শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

স্বাস্থ্য

নবজাতক ও শিশুদের হাইপোথায়রয়েডিজম

| প্রকাশের সময় : ২৯ জুলাই, ২০২২, ১২:০৭ এএম

শেফালি ও পারভেজ দম্পতি সদ্য একটি কন্যা সন্তানের মা-বাবা হয়েছেন। সন্তানটি তাদের খুব আকাঙ্খিত ছিল। তাদের পরিবার ও আত্মিয় স্বজনরা কন্যা সন্তানের জন্ম গ্রহণের পর আনন্দে ভাসছিলেন। নাজমা বেগম হাইপোথায়রয়েডিজমের রোগ ভুগছিলেন। একটু দেরিতেই তারা সন্তান নিতে সমর্থ হয়। এর মধ্যে দু’ দু বার এবর্শন হয়ে যায়, সে জন্য তারা খুবই দুশ্চিন্তা গ্রস্ত। সে জন্য এ কন্যা সন্তানটি পৃথিবীতে আসার পর তাদের আর আনন্দ ধরছিল না।

তিন সপ্তাহ পর তাদের আবার একটু চিন্তাক্লিষ্ট হতে হলো। সায়মা নামের এই বাচ্চা মেয়েটি খুব নরম তুলতুলে, খুব একটা কাঁদেনা, প্রস্রাব ঠিক থাকলেও পায়খানা কম করছে বলে মনে হচ্ছে এবং নড়া চড়া খুবই কম।

সায়মা আসলে নবজাতকের হাইপোথায়রয়েডিজম (থায়রয়েড হরমোনের ঘাটতিজনিত সমস্যা)-এ ভুগছে। এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা খুব কম নয়। বাংলাদেশের মতো জায়গা, যেখানে ঐতিহাসিকভাবে খাবারে আয়োডিনের ঘাটতিজনিত সমস্যা বিরাজমান। বিশেষ করে গর্ভকালীন সময়ে যদি মা’র আয়োডিনের ঘাটতি থাকে তবে সন্তানের জন্মগত হাইপোথায়রযেডিজমের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আমাদের পাশর্^বর্তী দেশ ভারতেও এ সমস্যা প্রকট। প্রতি ১,৫০০ থেকে ২,৫০০ জীবিত সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে একজন করে এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। শেফালির মতো যে মহিলারা হাইপোথায়রযেডিজমে ভুগছিলেন, এবং সেটি যদি অটোইমিউন হাইপোথায়রয়েডিজম হয়ে থাকে, তা হলে তার নবজাতকের হাইপোথায়রয়েডিজমে ভোগার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। অনেকের থায়রয়েড গ্রন্থিটি মোটেও তৈরি না হওয়া বা অকার্যকরভাবে তৈরি হবার কারণে এ রোগ হচ্ছে। এদের ক্ষেত্রে এটি জীনগত ত্রুটি। এ ত্রুটিটি বাবা মা রক্তের সম্পর্কিত হলে, সে ক্ষেত্রে সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেতে পারে। একই এলাকার, একই পরিবারের বহু মানুষ হাইপোথায়রয়েডিজমে ভোগেন। আর অটোইমিউন হাইপোথায়রয়েডিজম এক্ষেত্রে বেশি লক্ষ্যনীয়।

নবজাতকের হাইপোথায়রয়েডিজমের লক্ষণ সমূহ ঃ
১) খুব কম নড়াচড়া করা। ২) কাঁন্নাকাটি কম করা বা কাঁদলে অনেকটা মিউ মিউ শব্দ হওয়া। ৩) খাদ্য গ্রহণে আগ্রহ কম। ৪) শরীরের বৃদ্ধিও খুব কম। ৫) জন্ডিস হওয়া। ৬) পায়খানা খুব কম হওয়া। ৭) শরীর তুলতুলে বা খুব নরম হওয়া। ৮) পেট খুব বেড়ে যাওয়া বা পাতিলের মতো হয়ে যাওয়া। ৯) মাথার তালু নরম থাকা। ১০) আনুপাতিক হারে বৃহদাকার জিহ্বা। ১১) নাভি বেরিয়ে আসা (আমরিলিকাল হারনিয়া)। ১২) শীতল খসখসে ও শুকনো ত্বক। ১৩) ফ্যাকাশে দেখানো। ১৪) গলগন্ড বা ঘ্যাগ থাকা। ১৫) কিছু সংখ্যক নবজাতকের একই সঙ্গে আরো কিছু জন্মগত ত্রুটি থাকার সম্ভাবনা থাকে।

তাদের এই কাঁন্নাকাটি না করা, কম নড়চড়া করা শুরুতে খুব ভাল বাচ্চার বৈশিষ্ট মনে করা হলেও দ্রুত এ ভুল ভেঙ্গে যায়। যে পরিবারের এ রকম রোগ ধরা পড়ে সে পরিবারের পূর্বের কোন সন্তানেরও এ রোগ হয়ে থাকার ইতিহাস থাকতে পারে। যে সব বাচ্চাদের জন্মের সময় ওজন দুই হাজার গ্রামের কম বা চার হাজার পাঁচশ গ্রামের বেশি তাদের মধ্যে এ ধরণের রোগ থাকার সম্ভাবনা থাকা বেশি। আবার অধিক সন্তান প্রসবকারী মহিলার পরবর্তী দিকের সন্তানদের হাইপোথায়রয়েডিজম হবার ঝুঁকি বেশি থাকে।

জন্মগত বা নবজাতকের হাইপোথায়রয়েডিজম সন্তাক্ত করণের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম স্ক্রিনিং বা সনাক্তকরণ পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে সাধারণত নিম্নলিখিত পদক্ষেপ সন্নিবিষ্ট থাকে।

১। জন্মের ১ থেকে ২ সপ্তাহের মধ্যে নবজাতককে সনাক্তকরণ পদ্ধতির আওতায় আনা হয়।
২। শিশুটিকে খুব যত্নসহকারে তীক্ষèভাবে এবং দক্ষতার সাথে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়, যাতে হাইপোথায়রয়েডিজমের যে কোন লক্ষণ থাকলে তা ধরা পড়ে যায়।

৩। এরপর শিশুটি ল্যাবরেটরি টেস্ট করা হয়। একটু বেশি বয়সি শিশু হলে তার বুদ্ধিমত্তা (আই কিউ)-র পরীক্ষা করা হয়।

কারণ ঃ জীনগত ত্রুটি ছাড়া সবচেয়ে বড় কারণ হলো খাদ্যে আয়োডিনের ঘাটতিজনিত এলাকায় বসবাস করা। এর সাথে যদি পরিবেশগত অন্য কোন কারণ যোগ হয় তাহলে সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। থায়রয়েডের হরমোন তৈরিতে ব্যর্থতা, গ্রন্থির অস্বাভাবিকতা ইত্যাদিও থাকে। মাকে যদি গর্ভকালীন সময়ে রেডিওএক্টিভ আয়োডিন থেরাপি দেয়া হয়, তাহলে গর্ভস্থ শিশু থায়রয়েড গ্রন্থি তৈরি না হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

এ রোগটি সনাক্ত করণ প্রক্রিয়া খুব সহজ। রক্তের নমূনা ও গলার আল্ট্রাসনোগ্রাম করেই নিশ্চিতভাবে নবজাতকের হাইপোথায়রয়েডিজম সনাক্ত করা যায়। উন্নত বিশে^র প্রায় সকল নবজাতকেরই হাইপোথায়রয়েডিজম আছে কি না তা পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু কম উন্নত (বাংলাদেশসহ) দেশ গুলোতে অধিকাংশ নবজাতকের ক্ষেত্রে সনাক্তকরণের পরীক্ষাগুলো করা হয় না।

চিকিৎসাঃ যে সব নবজাতকের হাইপোথায়রয়েডিজম ধরা পড়বে তাদেরকে লেভোথায়রক্সিন ট্যাবলেট দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। পরবর্তীতে থায়রয়েড হরমোনের কার্যকারীতা দেখে লেভোথায়রক্সিনের মাত্রা ঠিক করা হয়। জীনগত, গ্রন্থির ত্রুটি বা থায়রয়েড গ্রন্থির অনুপস্থিতির কারণে এ রোগ হয়ে থাকেঃ তা হলে রোগীটিকে আজীবন এবং বেশি মাত্রায় এ ওষুধটি সেবন করতে হয়। আর অন্য কারণগুলোতে কারো কারো ক্ষেত্রে কোন এক সময় ওষুধ বন্ধ করার মতো পরিস্থিতিও হতে পারে।

চিকিৎসা পরবর্তী ফলাফল ঃ যে সব নবজাতক / শিশুর রোগ দ্রুত সনাক্ত হবে এবং সঠিক মাত্রায় থায়রক্সিন দিয়ে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া হবে, তাদের দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধি স্বাভাবিকভাবেই হবে। কিন্তু রোগটি সনাক্ত করণে দেরি হলে অথবা সঠিকভাবে চিকিৎসা করা না হলে নবজাতক / শিশুটির দৈহিক বৃদ্ধি ব্যহত হবে। মানসিক বৃদ্ধিও ঠিকমত হবে না। সারা পৃথিবীতে যত কম বুদ্ধিসম্পন্ন বা হাবা-গোবা লোক আছে তাদের একটা বড় অংশই বৃদ্ধিকালীন সময়ে হাইপোথায়রয়েডিজমে আক্রান্ত ছিল বা সঠিকভাবে চিকিৎসা পায়নি।

শিশু কিশোদের হাইপোথায়রয়েডিজম ঃ
শিশু কিশোররা সাধারণত দু’রকম হাইপোথায়রয়েডিজমে ভোগে-
১। জন্মগত হাইপোথায়রয়েডিজম ঃ (উপরে আলোচিত হয়েছে)।
২। পরবর্তী সময়ে সংঘটিত হাইপোথায়রয়েডিজম ঃ এ ধরণের হাইপোথায়রয়েডিজম সাধারণত: বয়োঃসন্ধিকালের আগে আগে বা বয়ো:সন্ধিকালের কাছাকাছি কোন সময়ে শুরু হয়। বাংলাদেশের ৭৫০ জন শিশুর মধ্যে এ রোগে ১ জন আক্রান্ত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ১,২৫০ জন শিশুর মধ্যে ১ জন এ রোগে ভোগে। যা তাদের ১২ বছর বয়সই মোট শিশুর ৪.৬ শতাংশ।

শারীরিক বহুবিধ প্রয়োজনে থায়রয়েড হরমোন অতীব জরুরি। যেমন- শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি, শিশুর হাড়ের গঠন তৈরি এবং বিপাকীয় কার্যক্রম।

প্রায় সব দেশেই শিশু কিশোররা অটোইমিউন হাইপোথায়রয়েডিজমে ভোগে। এ ক্ষেত্রে দেহের রোগ প্রতিরোধী কার্যক্রম (ইমিউন সিস্টেম) থায়রয়েড গ্রন্থির কোষগুলোকে আক্রমন করে যাতে প্রদাহ তৈরি হয় এবং থায়রয়েড গ্রন্থির ক্ষমতা হ্রাস করে থাকে। অল্প কিছু ক্ষেত্রে পিটুইটারির কার্যক্রম কমে যাবার কারণে বা কোন কোন ওষুধের কারণে হাইপোথায়রয়েডিজম হতে পারে। ডাউনসিনড্রোমের মতো কিছু কিছু জন্মগত রোগেও শিশুদের হাইপোরয়েডিজমে ভুগতে দেখা যায়।

লক্ষণ সমূহ ঃ
১. দৈহিক বৃদ্ধি কম বা বামুনত্ব বা বৃদ্ধির হার ধীর। ২. দেহের তূলনায় হাত-পা খর্বাকৃতি হওয়া। ৩. স্থায়ী দাঁত উঠতে বিলম্ব হওয়া। ৪. লেখা পড়ায় খারাম হওয়া, অমনযোগী বা মনোসংযোগে ব্যর্থ হওয়া। ৫. বুদ্ধিমত্তায় ঘাটতি প্রদর্শিত হওয়া। ৬. দৈহিক দূর্বলতা। ৭. মুখ ফোলা ফোলা লাগা। ৮. দৈহিক স্থুলতা। ৯. ঘুমের সমস্যা। ১০. বেশি ঠান্ডা লাগা বা জ¦র জ¦র বোধ করা। ১১. চুল ভঙ্গুর হওয়া। ১২. নারীর প্রতি ধীর। ১৩. গলগন্ড বা ঘ্যাগ। ১৪. মাংশ বা অস্থি সন্ধিতে ব্যথা। ১৫. যৌবন প্রাপ্তিতে বিলম্ব।

উপরিউক্ত লক্ষণ থাকলে শিশুকে অতি দ্রুত একজন হরমোন বিশেষজ্ঞ (এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট) কে দেখানো জরুরি। তিনি শিশুটির রক্তের নমুনা নিয়ে থায়রয়েড ও হরমোন পরিমাপের ব্যবস্থা করবেন। অনেক ক্ষেত্রেই গলার আল্ট্রসনোগ্রাম দরকার হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্রমজোমাল, জেনেটিক বা আপটেক টেস্ট করতে হতে পারে।

প্রধান চিকিৎসা পদ্ধতি হলো - থায়রক্সিন ট্যাবলেট দেওয়া। এক্ষেত্রে এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট শিশুটির হরমোনের ঘাটতির মাত্রা, হাইপোথায়রয়েডিজমের কারণ, শিশুর বর্তমান অবস্থা- সবই বিবেচনা করবেন। যত আগে চিকিৎসা শুরু করা যাবে শিশুটির স্থায়ী ক্ষতি হবার সম্ভাবনা তত কম হবে।

ডাঃ শাহজাদা সেলিম
সহকারী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ
কমফোর্ট ডক্টর’স চেম্বার
১৬৫-১৬৬, গ্রীনরোড, ঢাকা
মোবাঃ ০১৭৩১৯৫৬০৩৩, ০১৫৫২৪৬৮৩৭৭
Email: selimshahjada@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন