অদ্ভুত উটের পিঠে চড়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ। শুধু শাহবাজ শরীফ বলবো কেন, তার দল পাকিস্তান মুসলিম লীগও (নওয়াজ) এই উটের পিঠে চড়েছে। রাষ্ট্র ক্ষমতা সেই নেতা বা সেই দলই গ্রহণ করতে পারে যাদের ক্ষমতার ভিত্তি থাকে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতার প্রধান ভিত্তি হলো জনসাধারণ। তাই ক্ষমতা গ্রহণ করতে গেলে সেই দল বা ব্যক্তির থাকতে হয় জনসমর্থন বা জনভিত্তি। নওয়াজ পন্থী মুসলিম লীগের ক্ষমতার প্রধান ভিত্তি ছিল পাঞ্জাব। শাহবাজ শরীফ একাধিক বার পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। গত ৩ এপ্রিল অনাস্থা ভোটে পরাজিত হলে পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফের (পিটিআই) প্রধান ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীত্বের পদ হারান। সেই স্থান পূরণ করেন মুসলিম লীগের শাহবাজ শরীফ। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারে ইমরান খানের পিটিআইয়ের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। কিন্তু মুসলিম লীগ (নওয়াজ), পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি), মওলানা ফজলুর রহমানের জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এবং করাচি ভিত্তিক মহাজিরদের সংগঠন মুত্তাহিদা কওমে মজলিশের (এমকিউএম) সম্মিলিত কোয়ালিশনের মাধ্যমে ইমরান খান পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারান। আর এই ৪/৫টি দলের কোয়ালিশনের নেতা হন মুসলিম লীগ নেতা শাহবাজ শরীফ।
এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো যে, মুসলিম লীগের একচ্ছত্র নেতা হলেন নওয়াজ শরীফ। তিনি একাধিকবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। সর্বশেষ, প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হয়। পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আদালত, অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্ট তাকে দুর্নীতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে। সুপ্রিম কোর্ট তাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্তের নির্দেশ দেয়। তদনুযায়ী নওয়াজ শরীফ বরখাস্ত হন এবং কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। এরপর নির্বাচন হয় এবং একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে (নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নয়) ইমরান খান প্রধানমন্ত্রীর আসনে সমাসীন হন। ইমরান খান যখন প্রধানমন্ত্রী, নওয়াজ শরীফ তখন জেলে। জেলে তিনি অসুস্থ হন এবং বিদেশে চিকিৎসার আবেদন করেন। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সেই আবেদন মঞ্জুর করেন এবং দোষী ও আটক হিসাবে নওয়াজ শরীফ লন্ডন গমন করেন। সেই থেকে তিনি লন্ডনেই অবস্থান করছেন। তার সাজা মওকুফ হয়নি।
শাহবাজ শরীফ নওয়াজ শরীফের আপন ছোট ভাই। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি তার পুত্র হামজা শরীফকে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী করেন। আর এদিকে তার কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় নওয়াজ শরীফের কন্যা মরিয়ম নওয়াজকে মন্ত্রিসভার সদস্য নিযুক্ত করেন। এতদিন পর্যন্ত সকলের ধারণা ছিল যে, পাঞ্জাবই নওয়াজ শরীফ তথা শাহবাজ শরীফের ক্ষমতার ঘাঁটি। কিন্তু পাঞ্জাব অর্থাৎ মুসলিম লীগের ক্ষমতার সেই দূর্গ চুরমার হয়েছে। কয়েক দিন আগে পাঞ্জাব অ্যাসেম্বলির ২০টি আসনে উপ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই ২০টি আসনের মধ্যে ১৫টি আসনে জয়লাভ করেন ইমরানের পিটিআইয়ের ক্যান্ডিডেট। মুসলিম লীগ পায় মাত্র ৪টি আসন। একজন নির্বাচিত হন স্বতন্ত্র সদস্য হিসাবে। এই উপ নির্বাচনের পর মুসলিম লীগের একমাত্র ঘাঁটি পাঞ্জাবও চুরমার হয়ে গেছে। তাহলে মুসলিম লীগের বর্তমান ক্ষমতার ভিত্তি কী? এসম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভের জন্য আমরা পাকিস্তানের চারটি প্রদেশের অবস্থা নিয়ে আলোচনা করছি।
প্রথমে পাঞ্জাব। এখানে একটি কথা বলে রাখা দরকার যে, ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের পূর্বে পাঞ্জাব এক ও অখন্ড ছিল। বৃটিশ বড়লাট লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের পার্টিশন প্ল্যান মোতাবেক পাঞ্জাব বিভক্ত হয়। এক ভাগ যায় ভারতের ভাগে। আরেক ভাগ আসে পাকিস্তানের ভাগে। পার্টিশন প্ল্যান ছিল এই যে, ভারতের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলি নিয়ে গঠিত হবে পাকিস্তান। আর হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে গঠিত হবে ভারত। পাঞ্জাব অনেক বড় একটি প্রদেশ। হিন্দুদের সংখ্যা তেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না। তখন শিখ এবং হিন্দুরা এক হয়ে ভারতে থাকতে চায়। সেই অনুযায়ী ভারতের অংশে পড়ে যে পাঞ্জাব সেটির নাম হয় পূর্ব পাঞ্জাব। আর পাকিস্তানের অংশে পড়ে যে পাঞ্জাব তার নাম হয় পশ্চিম পাঞ্জাব। এখন অবশ্য ভারতীয়রাও তাদের অংশকে পাঞ্জাব বলে। আর পাকিস্তানীরাও তাদের অংশকে পাঞ্জাব বলে। ‘পূর্ব’ ও ‘পশ্চিম’ বলে কোনো কথা নাই। ভারতীয় পাঞ্জাবের আয়তন হলো ১৯ হাজার ৪৪৫ বর্গমাইল। বর্তমান জনসংখ্যা ২ কোটি ৭৫ লক্ষ। পক্ষান্তরে পাকিস্তানী পাঞ্জাবের আয়তন হলো ৭৯ হাজার ২৮৪ বর্গমাইল। লোক সংখ্যা ১১ কোটি ২৪ লক্ষ।
॥দুই॥
পাকিস্তানের চারটি প্রদেশের মধ্যে পাঞ্জাব জনসংখ্যার দিক দিয়ে বৃহত্তম। ভৌগোলিক আয়তনের দিক দিয়ে বৃহত্তম হলো বেলুচিস্তান। কিন্তু বেলুচিস্তানের জনসংখ্যা খুব কম। মাত্র ১ কোটি ২৩ লাখ ৩৫ হাজার। পক্ষান্তরে পাঞ্জাবের জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশি। পাঞ্জাবের জনসংখ্যা এবং আয়তন একটু আগেই উল্লেখ করেছি। জনসংখ্যা এবং ভৌগোলিক আয়তনের কারণে পাঞ্জাব পাকিস্তানে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং ক্ষমতাধর প্রদেশ। এই গুরুত্বের বিবেচনায় নওয়াজ শরীফ এবং তারপর তার ভাই শাহবাজ শরীফ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন।
৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বিদায় নেওয়ার পর ইমরান খান পাকিস্তানের সবকটি প্রদেশের প্রায় সব কটি বড় বড় জেলায় জনসভা করেন। উর্দূতে জনসভাকে বলা হয় জলসা। আমি প্রায় সবকটি জনসভার ভিডিও দেখেছি। আমি বিস্মিত হয়েছি, প্রতিটি জনসভায় বিপুল সংখ্যক লোকের হাজিরা দেখে। প্রতিটি জনসভায় লক্ষ লক্ষ লোকের সমাবেশ। এই রকম অন্তত ১২টি জনসভার লাইভ ভিডিও আমি দেখেছি। লাহোর পাঞ্জাবের রাজধানী। আমার খটকা ছিল যে, ইমরানের লাহোরের জনসভা হয়তো তত বড় হবে না। কিন্তু আমি হতভম্ব হয়ে গেছি, যখন দেখলাম যে ইমরানের লাহোরের জনসভাই হয়েছে বৃহত্তম। পাঞ্জাবের আরেকটি শহর মুলতান। সেখানেও ইমরান যে জনসভা করেছেন সেখানেও হয়েছে লাখো জনতার সমাবেশ। সবচেয়ে উল্লেখ করার বিষয় হলো এই যে, কোনো জনসভাতেই বাস বা ট্রাক ভাড়া করে লোক আনা হয়নি। জনসভায় মানুষের উপস্থিতি ছিল স্বতস্ফূর্ত। পদচ্যুত হওয়ার প্রায় ২ মাস পর এসব সভার ভিডিও চিত্র দেখে আমার স্থির বিশ্বাস জন্মে যে, ইমরান খান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সারা পাকিস্তানের সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় তথা জাতীয় নেতা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন তিনি। ২/৩ দিন আগে দেখলাম, ইমরানের একটি উক্তি। তিনি বলেছেন, সারাদেশের লোক রাজপথে নেমে এসেছেন। পাকিস্তানের ২২ কোটি মানুষ একযোগে রাস্তায় নেমে আসার ফলে পাকিস্তান ‘নেশন’ অর্থাৎ একটি জাতি হিসাবে উত্থিত হয়েছে।
এসব জনসভায় ইমরান যে দাবি করেন সেটিও আমাকে অভিভূত করেছে। সবকটি জনসভাতেই তার দাবি ছিল একটিই। আর সেটি হলো, এই সরকার অর্থাৎ শাহবাজের সরকার একটি আমদানী করা সরকার। এদের পেছনে জনসমর্থন নাই। এরা আমেরিকার তল্পীবাহক। সুতরাং তাদেরকে অপসারণ করে জনতার সরকার গঠন করতে হবে। লক্ষ করার বিষয় হলো এই যে, আমরা বাংলাদেশের মানুষ বহু বছর হলো ধারণা করে আসছি যে, পাকিস্তানে মিলিটারিরাই নির্ধারণ করে, কে ক্ষমতায় থাকবে বা কে ক্ষমতায় থাকবে না। আর মিলিটারির পেছনে আমেরিকার মদদ থাকলে তো আর কোনো কথাই নাই। কিন্তু আমি স্তম্ভিত বিস্ময়ে লক্ষ করলাম যে, ক্ষমতা ফেরত পাওয়ার জন্য ইমরান খান আমেরিকা, রাশিয়া, চায়না প্রভৃতি বিদেশি কোনো রাষ্ট্রের নিকট ধরণা দেননি। তাছাড়া ক্ষমতায় ফেরত যাওয়ার জন্য মিলিটারিকেও তিনি কোনো তোষণ করেননি। তিনি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্টের রায়ে অনাস্থা প্রস্তাবে পরাজিত হয়ে। কিন্তু ক্ষমতাচ্যুত হয়ে তিনি চলে গেছেন সর্বোচ্চ আদালত, অর্থাৎ জনতার আদালতে। আগামী আগস্ট মাসে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু ইমরান অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী। তিনি বলেছেন, আগস্ট নয়, তারও আগে নির্বাচন দেওয়া হোক। জনগণ যে দল বা নেতাকে ভোট দেবে তাকেই তিনি মেনে নেবেন।
॥তিন॥
ইমরানের আত্মবিশ্বাস সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। পাঞ্জাবে তিনি ২০টি আসনের মধ্যে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছেন। এখন তার মনোনীত প্রার্থী পারভেজ এলাহী পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী। শাহবাজ শরীফের ছেলে হামজা শরীফ আউট। সেই সাথে আউট নওয়াজ শাহবাজের মুসলিম লীগ। তাহলে পাকিস্তানের কোথায় মুসলিম লীগ ক্ষমতায় আছে? সিন্ধু প্রদেশের আয়তন ৫৪ হাজার ৪০৭ বর্গমাইল। জনসংখ্যা ৪ কোটি ৭৮ লাখ। সেখানে পিপিপির কোয়ালিশন সরকার। সেখানে মুসলিম লীগ নাই।
পাকিস্তানের আরেকটি প্রদেশের নাম হলো খাইবার পাখতুনখোয়া। আগে নাম ছিল উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ। এই প্রদেশটির আয়তন ৩৯ হাজার ২৮২ বর্গমাইল। জনসংখ্যা ৩ কোটি ৫০ লক্ষ। এই প্রদেশের অধিবাসীগণকে বলা হয় পশতুন। তাদের ভাষা হলো পশতু। আমরা বাংলাদেশে এবং ভারতে সীমান্ত প্রদেশ বা খাইবার পাখতুনখোয়ার অধিবাসীগণকে পাঠান বলে থাকি। সীমান্ত প্রদেশের ওধারে আফগানিস্তানের সমগ্র দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলেও পশতুনদের বাস। তারাও পাঠান। পাঞ্জাবীদের তুলনায় তাদের জনসংখ্যা কম হলে কী হবে, পাঠানদের মধ্য থেকে অনেক বিখ্যাত লোক আবির্ভূত হয়েছেন। জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খান, সরদার বাহাদুর খান, খান আবদুল কাইয়ুম খান, ওয়ালি খান, ড. খান সাহেব, খান আব্দুল গাফফার খান, ইমরান খান, ক্রিকেটার শহিদ আফ্রিদী-এরা সকলেই পাঠান। সেই সীমান্ত প্রদেশেও বর্তমানে ইমরান খানের দল, অর্থাৎ পিটিআই বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতাসীন।
বাকি রইল বেলুচিস্তান। এটি ভৌগোলিক দিক দিয়ে পাকিস্তানের বৃহত্তম প্রদেশ। আয়তন ১ কোটি ৩৪ লক্ষ ৫০ বর্গমাইল। জনসংখ্যা মাত্র ১ কোটি ২৩ লক্ষ ৩৫ হাজার। এখানে পিটিআই, মুসলিম লীগ বা পিপিপি কারো সরকার নাই। এখানে ক্ষমতায় আছে একটি স্থানীয় দল। নাম বেলুচিস্তান আওয়ামী পার্টি (ব্যাপ)।
ওপরের এই আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, পাকিস্তানের চারটি প্রদেশের কোনোটিতেই মুসলিম লীগ ক্ষমতায় নাই। তাহলে তারা কেন্দ্রের ক্ষমতায় থাকে কীভাবে? আসলে তারা হয়েছে ঠুঁটো জগন্নাথ। নৈতিকভাবেই বলুন, আর আইনিভাবেই বলুন, শাহবাজ সরকারের ক্ষমতায় থাকার কোনো অধিকার নাই। ক্ষমতায় যদি থাকতেই হয় তাহলে তার উচিৎ হবে অনতিবিলম্বে সাধারণ নির্বাচন দেওয়া। জনগণ যদি তাকে এবং তার দলকে পছন্দ করে তাহলে ইমরানও বলেছেন যে তাকে তারা মেনে নেবেন। নির্ধারিত সময়ের আগে নির্বাচন দেওয়াকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেছে ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ নামক বিখ্যাত মার্কিন দৈনিক। যদি জোর করে বা নেপথ্য ক্ষমতাসীনদের বলে মুসলিম লীগ ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায় তাহলে পাকিস্তানের সর্বনাশ হয়ে যাবে। ১৯৭০ এর নির্বাচনের পর যদি শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করা হতো তাহলে পাকিস্তানের ইতিহাস কীভাবে লেখা হতো সেটি আমরা জানি না। অন্তত এটুকু বলতে পারি যে, আজকের মতো দুই দেশের সম্পর্ক এমন তিক্ত হতো না।
journalist15@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন