শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

থামছে না কিশোর বাইকারদের দাপট বাড়ছে দুর্ঘটনা

কামাল আতাতুর্ক মিসেল | প্রকাশের সময় : ২ আগস্ট, ২০২২, ১২:০১ এএম

শখ-সৌখিনতা ছাপিয়ে বাহন হিসেবে মোটরসাইকেল এখন অনেকেরই নিত্যসঙ্গী। ব্যক্তিগত প্রয়োজন ছাড়াও বর্তমানে বাহনটিকে জীবিকার অবলম্বন হিসেবেও নিয়েছেন অনেকে। তবে বর্তমান সময়ে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিদিন তরুণরা মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে। কিছুতেই যেন থামছে না কিশোর বাইকারদের দাপট। এর পেছনে রয়েছে নিয়ম ভাঙার প্রবণতা আর সঠিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতি।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, গত এপ্রিল মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় সারা দেশে যতো জনের মৃত্যু হয়েছে, এর মধ্যে ৪৪.২৬ শতাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। এ বছরের এপ্রিল মাসে দেশে ৪২৭টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন ৫৪৩ জন ও আহত হয়েছেন ৬১২ জন। এর মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২০৬ জন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৩৭.৯৩ শতাংশই মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহী। এরপর আছেন পথচারী। দুর্ঘটনায় ২১.৩৬ শতাংশ পথচারী নিহত হন। এপ্রিল মাসে প্রতিদিন গড়ে ১৮ জন নিহত হয়েছেন। দুর্ঘটনায় ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষ নিহত হয়েছেন ৭৯.৩৭ শতাংশ।
গতকাল শনিবার চুয়াডাঙ্গায় দুই মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষে দুজন নিহত হয়েছেন। এসময় আহত হয়েছেন আরও দুজন। শনিবার দুপুর ১টার দিকে চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ সড়কের জাফরপুর যুব উন্নয়ন অধিদফতরের সামনে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এর আগে গত শুক্রবার সিরাজগঞ্জ সদরে বাস চাপায় জিসান নামে এক মোটরসাইকেল চালক নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন সিফাত হোসেন নামে আরেক আরোহী। এর আগে গত বৃহস্পতিবার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম এলাকায় ৯ম শ্রেণির দুই ছাত্র মোটরসাইকেল নিয়ে বের হয়ে দুর্ঘটনায় নিহত হন। গত মঙ্গলবার কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের বুড়িচং এলাকায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় এক কিশোর প্রাণ হারায়।
সরেজমিনে দেশের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান পঙ্গু হাসপাতাল, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান হাসপাতালটির জরুরি বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রায় প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে এখানে চিকিৎসা নেন। তাদের বেশিরভাগ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। কেউ চালক, কেউ আরোহী এবং কেউ পথচারী। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবদুল গণি মোল্লা বলেন, প্রতিদিন শুধু রাজধানী নয়, দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে রোগী বেশি আসে। চিকিৎসা নিতে আসাদের ৬৫ শতাংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। এদের মধ্যে অপ্রাপ্ত বয়স্কের সংখ্যাই বেশি।
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার কারণ জানতে চাইলে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, মোটরসাইকেলের চালকদের বড় অংশ কিশোর ও যুবক। এদের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা বেশি। কিশোর-যুবকরা বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালিয়ে নিজেরা দুর্ঘটনায় শিকার হচ্ছে এবং অন্যদেরকে আক্রান্ত করছে। তিনি বলেন, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার একটি বড় অংশ ঘটছে ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, পিকআপ ও বাসের ধাক্কা, চাপা ও মুখোমুখি সংঘর্ষে। এসব দ্রুতগতির চালকদের অধিকাংশই অদক্ষ ও অসুস্থ।
বুয়েটের সড়ক ও দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় শীর্ষে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেহেতু মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার ৭৪ শতাংশ ঘটে মফস্বল এলাকায়। তাই সেখানে ট্রাফিক তদারকি বাড়ানো দরকার। নিয়ন্ত্রণ করা দরকার মোটরসাইকেলের সিসি। কিশোর-তরুণ মোটরসাইকেল চালকদের বিভিন্ন বাইকার্স গ্রুপ আছে। সেখানেও তদারকি বাড়ানো যেতে পারে। এ ব্যাপারে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, হঠাৎ করে বাইক দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার কারণ ২০২০ ও ২০২১ সালের বিভিন্ন মেয়াদে গণপরিবহন বন্ধ ছিল। তখন শুধু স্বল্প দূরত্ব না, দূরপাল্লার যাত্রায়ও মোটরসাইকেল ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু এটা কখনোই কাম্য না। তিনি বলেন, ঢাকা শহরে মোটরসাইকেল চালানো আর মহাসড়কে চালানোর মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। গণপরিবহনের বিকল্প হিসেবে দূরের যাত্রায় এই মোটরসাইকেল ব্যবহারের ফলে দুর্ঘটনা বেড়েছে। তিনি বলেন, এটা নিয়ন্ত্রণের যে পলিসি থাকার কথা, সেখানেও আমরা মনোযোগী হচ্ছি না, রাজস্ব আয়ের কথা বলে অনায়াসে অনিয়ন্ত্রিতভাবে রেজিস্ট্রেশন দিয়ে যাচ্ছি। এর ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, যত বাইক সড়কে চলে, তার বেশির ভাগেরই নিবন্ধন নেই।
এদিকে, পূর্বাঞ্চলীয় হাইওয়ে পুলিশ সুপার মো. রহমত উল্লাহ বলেন, ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকার পরেও অনেকে মোটরসাইকেল কিনছেন। দুই-তিন বছর বাইক চালানোর পর লাইসেন্স করেন। এছাড়া তরুণ বাইকাররা সিগন্যাল মানেন না। প্রযুক্তির ঘাটতি থাকায় মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। যথাযথ হেলমেট না পরা মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর একটি কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, হেলমেটের ব্যবহার করে না, আবার অনেকে হেলমেট ব্যবহার করলেও ফুল ফেস হেলমেট ব্যবহার করে না। এসএসসি পরীক্ষা শেষ করে বাবার কাছ থেকে মোটরসাইকেলের চাবি নিয়ে রাস্তায় নেমে গেছেন। তিনি আরও বলেন, ওভারটেক করতে হলে ডান দিক দিয়ে ওভারটেক করতে হবে। মোটরসাইকেল চালকেরা ওভারটেক করার ক্ষেত্রে ডান-বাম মানেন না।
গবেষকরা বলছেন, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা রোধে ব্যক্তি সচেতনতা জরুরী। জীবনের নিরাপত্তা সবার আগে। তাই মোটরসাইকেল চালানোর সময় সর্তক থাকতে হবে। পাশাপাশি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা রোধে ট্রাফিক আইন যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। লাইসেন্সবিহীন চালকদের আইনের আওতায় আনতে হবে। ১৮ বছরের নিচে কেউ যাতে ড্রাইভিং লাইসেন্স না পায়, সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন