শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা রোধের বিকল্প নেই

সম্পাদকীয়-২

| প্রকাশের সময় : ৩০ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ঘরে-বাইরে সবখানেই নারী ও শিশু প্রতিনিয়ত সহিংসতার শিকার হচ্ছে। ক্রমাগত দেশে এ ধরনের সামাজিক অপরাধও বেড়েই চলেছে। নারী শিশু ধর্ষণ, হত্যা, অমানবিক সহিংসতা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়ে চললেও প্রশাসনের টনক নড়ছে বলে মনে হচ্ছে না। নারী শিশুর প্রতি সহিংসতা রোধে কঠোর আইন থাকলেও তার প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন সঠিকভাবে হচ্ছে কি না সেটাও প্রশ্ন। বিচারহীনতার সংস্কৃতিই এসব অপরাধ বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ। তাছাড়া ইসলামী ভাবধারা নির্মাণের পথে শত বাধা-বিপত্তি, দেশীয় সংস্কার ধ্বংস করা, ধর্মীয় অনুশাসনকে নিরুৎসাহিত করা, নতুন প্রযুক্তির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, সামাজিক রীতি-পদ্ধতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন ও সর্বোপরি সর্বক্ষেত্রে ন্যায়নিষ্ঠার পথ পরিহার করে জোরজুলুমের রাজত্ব কায়েম থেকেই মানুষের মনে দিন দিন হিং¯্রতা, নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা বাসা বাঁধছে। প্রতিদিনকার ঘটনা থেকে এ অশনি সঙ্কেত স্পষ্ট হয়ে উঠছে এবং বাংলাদেশের জাতীয় মনস্তত্ত্ব যে পতনের গভীর খাদে তলিয়ে যাচ্ছে তা খুব ভালো করেই আন্দাজ করা যাচ্ছে। উদাহরণ স্বরূপ নিচের তথ্য-উপাত্ত উল্লেখ করা যায়, গত এক বছরে এবং চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত এই ২২ মাসে ৯ হাজার ৬৩৬ নারী সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এ ২২ মাসের সমানুপাতিক হারে চলতি বছর শেষে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনার পরিমাণ হতে পারে ১০ হাজার ৪৫৯টি। ২০১৫ সালে দেশের শীর্ষ ১৪টি দৈনিক ও চলতি বছরের ১০ মাসে ১৩টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের আলোকে এ তথ্য সংগ্রহ করেছে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি। গত রোববার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
নারী সহিংসতা সংক্রান্ত এ প্রতিবেদন আমাদের কী বার্তা দিচ্ছে? পাশাপাশি গতকাল দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত শীর্ষ প্রতিবেদনের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী শিশুদের প্রতি যে নিষ্ঠুর ও বর্বর সহিংস আচরণ দেশে দেখা যাচ্ছে তারই বা কী কারণ থাকতে পারে, এ নিয়েও জাতি কম ভাবিত নয়। একটি বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থার জরিপ মতে, গত দুই বছরে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, ২০১৫ সালের তুলনায় চলতি বছর নারী শিশু নির্যাতন, অপহরণ, ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে।  আইন ও সালিস কেন্দ্রের তথ্য মতে, গত ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত দেশে ধর্ষিত হয়েছে ৪৫৩ জন। সেপ্টেম্বরে কমপক্ষে ১০ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩৩ নারীকে। ধর্ষিত ৪৫০ নারীর মধ্যে ৭৯ জনের বয়স ৭ থেকে ১২ বছর। ৩৫ জনের বয়স ৬ বছরের নিচে। শীর্ষ একটি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী গত ২৭ বছরে ভেজাল প্যারাসিটামল খেয়ে মারা গেছে হাজার হাজার শিশু। ভেজাল ও নকল প্যারাসিটামল খেয়ে এ পর্যন্ত কত হাজার শিশুর জীবনহানি ঘটেছে তার কোনো পরিসংখ্যানও নেই। অবশ্য নকল ও ভেজাল ওষুধ তৈরি ও বাজারজাত করেও ওষুধ প্রশাসনের একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তার কারণে সংশ্লিষ্ট খুনিরা পার পেয়ে যাচ্ছে।
গত ১৮ অক্টোবর দেশে স্মরণকালের ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা সংঘটিত হয় দিনাজপুরের পার্বতীপুরে। পাঁচ বছর বয়সী এক কন্যা শিশু নিখোঁজ হওয়ার পর অচেতন অবস্থায় তাকে পাওয়া যায় বাড়ির অদূরের হলুদ ক্ষেতে। প্রতিবেশী পাষ- যে লোকটিকে শিশুটি কাকু বলে ডাকত সে নরপিশাচ কর্তৃক নির্যাতিত এ শিশু এখন বেঁচে থাকলেও দৈহিক ও মানসিকভাবে চরম বিপন্ন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গঠিত চিকিৎসক বোর্ডের সদস্যদের ভাষায়, এমন নিষ্ঠুরতা আমরা আমাদের চিকিৎসক জীবনে দেখিনি। শিশুটির বিশেষ অঙ্গ ব্লেড দিয়ে কেটে ফেলা হয়েছে। পাশবিকতায় ভেঙে গেছে তার জনন অঙ্গের হাড়। সিগারেটের অসংখ্য সেঁকা দেয়া হয়েছে নিষ্পাপ শিশুটির দেহে। এ ধরনের আরো ঘটনা শিশুদের বেলায় ইদানীং আকছার ঘটছে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর মাসুদা এম রশীদ চৌধুরীর কথা খুবই প্রণিধানযোগ্য। তার ভাষায়Ñ আমাদের বিবেক মরে গেছে। দিনে দিনে মানুষ কেমন যেন হিং¯্র হয়ে উঠছে। সমাজ থেকে নৈতিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধ উঠে গেছে। ধর্মীয় ও পারিবারিক শিক্ষার অনুপস্থিতির ফলে সব ধরনের অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব বিশ্লেষণকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী যে ভাবনার জন্ম হচ্ছে তা সংশ্লিষ্টদের অনুধাবন করে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার প্রতি জোর দিতে হবে। পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে  নৈতিকতার চর্চা। ধর্মীয় সকল উদ্দীপক শক্তিকে উৎসাহিত করে কাজে লাগাতে হবে। নারী ও শিশু ধর্ষণের ক্ষেত্রে পুরুষদের যৌন বিকারগ্রস্ত হওয়ার যত কুরুচিপূর্ণ আয়োজন সব নিষিদ্ধ ও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মানুষের মন-মানসিকতা পরিবর্তনের জন্য ধর্মীয় সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিক ভাবনার সঞ্জীবন জরুরি। আইনের প্রয়োগকেও বেগবান করার বিকল্প নেই। পাশাপাশি সাময়িকভাবে হলেও নতুন ট্রাইব্যুনাল গঠন করে শিশু ধর্ষণ ও সহিংসতার শাস্তি দ্রুততর করতে হবে। মামলার কাজ দ্রুত শেষ করে কঠোর সাজা না দিলে এ ধর্ষকামী প্রবণতা রোখা যাবে না। দেশে খুন ও ধর্ষণের চাঞ্চল্যকর কিছু মামলার বিচারহীন পরিণতি এবং যৌন উসকানিমূলক নানা কালচারের চর্চাও এ পরিস্থিতির জন্য কম দায়ী নয়। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেয়া হবে এটিই জনগণের প্রত্যাশা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন