃত্যু ঘটলে চালককে নরহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করার বিধান রাখা হয়। কিন্তু পরিবহন শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে পড়ে তা রহিত করতে বাধ্য হয় সরকার। দায়ী চালকদের শাস্তি না হওয়া, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন, লাইসেন্সবিহীন ও অদক্ষ চালক কর্তৃক গাড়ি চালানো, আনফিট গাড়ি রাস্তায় চালানো, সড়ক যোগাযোগে অব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কারণে এদেশে সড়ক দুর্ঘটনা মারাত্মক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত চালকদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর উদাহরণ খুব অনুজ্জ্বল। সব ক্ষেত্রেই দায়ী চালকরা পার পেয়ে গেছে। সরকারি হিসাবে গত ১০ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা গেছে ৩৪ হাজার ৯১৮ জন। প্রতি বছর মারা যায় ৩ হাজার ৪৯১ জন। থানায় মামলা হয়েছে এমন দুর্ঘটনার হিসাব নিয়ে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে দায়িত্বশীলদের তরফে। বেসরকারি হিসাবে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে ২০ হাজার ৩৪ জন। প্রতিদিন গড়ে মারা যাচ্ছে প্রায় ৫৫ জন। সরকারি তথ্য ও বেসরকারিভাবে প্রাপ্ত তথ্যের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান থাকার কারণ হলো, দুর্ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের ৬৭ ধরনের প্রশ্নের উত্তর সংগ্রহ করে প্রতিবেদন জমা দিতে হয়। এ ঝামেলার কারণে অনেক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর বিষয়টি যথাযথভাবে রেকর্ডভুক্ত হয় না। পুলিশের দেয়া তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ২ হাজার ১৪০ জন। মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে ১ হাজার ১৮৬ এবং সামান্য আহত হয়েছে ১৫৭ জন। অন্য একটি প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, ২০১০ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৭২ হাজার ৭৪৮টি। মারা গেছে ৫২ হাজার ৬৮৪ জন। আহত ও পঙ্গু হয়েছে আরো কয়েক হাজার মানুষ। ২০১৯ সালে প্রকাশিত এক আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এশিয়া, ইউরোপ এবং অস্ট্রেলিয়ার ১৫টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার নেপালে বেশি, দ্বিতীয় বাংলাদেশে। সবচেয়ে কম হার যুক্তরাজ্যে। এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি ১০ হাজার নিবন্ধিত যানবাহনের দুর্ঘটনায় নেপালে মারা যায় ৬৩ জন এবং বাংলাদেশে ৬০ জন। যুক্তরাজ্যে এ হার মাত্র ১ দশমিক ৪ শতাংশ।
সড়ক দুর্ঘটনাজনিত ক্ষয়ক্ষতির সাম্প্রতিক এক গবেষণা তথ্যে দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় ফি বছর ৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি সম্পদহানি হয়। এই হার দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ দশমিক ৯৫ শতাংশের সমান। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির হার উন্নত দেশগুলোর তুলনায় শতকরা ৫০ ভাগ বেশি। অন্য এক গবেষণা জরিপ থেকে জানা যায়, ৪৮ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার জন্যে দায়ী যাত্রীবাহী বাস, ৩৭ শতাংশ দায়ী ট্রাক। দেশে সন্ত্রাস দমনে যদি বিশেষ বাহিনী গঠন করা যায়, তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে এ জাতীয় বাহিনী গঠন করা হচ্ছে না কেন? জানমাল রক্ষা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আইন না মানাই হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম মূল কারণ। সবাইকে আইন মানতে বাধ্য করতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গবেষক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন