শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ফরেনসিক ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা দরকার

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ২৫ জুলাই, ২০২২, ১২:০৪ এএম

ফরেনসিক (Forensic) একটি ইংরেজি শব্দ, যার যথার্থ, গ্রহণযোগ্য ও সরাসরি বাংলা শব্দার্থ এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। বাংলা অ্যাকাডেমি প্রণীত ইংরেজি-বাংলা ডিকশোনারিতে ফরেনসিক শব্দার্থে বলা হয়েছে ‘আদালতে ব্যবহৃত আদালতি, আদালত ঘটিত, আইন ঘটিত চিকিৎসা বিদ্যা’ যা থেকে পূর্ণাঙ্গ কোনো ধারণা নেয়া যায় না। চৌধুরী মূনীর উদ্দিন মাহফুজ প্রণীত ‘আইনি শব্দমালা’ এবং বিচারপতি এলপি সিংহ ও পিকে মজুমদার প্রণীত Judicial Dictionary-তে ফরেনসিক সম্পর্কে কোনো শব্দার্থ বা ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।

Oxford Advanced LearnerÕs Dictionary এবং Oxford Thesaurus (Dictonary)-তে Forensic শব্দের কোনো ব্যাখ্যা বা শব্দার্থ পাওয়া না গেলেও Foresee শব্দের অর্থে বলা হয়েছে, Fore know, anticipate, predice, foresee প্রভৃতি অর্থাৎ ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারণা করা বা ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত, কিন্তু Forensic একটি পরীক্ষিত বস্তুনিষ্ঠ তথ্য, যা যথাযথ যাচাই বাছাইয়ের মাধ্যমে করা হয়। এ যাচাই বাছাই পদ্ধতিটিই ‘ফরেনসিক’।

১৯৪৯ সালে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ Fredic Wertham প্রণীত ‘Murderers’ বইতে প্রথম ফরেনসিক ও ভিকটোমোলজি দু’টি শব্দ প্রকাশ পায়, যাতে অপরাধ ও অপরাধী সম্পর্কিত সঠিক চিত্র, ধারণা, স্বয়ংসম্পূর্ণ ধরন এবং নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়ার একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, যাতে বিচারক অপরাধ ও অপরাধী নির্ধারণে পক্ষপাতমুক্ত বিচারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। অপরাধ সংঘটনের সময় অপরাধী ও ভিকটিমের (ক্ষতিগ্রস্ত) মানসিক অবস্থা সঠিক নির্ণয় করার জন্যও ফরেনসিক সাইকোলজি সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

আধুনিক অপরাধ বিজ্ঞানীদের মতে, সঠিক বিচারিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্য ফরেনসিক হলো একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও কৌশল, যা অপরাধ ও অপরাধীর অবস্থান, অপরাধের পরিমাণ, পরিস্থিতি, পরিবেশ এমনকি মানসিক অবস্থাসহ ভিকটিমের ক্ষতির পরিমাণ সঠিকভাবে নির্ধারণ করে। ফরেনসিক হলো Application of Scientific Method and techniques to the investigation of crime relating to court of law connection with the detection of crime and make sure of Judements.


ফরেনসিক দৃষ্টিতে শারীরিক বা সম্পদের ক্ষতিই শুধু ক্ষতি নয়, একজন মানুষের সুনাম, ইমোশন, অর্থনৈতিক, ভয়ভীতি প্রদর্শন, মানসিক আঘাতও ‘ক্ষতির’ আওতায় পড়ে। একজন অপরজনকে শুধু আঘাত ছাড়াও নির্যাতন ও মুখে ভর্ৎসনা করেও নির্যাতন করতে পারে। ফরেনসিক সাইকোলজি হলো মানসিক বা মনোতত্ত্ব এবং বিচারিক পদ্ধতির একটি যোগসূত্র, যা আইনগত নীতিমালা বিশেষ করে বিশেষজ্ঞ সাক্ষ্যের মূল্যায়ন, অপরাধ সংঘটনের সুনির্দিষ্ট অধিক্ষেত্র নির্ণয়, যা বিচারক ও আইন পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য সহায়ক ভূমিকা রাখে। এজন্য হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তি বা সাজাপ্রাপ্ত কারারুদ্ধ ব্যক্তিকে অপরাধ জগত থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য এবং তার ভবিষ্যৎ কিভাবে সুন্দর হতে পারে এজন্য একজন ফরেনসিক সাইকোলজিস্ট কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন। তবে তদন্ত, আলামত পরীক্ষা, বিশেষজ্ঞ সাক্ষ্যের মূল্যায়ন এবং বিচারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে এক ধরনের ফরেনসিক পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়, অন্য দিকে একজন পেশাগত অপরাধীকে সৎপথে ফিরিয়ে আনার জন্য সে পদ্ধতি প্রয়োগ হবে না, বরং এ মর্মে ফরেনসিক সাইকোলজিস্টের ভূমিকাই মুখ্য। তিনি কর্তৃপক্ষের অনুমতিক্রমে একজন সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির সাথে জেলখানায় বা কারারুদ্ধ অবস্থায়ই কাউন্সেলিং করতে পারেন, অন্য দিকে প্রবেশন সার্ভিসে থাকাবস্থায়, অপরাধীর নিজস্ব কমিউনিটিতে, মানসিক হাসপাতালে অথবা নিরাপদ জায়গায় কাউন্সেলিং করতে পারে। কাউন্সেলিং চলাকালীন অপরাধী বা হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তির বিগত ও বর্তমান দৈনন্দিন জীবনচরিতসহ (Life Style) তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কী ভাবনা রয়েছে তা কৌশলে জেনে নিতে হবে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জীবনেতিহাস এমনো হতে পারে যে, সে নিজের জীবন ধ্বংস করার জন্য নিজেই অবদান রেখেছে। পবিত্র কুরআন শরিফের ভাষায় ‘নিজের উপরে নিজেই জুলুম করেছে’। ‘ভালো ও মন্দ যে যা উপার্জন করবে, তার প্রতিফলই সে পাবে’ (সূরা বাকারা)। যথা নিজের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণে না রাখা, মাদকাসক্ত হওয়া, মানসিক বিকারগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও চিকিৎসা না করা, নিজ ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দেয়া, নিজে লাভবান হওয়ার জন্য মানুষের ওপর অত্যাচার নির্যাতন করা এবং পরিবার ও সমাজে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়া, পরিবারের সাথে সমন্বয়হীনতা। একজন সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি বিশেষ করে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি অনেক ক্ষেত্রে আত্মহত্যার জন্য সচেষ্ট হয়। আত্মহত্যার প্রবণতা থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার পদ্ধতি হলো ফরেনসিক সাইকোলজি। এ পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য একজন অপরাধীকে সমাজে সামাজিকভাবে পুনর্বাসন।

ভায়োলেন্স (Violence) অর্থাৎ আক্রমণ বা সহিংসতা বা ক্ষতিসাধন এবং অপরাধী ও ভিকটিম পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। শারীরিক বা ক্ষমতাকে ব্যবহার করে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কোনো ব্যক্তি, গ্রুপ বা সমাজের ক্ষতিসাধন প্রক্রিয়াই আইনি ভাষায় ভায়োলেন্স। এ ক্ষতি শারীরিক আঘাত, হত্যা, মানসিক, অর্থনৈতিক, ইমোশনাল প্রভৃতি আঘাতের পর্যায়ে পড়ে। ১. পারিবারিক ২. সাথী/বন্ধু ৩. যৌনতা ৪. ক্ষমতার অপব্যবহার ৫. সমাজ, প্রভৃতি ভায়োলেন্সের অধিক্ষেত্রে হতে পারে।

ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের মতে, দু’টি কারণে একজন মানুষ ভায়োলেন্ট (Violent) (হিংস্র) হয়। যথা- ১. জন্মগত (উত্তরাধিকার)। ২. মস্তিষ্কের সম্মুখ ভাগে আঘাতের কারণেও মানুষের হিংস্রতা বৃদ্ধি পায়। কোনো ব্যক্তি যদি মস্তিষ্কের সম্মুখ ভাগে আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তখন তার আক্রমণাত্মক মনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম থাকে না।
সমাজবিরোধী কার্যক্রম এবং মাদকের প্রভাব একজন মানুষকে ভায়োলেন্ট (হিংস্র) করে তোলে।

পর্যায়ক্রমে গবেষণায় বিচারব্যবস্থায় সঠিক ও নির্ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণসহ একজন মানুষকে ‘মানুষ’ নামক ফ্রেমবন্দী রাখা অর্থাৎ মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন একজন মানুষে পরিণত করার জন্য ফরেনসিক সাইকোজি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কলোম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক J. Mckeen Cattell ১৮৯৩ সালে ফরেনসিক সাইকোজির ওপর পরীক্ষামূলক গবেষণা শুরু করেন। জার্মানির Loues William Stern ১৯০৩ সালে সাইকোজির ওপর অবদান রাখেন। Hugo Munsterberg ১৯৮০ সালে ‘On the Witness Stand’ নামক ফরেনসিকের ওপর একটি বই প্রকাশ করেন। এর পর থেকে অনেক গবেষক এ মর্মে গবেষণা করে বিষয়টিকে অনেক এগিয়ে নিয়ে এসেছেন।

আমাদের রাষ্ট্রে সংবাদ পরিবেশনে মিডিয়াগুলো পক্ষপাতমূলক আচরণ করে। ইলেকট্রিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার মালিকেরা যে রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষক, সমর্থক সে দলের পক্ষে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে সংবাদ পরিবেশন করে। যেমন সরকার সমর্থিত পত্রিকা সরকারি দলের মিটিংয়ে পাঁচ হাজার লোকের উপস্থিতিকে বলে ১৫ হাজার মানুষ উপস্থিত ছিল। অন্যদিকে বিরোধী দল সমর্থিত পত্রিকা প্রকাশ করবে যে, বড় জোর তিন হাজার লোক মিটিংয়ে উপস্থিত হওয়ার কথা। এমনিতেও বিভিন্ন পত্রিকা বিভিন্ন ঘটনাকে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে প্রকাশ করে। চার-পাঁচটি পত্রিকা একত্রে না পড়লে বা টেলিভিশনে কয়েকটি চ্যানেল না দেখলে প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে আঁচ করা যায় না। সংবাদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে ফরেনসিক পদ্ধতি কয়েকটি গাইডলাইন দিয়েছে যা নিম্নরূপ :

১. পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে প্রাথমিক ধারণা পোষণ।

২. সংবাদ সংগ্রহে দীর্ঘসূত্রতা পরিহার করা।

৩. চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে চরম সতর্কতা অবলম্বন করা।

৪. ঘটনার অত্যন্ত গভীরে যাওয়ার জন্য পথ ও পন্থার অনুসন্ধান করা।

৫. সংশ্লিষ্ট ফাইন্ডিংসসহ পরিবেশ বিবেচনায় নেয়া।

৬.
6. Follow-up করা।

ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা আরো মনে করেন, সংবাদ সংগ্রহের পূর্বে সংবাদ সংগ্রহকারীকে নিম্ন বর্ণিত বিষয়াদি মাথায় রাখতে হবে :

ক. সংশ্লিষ্ট এলাকায় সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের ব্যবহার সম্পর্কে একটি ধারণা।

খ. ফরেনসিক কৌশল সম্পর্কে অ্যাকাডেমিক পর্যবেক্ষণ।

গ. সমাজ থেকে গণমানুষের প্রত্যাশা।

ঘ. গ্লোবালাইজেশন, সংস্কৃতিতে অন্তর্ভুক্তি ও চ্যুতিবিচ্যুতিসহ সামাজিক বিপ্লব বা সামাজিক বিদ্রোহ।

রাজনীতি ও বেশির ভাগ রাজনীতিবিদের প্রতি গণমানুষের আস্থা নেই। গণমানুষ এ মর্মে ধারণা করে যে, মিথ্যা কথা অতি সহজে যে ব্যক্তি উপস্থাপন করতে পারে সেই সবচেয়ে বড় রাজনীতিবিদ। ল্যান্ড টেলিফোনের লাইন কাটা অথচ সেই ফোনে চাকরি সুপারিশ করার মুখরোচক ঘটনা ছাড়া প্রতারণার মাধ্যমে জনগণকে তৎক্ষণাৎ খুশি করার অনেক কাহিনী বিভিন্ন এলাকায় প্রচারিত রয়েছে। আমাদের দেশে খুন, রাহাজানি, ডাকাতি, ধর্ষণসহ নানামুখী অপরাধ যেমন ঘটে তেমনি শক্রতাবশত মামলায় নির্দোষ মানুষকে জড়ানোর একটি ব্যাপক প্রবণতা রয়েছে। শপথ করে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ার লোকজনেরও অভাব হয় না। সাধারণত মাথায় টুপি পরে না, কিন্তু কোর্টে সাক্ষ্য দেয়ার সময় টুপি পরে অনর্গল মিথ্যা সাক্ষ্য দিচ্ছে, এমন ঘটনাও পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দেখেছি এবং শুনেছি।

ইনভেস্টিগেশন বা তদন্তে ক্ষমতাসীন বা টাকার প্রভাবে অনেক কিছু উলটপালট হয়। রাষ্ট্রের উচ্চ আদালত সরকারের প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার পদত্যাগ, দেশত্যাগ প্রভৃতি ঘটনা অনেক গুপ্ত বিষয়েরও সাক্ষ্য বহন করে। ফলে মৌখিক সাক্ষ্যের চেয়ে বিজ্ঞানসম্মতভাবে পরীক্ষিত সাক্ষ্য বিচারিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্ব বহন করে।

এমতাবস্থায়, ফরেনসিক পদ্ধতি আরো জোরদার ও প্রয়োগের প্রসার বৃদ্ধি হওয়া নির্দোষ ব্যক্তিকে সাজা থেকে বাঁচানোর জন্য অত্যন্ত সহায়ক। আইনজীবী ও বিচারকদের সঠিক জ্ঞানচর্চার জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ফরেনসিক ল্যাব স্থাপন এখন সময়ের দাবি। রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার ও নিজের জন্য নিজেই ক্ষতির ব্যক্তিগুলোকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক প্রশিক্ষিত কাউন্সেলর তৈরি ও সে লক্ষ্যে জাতীয়ভাবেই কাউন্সেলর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা অত্যন্ত আবশ্যক।

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন