ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক রীতিমত তলানিতে এসে ঠেকেছে। ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ এবং রাশিয়ার ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় রাশিয়া ক্ষুব্ধ। এই ক্ষুব্ধতা আরো তীব্র রূপ নিয়েছে প্রেসিডেন্ট বাইডেন প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ‘যুদ্ধাপরাধী’ বলায়। বলা যায়, দুই পরাশক্তির সম্পর্ক একটা বিপজ্জনক পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে। এমতাবস্থায় সবাইকে বিস্মিত করে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন ও রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের মধ্যে টেলিফোনে আধঘণ্টা কথা হয়েছে। ইউক্রেনে রুশ হামলার পর এটা দু’দেশের উঁচু পর্যায়ের প্রথম আলাপ এবং অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলাপ। উল্লেখ্য, অ্যান্টনি ব্লিনকেন যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের একজন। ওবামা প্রশাসনে তিনি ডেপুটি সেক্রেটারি অব স্টেটের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জো বাইডেনের নির্বাচনী প্রচারণায় ফরেন পলিসি উপদেষ্টা ছিলেন। হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের এই কৃতী ছাত্র পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তার রুশ প্রতিপক্ষ সের্গেই ল্যাভরভ বিশ্বের একজন শীর্ষ ফরেন পলিসি বিশেষজ্ঞ হিসেবে খ্যাত। তিনি ২০০৪ সাল থেকে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এই দুই বিজ্ঞ-অভিজ্ঞ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যকার আলাপ, সংলাপ বা বৈঠক যে বিশেষ তাৎপর্যবহ হবে, তাতে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। যতদূর জানা গেছে, ব্লিনকেন ল্যাভরভ টেলি-আলাপে ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশেষত খাদ্য রফতানি চুক্তি, বন্দী বিনিময় ইত্যাদি স্থান পায়। ব্লিনকেন ইউক্রেনের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলকে অঙ্গীভূত করার বিষয়ে রাশিয়াকে সতর্ক করেন এবং ক’দিন আগে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে স্বাক্ষরিত খাদ্য রফতানি চুক্তির বাস্তবায়ন-অগ্রগতি কামনা করেন। ল্যাভরভ ক্লিনকেনকে বলেন, রাশিয়া তার অভিযানের লক্ষ্য অর্জন করবেই। পশ্চিমাদের ইউক্রেনকে অস্ত্র দেয়াতেই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হচ্ছে। খাদ্য প্রসঙ্গে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণেই খাদ্য সংকট তৈরি হয়েছে এবং খাদ্যকে নিষেধাজ্ঞার বাইরে রাখার প্রতিশ্রুতি যুক্তরাষ্ট্রই রাখছে না। টেলি-আলাপে রাশিয়াতে বন্দী দুই মার্কিন নাগরিকের মুক্তির বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রে বন্দী এক রুশ নাগরিকের মুক্তি দেয়ার প্রস্তাব দেন ব্লিনকেন। প্রস্তাব ল্যাভরভ রাজি হয়েছেন কিনা, জানা যায়নি।
মার্কিন ও রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই টেলি-আলাপ কতটা সফল হয়েছে, এখনই বলা যাবে না। তবে এর মধ্যে দিয়ে মস্তবড় একটা লাভ হয়েছে। সেটা এই যে, দু’দেশের মধ্যে উঁচু পর্যায়ের আলোচনার দুয়ার খুলেছে। খবরে স্মরণ করা হয়েছে, কয়েক সপ্তাহ আগে যেখানে ব্লিনকেন ল্যাভরভকে এড়িয়ে চলেছেন, সেই তিনিই তাকে আগে ফোন করেছেন। আগামীতে তাদের উভয়ের মধ্যে আরো টেলি-আলাপ এমনকি মুখোমুখী বৈঠকও অনুষ্ঠিত হবে, এমন আশাবাদ তো এই প্রেক্ষাপটে করাই যায়। পরিস্থিতি উন্নয়নের পথে এটা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। ওদিকে গত ২৮ জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের মধ্যে একটি ভিডিও কমনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়েছে। দু’ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলা এ ভিডিও কনফারেন্সে কী কী বিষয়ে কর্থাবার্তা হয়েছে, তার বিস্তারিত জানা না গেলেও তাইওয়ান প্রসঙ্গ যে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে, প্রকাশিত খবরে সেটা স্পষ্ট হয়েছে। তাইওয়ান ইস্যু চীনের কাছে অত্যন্ত স্পর্শকাতর। তাইওয়ান চীনের অচ্ছেদ্য অংশ, চীন সেটাই মনে করে। তাইওয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক, যোগাযোগ, সহযোগিতা কিংবা তার স্বাধীনতা সমর্থন করলে চীন তা বরদাশত করে না। শোনা যাচ্ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের হাউজ স্পিকার ন্যান্সি পলোসি তাইওয়ান সফরে যাবেন। চীনের সেটা পছন্দ নয়। ভিডিও কমফারেন্সে তাই শি জিন পিং জো বাইডেনকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন। বলেছেন, আগুন নিয়ে না খেলা করতে। শি জিন পিং এও বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ‘এক চীন নীতি’ মেনে চলা উচিত এবং এটা বুঝা উচিত যে, চীন তাইওয়ানের স্বাধীনতা এবং সেখানে বাইরের শক্তির প্রবেশের বিরুদ্ধে। পরে হোয়াইট হাউসের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তাইওয়ান বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। বলা বাহুল্য, যুক্তরাষ্ট্রও ‘এক চীন নীতিতে’ বিশ্বাসী। মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চীনা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সরাসরি কথা বললে তাইওয়ানকেন্দ্রিক উত্তেজনা প্রশমিত হতে পারে। এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা। মুখোমুখী বৈঠক ও সরাসরি সংলাপ যে-কোনো উত্তজনা, বিরোধ ও বিতর্ক নিরসনে অধিক কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের অধিকাংশের মতে, ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নই দায়ী। তাদের নানামুখী উস্কানি, ইউক্রেনকে অস্ত্রসজ্জিত করা কিংবা ন্যাটোর আওতাভুক্ত করা ইত্যাদি কার্যক্রমের প্রতিক্রিয়া হিসেবেই রাশিয়া তার আত্মরক্ষার যুক্তিতে ইউক্রেনে অভিযান চালায়। কয়েক মাস ধরে চলা এ যুদ্ধের শেষ কবে হবে, বলার উপায় নেই। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হতে পারে, এমন কি অনিঃশেষ যুদ্ধে রূপ নিতে পারে, এরূপ আশংকাও করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে যুদ্ধের জের হিসেবে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সংকট, খাদ্য সংকট, দুর্ভিক্ষের ভীতি, অর্থনৈতিক দূরবস্থা, রাজনৈতিক বিপর্যয়ের শংকা সৃষ্টি হয়েছে। ইউক্রেনে রুশ অভিযানের দায়ে পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার বিরুদ্ধে নানা দিক দিয়ে যেসব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, রাশিয়া এর বিপরীতে জ্বালানি, খাদ্য ইত্যাদি সরবরাহের ক্ষেত্রে বাধা দানের নীতি গ্রহণ করেছে। এর ফলাফল কিন্তু কারো জন্যই শুভ হয়নি, না যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের, না রাশিয়ার। বস্তুত, বিশ্বের সকল দেশই যুদ্ধের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ভয়াবহ শিকার। অবিলম্বে যুদ্ধের অবসান হওয়া দরকার। এর জন্য পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার বিকল্প নেই। ইউক্রেনের খাদ্য রফতানি উন্মুক্ত করার বিষয়ে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে জাতিসংঘ ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় যে চুক্তি হয়েছে, তার সুফল ফলতে শুরু করেছে। আলোচনা ও মধ্যস্থতা যুদ্ধ বন্ধের ক্ষেত্রেও সাফল্য এনে দিতে পারে। শি জিন পিং ও বাইডেন সংলাপ কিংবা ব্লিনকেন-ল্যাভরভ ফোনালাপ যে ইতিবাচক মনোভাবের প্রমাণ স্থাপন করেছে তাকে আরো অগ্রসর ও কার্যকর করতে হবে। সবারই জানা, যুদ্ধ ধ্বংস ছাড়া কোনো সমাধান দিতে পারে না। ধ্বংস এড়াতে শান্তির পথে আসতে হবে। এজন্য সকল পক্ষের কিছু না কিছু ছাড় দিতে হবে। আমরা আশা করবো, যত দ্রুত সম্ভব যুদ্ধ বন্ধে আলোচনা-সংলাপ শুরু হবে। এ বিষয়ে জাতিসংঘকে অগ্রবর্তী ভূমিকা রাখতে হবে। শান্তি ও সমৃদ্ধিকে এগিয়ে নিতে হবে, এই হোক এ মুহূর্তের কামনা ও শপথ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন