শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ০৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৮ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে হবে

আ. ন. ম. মাছুম বিল্লাহ ভূঞা | প্রকাশের সময় : ৩১ জুলাই, ২০২২, ১২:০৫ এএম

আমরা মহা দুর্যোগের মুখোমুখি। মহা দুর্যোগের কারণ জীবাশ্ম জ¦ালানির ব্যবহার বৃদ্ধি। ফলে দেখা দিয়েছে জলবায়ু বিপর্যয়, যা বিশ্বকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলেছে। শিল্পবিপ্লবের পর হতে উন্নয়নের নামে প্রকৃতিকে ইচ্ছামতো ব্যবহার করে কর্তৃত্ব ফলানোর ধারণায় মানুষ ডুবে আছে। মানুষ পরিবেশ ও প্রকৃতি থেকে রসদ নিয়ে ইচ্ছামতো নিজের ভোগবিলাস পূরণেই ব্যস্ত, এখনো অবস্থার বদল ঘটেনি। ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশের অবনতি ঘটছে। প্রকৃতির ওপর মানুষের প্রভুত্ব কায়েমের এই যুগকে বলা হয় ‘এনথ্রোপোসিন’। এতে মানুষসহ পৃথিবীর প্রাণ-প্রকৃতির অস্তিত্ব টিকে থাকার ওপর হুমকি সৃষ্টি হয়েছে।

ক্রমাগত প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশ ধ্বংসের বিষয় অনুধাবন করে ১৯৭১ সালে ইরানের রামসার শহরে পরিবেশবাদী সম্মেলন (কনভেনশন) হতে উন্নয়ন ও পরিবেশের যোগসূত্র নিয়ে ভাবনা শুরু করেছে, যা রামসার কনভেনশন চুক্তি বলে পরিচিত। এরপর ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের ৩ জুন থেকে ১৪ জুন তারিখে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের পরিবেশ ও উন্নয়ন শীর্ষক সম্মেলনে (উক্ত সম্মেলন ‘আর্থ সামিট’ নামে সাধারণের কাছে পরিচিত) সাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির মূল লক্ষ্য ছিল, বায়ুমন্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের হার এমন অবস্থায় স্থিতিশীল রাখা, যাতে জলবায়ুগত মানবিক পরিবেশের জন্য তা বিপত্তিকর না হয়।

১৯৯২ সালে ধরিত্রী সম্মেলনের পর বিগত প্রায় ৩০ বছরে বায়ুমন্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের হার না কমে বরং বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বৈশি^ক উষ্ণায়নের কারণে প্রকৃতির উপর জলবায়ু বিপর্যয়ের ধাক্কা বাংলাদেশের ষড়ঋতুর উপরও ভালোভাবেই জেঁকে বসেছে, যার প্রভাব পড়ছে জীবন ও প্রকৃতিতে। ঝুঁকিতে পড়ছে কৃষি, বাড়ছে দুর্যোগ, বাস্তুচ্যুত হচ্ছে মানুষ। কেউ স্বীকার করুক বা না করুক, পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের উদ্বাস্তু রয়েছে। যেমন- উন্নয়ন উদ্বাস্তু, পরিবেশ উদ্বাস্তু, এখন দেখা যাচ্ছে জলবায়ু উদ্বাস্তু।

সামগ্রিকভাবে জলবায়ু বিপর্যয়ে বাংলাদেশে দুর্যোগের পরিমাণ ও তীব্রতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। শুধু বন্যার ক্ষেত্রেই নয়, বাংলাদেশে কয়েক বছর অনাবৃষ্টি, তীব্র শৈত্যপ্রবাহ, তীব্র তাপদাহ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা, জোয়ার-জলোচ্ছ্বাসও বেশি হচ্ছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, আবহাওয়ার এ বৈরী আচরণ চলছে সারা পৃথিবীতে। নতুন নতুন রোগও মোকাবিলা করতে হচ্ছে মানুষকে। অতীতে কোনো বিশ্বযুদ্ধও মানুষকে এত ভাবিয়ে তুলতে পারেনি, বর্তমানে জলবায়ু বিপর্যয় যেভাবে ভাবিয়ে তুলছে।

২০১২ খ্রিস্টাব্দে স্টকহোম সম্মেলন বিশ্বের তাপমাত্রাকে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস কমিয়ে আনার বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করে ছিল। এই বিষয়টিতে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশ কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু জীবাশ্ম জ¦ালানি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ না করার কারণে তাঁরা সফলতার মুখ দেখছেন না। যদিও স্টকহোম সম্মেলনে ‘বিশ্বের স্থায়ীত্বের জন্য হুমকি জলবায়ু পরিবর্তন শীর্ষক ঐ বৈঠকে একটি স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর করেছিলেন ২০ জন নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানীসহ ৫০ জন বিভিন্ন পর্যায়ের স্বনামধন্য ব্যক্তি। তবে কিয়োটো প্রটোকলের আলোকেও বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ থেকে দেড় ডিগ্রি নামিয়ে আনা যায়।

কী কী কাজ করলে এই মহা দুর্যোগ থেকে আমাদের জীবন, প্রাণ-প্রকৃতি বাঁচাতে পারবো, তা নিয়ে শুধুমাত্র চিন্তা করাই নয়, কাজ করার এখনই সময়। কারণ আমরা জানি ‘সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়’। অনেকেই বলে থাকেন ‘গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান’। কিন্তু আমরা হাতে গোনা কিছু মানুষ ছাড়া কেউই বলছি না, জীবাশ্ম জ¦ালানি ব্যবহার বন্ধ করুন, পরিবেশ ও প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষা করুন। এই সব বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতে সোচ্চার নয়, অতিমাত্রায় কার্বন নিঃসরনকারী জি-২০ দেশগুলো। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দেশকে ধনী বা উন্নত দেশ বলা হয়, এটা বাস্তব কিন্তু বিষয়টি অস্বাভাবিক। যদিও অনেক দেশের তরুণ ও স্কুল শিক্ষার্থীরা জলবায়ুর বিপর্যয়ের হাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে বিভিন্ন সময়ে প্রত্যেক মাসে শুক্রবারে ফ্রাইডে ফর ফিউচার নামে মানববন্ধন, মিছিল, সভা-সমাবেশ করে চলেছে।

জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক দেশের রাষ্ট্রনেতারা শুধুমাত্র ক্ষতিপূরণ চাচ্ছেন। কিন্তু প্রাণ-প্রকৃতি এবং মানুষের অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্য কার্বন নিঃসরণ বন্ধ করতে নিজে ও জাতিসংঘের মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোকে চাপ প্রয়োগ করছেন না। মানুষের অস্তিত্বই যদি না থাকে উক্ত ক্ষতিপূরণের অর্থ দিয়ে আপনারা কী করবেন? তা ভেবেছেন কি? আবার জি-২০ দেশগুলো অর্থাৎ অতিমাত্রায় কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলো জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে বাংলাদেশের মতো ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ দিতেও রাজি হচ্ছে না।

জলবায়ু বিপর্যয় এটা কোনো স্থানীয় দুর্যোগ নয়। পৃথিবীব্যাপী প্রাণ-প্রকৃতি এবং সকল মানুষের দুর্যোগ। মনুষ্যসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে জলবায়ু বিপর্যয়ের ফলেই তাপপ্রবাহ আরও তীব্র এবং দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। জীবাশ্ম জ¦ালানি ব্যবহার বন্ধে কোনও কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হলে এটা বাড়তেই থাকবে। কিছুদিন পূর্বে জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে বন্যায় বাংলাদেশের সিলেট বিভাগ অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অতিসম্প্রতি দাবানলে পুড়ছে গ্রিস, স্পেন এবং ইতালি। সেই সঙ্গে তাপদাহ ও দাবানল ছড়িয়ে পড়ছে ইউরোপ জুড়ে। বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্যের দুর্গম উত্তর-পশ্চিমে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। দাবানলে প্রায় এক হাজার ৩৩০ হেক্টর জমির গাছপালা নষ্ট হয়েছে।

জলবায়ু বিপর্যয় প্রতিরোধে জীবাশ্ম জ¦ালানির ব্যবহার বন্ধ না করলে প্রাণ-প্রকৃতিসহ মানুষ বাঁচানোর পরিস্থিতি ক্রমে কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। নিজেকে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচানোর প্রতি আমরা এত অনাগ্রহী কেন? যদি আগ্রহী হতাম, তাহলে আমাদের প্রতি ঘরে ঘরে এবং স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষপ্রতিষ্ঠানে জলবায়ু বিপর্যয়ের মূল কারণ জীবাশ্ম জ¦ালানির ব্যবহার বন্ধে সরকারগুলোর উপর চাপ প্রয়োগে সোচ্চার হতাম। এখনই আমাদের কাজ হচ্ছে সকলে নিজ নিজ পরিবার ও এলাকার মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা। তারপর দাবিগুলো গণমাধ্যমের সহয়তায় জনগণ এবং সরকারের কাছে পৌঁছানো।

জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের ফলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে উপকূলীয় এলাকার মানুষের বাস্তুচ্যুতি ঘটছে এবং আরো ঘটবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে অনেক প্রজাতির পতঙ্গ মারা যাবে। পরাগায়ণ না হওয়ার কারণে ফুল ও ফলের উৎপাদন কমে গিয়ে কৃষি উৎপাদন হ্রাস পাবে। অনেক পাখি ও জলজপ্রাণী মারা যাবে। মানুষের খাদ্যাভাব দেখা দেবে, যার ফলে মানুষ স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে দারিদ্র্য, খাদ্যাভাব, সুপেয় পানির অভাব দেখা দেবে। ফলে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকিও বেড়ে যাবে।

লেখক: আইনজীবী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন