শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

পানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি

সম্পাদকীয়-১

| প্রকাশের সময় : ৩০ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

প্রতিবেশীর বৈরী পানি নীতির একগুঁয়েমির নির্মম শিকার যখন বাংলাদেশ তখন গত মঙ্গলবার বুদাপেস্টে  পানি সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দুষ্প্রাপ্যতাই নয় পানি সমস্যার সাথে ন্যায্য বণ্টনের বিষয়টিও জড়িত। পানি ব্যবস্থাপনায় সার্বজনীন বৈশ্বিক উদ্যোগের উপর তিনি গুরুত্বারোপ করে পানি ব্যবস্থাপনায় এখনই একত্রে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। আন্তঃসীমানা পানি বণ্টনে যথাযথ নীতিমালা প্রণয়নের উপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেছেন, আন্তঃসীমান্ত নদীর পানির সুব্যবস্থাপনা খুবই প্রয়োজনীয় বিষয়। পানি সমস্যাকে তিনি ন্যায্য বণ্টনের সাথে সম্পর্কিত করে বলেছেন, আন্তঃসীমান্ত প্রবাহের বণ্টন একটি জটিল বিষয় হয়ে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশে আমাদের সংস্কৃতি চেতনা জীবন ও জীবিকার প্রধানকেন্দ্র জুড়ে রয়েছে পানিÑ একথা উল্লেখ করে তিনি পানি ইস্যুকে রাজনীতি ও কার্যক্রমে অগ্রাধিকার প্রদানের জন্য বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশ বর্ষা মওসুমে ব্যাপক পানিতে তলিয়ে যাওয়া এবং শুষ্ক মওসুমে পানিঘাটতির অভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। অতিমাত্রায় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতার কারণে বাংলাদেশের ঝুঁকি বাড়ছে। তিনি বলেছেন, অভিন্ন নদীর পনিবণ্টন একটি জটিল বিষয়। বাংলাদেশ গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে দু’দশক আগে ভারতের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি একটি চুক্তি করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, পানি নিরাপত্তাই এ পৃথিবীর মানুষের মর্যাদাপূর্ণ ও মঙ্গলময় জীবনের নিশ্চয়তা দিতে পারে। তিনি বলেছেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দ্রুত নগরায়ন এবং অপরিকল্পিত শিল্পায়নের এই সময়ে পানির কারণে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে এবং রাষ্ট্রের ভেতরে বৈষম্য ও বিভেদ তীব্রতর হচ্ছে। কাজেই পানির সুরক্ষা, সংরক্ষণ ও এর সদ্ব্যবহারের উপর সমষ্টিগতভাবে নজর দিতে হবে। তাতে কেবল পানি নিয়ে বৈষম্যই দূর হবে না, সমাজে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সহজ হবে। কেননা  বিশ্বে অনেক উত্তেজনা ও সংঘাতের মূলে রয়েছে এই পানি। সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী সাতদফা প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেছেন।
পানির অপর নাম জীবন। বর্তমান সময়ে পানি নিয়ে বাংলাদেশ কতটা মারাত্মক সংকটের মুখে রয়েছে সে কথা প্রধানমন্ত্রীর আলোচনাতেও উঠে এসেছে। পানির সরবরাহ মূলত প্রাকৃতিক। আমরা ভাটির দেশ হিসেবে এটা অনুভব করছি উজানের দেশ ভারতের একগুঁয়েমি কতটা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। পানির অভাবে শুষ্ক মওসুমে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। দেশের কোন কোন এলাকায় সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। নদ-নদী নাব্য হারিয়ে হাজার হাজার কিলোমিটার নৌপথ বন্ধ হয়ে গেছে এবং যেটুকু বাকি আছে তাও বন্ধ হবার পথে। পানির অভাবের কারণে প্রকৃতিতে মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সুন্দরবনের সুন্দরী গাছে মাথামরা রোগ দেখা দিয়েছে। মনে করা হয় বিদ্যমান পরিস্থিতি বহাল থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে। এসবই হচ্ছে মূলত প্রতিবেশীর বৈরী পানি নীতির কারণে। বাংলাদেশকে পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করছে প্রতিবেশী। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সম্মেলনে তার উদ্বোধনী ভাষণে মূলত পানির সুষম বণ্টনের উপর যে গুরুত্ব দিয়েছেন, তার ভিত্তিও অনেকটাই তার তিক্ত অভিজ্ঞতা। যে ভাবেই ব্যাখ্যা করা হোক না কেন প্রকৃতির পানির উপর এ ধরনের খবরদারি অগ্রহণযোগ্য। একথাও সত্যি যে, ভূউপরিস্থ পানির সরবরাহ স্বাভাবিক না থাকলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও ঠিক থাকে না। এদিক থেকেও বাংলাদেশ পরিস্থিতির শিকার। দেশের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমশই নীচে নেমে যাচ্ছে। অবস্থা এরকম যে মুখে মুখে ভারত যাই বলুক কাজের বেলায় প্রতিনিয়তই বাংলাদেশকে পানি বঞ্চিত করার নানা অপপ্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত হচ্ছে। একদিকে যেমনি প্রতিবেশীর বৈরী পানি নীতির কারণে আমরা বিপদগ্রস্ত। অন্যদিকে পানি ব্যবস্থাপনার কথা বলা হলেও সে ব্যাপারটিও নানা কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বর্ষা মওসুমের পানি ধরে রাখতে গঙ্গা বাঁধের কথা বারবার বলা হলেও বাস্তবত তাতে খুব একটা অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। নদ-নদীগুলোর নাব্য ধরে রাখতে খনন ও তীর সংরক্ষণের যে আলোচনা অনেকদিন থেকে চলে আসছে সেক্ষেত্রেও কার্যকর অগ্রগতি নেই বরং নদীখেকোরা তীরগ্রাস করছে এ ধরনের খবরই প্রকাশিত হচ্ছে।
নদীর গতিপথ প্রকৃতি নির্ধারিত। একে ঘুরিয়ে দেয়া যে কতবড় নির্বুদ্ধিতা সেটা প্রমাণিত হয়েছে সম্প্রতি বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে। তিনি বিহারের সমস্যার জন্য ফারাক্কা বাঁধকে দায়ী করেছেন। ফারাক্কা বাঁধের অসারতা নিয়ে আগেও আলাপ-আলোচনা হয়েছে, তাতে কান দেয়নি ভারত সরকার। তারা প্রয়োজনের কথা বলে আসছে। আসলে প্রয়োজন বিষয়টি আপনাতেই নির্ধারিত হয়ে আছে। যে অঞ্চলে নদীর প্রয়োজন সেখানেই নদ-নদী রয়েছে। অন্য বিবেচনায় বলা যায়, জনসংখ্যা, প্রকৃতি, মানুষের কৃষ্টি-কলচার, কৃষি সব মিলে পানির এটা বর্তমান এবং সুদূর প্রসারী চাহিদার ব্যাপার রয়েছে। এটি নির্ধারণ করতে হলে নিরপেক্ষ কর্তৃপক্ষের প্রয়োজন। দু’দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠক করার পরও তিস্তার পানি বণ্টনের কোন সমাধান করা যায়নি। একথা অস্বীকার করা যাবে না সমঝোতার জন্য উদার মন-মানসিকতার প্রয়োজন হয়। এখানে সংকীর্ণতার কোন স্থান নেই। প্রধানমন্ত্রী পানি নিরাপত্তার বিষয়টি আঞ্চলিক মহলে উপস্থাপন করেছেন এ জন্য তাকে ধন্যবাদ। প্রকৃত বিবেচনায় বাংলাদেশের জনগণ পানি সমস্যার স্থায়ী সমাধান আশা করে। সেটা করা গেলেই এ সম্মেলন সফল হয়েছে বলা যাবে, অন্যথায় এসব কেবল কথার কথা বলেই বিবেচিত হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন