শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

সরকারের প্রতি জনঅসন্তোষ এবং বিএনপির জনবিচ্ছিন্ন রাজনীতি

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ৫ আগস্ট, ২০২২, ১২:০০ এএম

গত সপ্তাহে আমার এক ঘনিষ্ট ব্যক্তির সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপচারিতা হয়। তিনি আওয়ামী লীগের একজন ঘোর সমর্থক। আলাপচারিতার এক পর্যায়ে তিনি আক্ষেপের সুরে বলেন, সরকার এত উন্নয়ন করেছে, অথচ সাধারণ মানুষ সমানে গালিগালাজ করছে। তারা কি উন্নয়ন দেখছে না? মানুষের কী হলো? তাদের মনমানসিকতা এমন কেন? যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, উন্নয়ন করলে কি তার প্রশংসা করবে না? তিনি বলেন, আমি বেশিরভাগ সময় রিকশায় চলাফেরা করি। এই চলাফেরা করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের মুখ থেকে সরকারের যে ধরনের সমালোচনা ও অসন্তোষের কথা শুনি, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আসলে মানুষের চরিত্র নষ্ট হয়ে গেছে। তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম। কোনো মন্তব্য করিনি। এটা বুঝতে পারছিলাম, তিনি তার প্রিয় দলের প্রতি সরল বিশ্বাস এবং আস্থা থেকেই কথাগুলো বলছিলেন। সাধারণ মানুষ কেন সরকারের প্রতি অসন্তুষ্ট, তার গভীর পর্যবেক্ষণে তিনি যেতে পারেননি। আমি তার কথার বাস্তব ব্যাখ্যা দিতে পারতাম, দেইনি। দিলে তার কাছে মনঃপুত হতো না। তার কথা শুনে গেছি। যেকোনো দলের ঘোর সমর্থক দলের নেতিবাচক দিক দেখবে না, সেটাই স্বাভাবিক। তার কাছে তার দলের সব কাজই প্রিয়। অন্ধ ভক্ত হলে যা হয় আরকি! তবে সচেতন সমর্থকরা দলের ভুল-ত্রুটি স্বীকার করেন। এটা করা ঠিক হয়নি, ওটা করলে ভালো হতো, এমন মতামত ব্যক্ত করেন। এটা তাদের আত্মসমালোচনা এবং আত্মপোলব্ধি। অনেকে সরাসরি না বললেও ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে বলেন। কিছুদিন আগে সরকার সমর্থক এক সাংবাদিক আলোচনাকালে অনুচ্চস্বরে বলেন, সরকার উন্নয়ন করেছে ঠিকই, তবে গণতন্ত্রটা যদি ঠিক রাখত, তাহলে ভালো হতো। এক্ষেত্রেও কোনো মন্তব্য করিনি। মন্তব্য করলে আলোচনা আরও বিস্তৃত হতো, তর্ক-বিতর্ক হতো। তার চেয়ে চুপ থেকে তার আত্মপোলব্ধিকে সমর্থন করেছি।

দুই.
সরকারের তিন মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছে। এই তিন মেয়াদের শেষ দুই মেয়াদে সরকার গণতন্ত্রকে সংকুচিত করেছে। পাশ কাটিয়ে গেছে। দেশকে হাইব্রিড গণতন্ত্রের তালিকায় উঠিয়েছে। গণতন্ত্র সংকুচিত করে উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দিয়েছে। গণতন্ত্রকে গুরুত্ব না দিয়ে শুধু উন্নয়নকে প্রাধান্য দিয়েছে। এ নিয়ে যাতে পত্র-পত্রিকা, সচেতন মহল সমালোচনা করতে না পারে, এজন্য সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা, বাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করার পদক্ষেপ নিয়েছে। নতুন আইন-কানুনে বিভিন্ন দমনমূলক ধারা সংযোজিত করে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করেছে। এর ফলে সরকারের সমালোচনাকারিদের কণ্ঠরোধ করা, কিংবা তারা আত্মনিয়ন্ত্রণের খোলসে ঢুকে গেলেও সরকার সমর্থকদের সরকারকে প্রশংসায় ভাসিয়ে দেয়ার দ্বার অবারিত হয়েছে। টেলিভিশন চ্যানেল থেকে শুরু করে পত্র-পত্রিকায় সরকারের প্রশংসা করতে অনেকটা বাধ্য করা হয়েছে। সরকারের উন্নয়ন ছাড়া কোনো কথা নেই। পত্র-পত্রিকা এবং সরকারি দলের লোকজনের মালিকানাধীন টেলিভিশন চ্যানেল ছাড়া বাকিগুলো সেল্ফ সেন্সরশিপ প্রথা অবলম্বন করে চলেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। কেউ এক লাইন লিখতে তিনবার চিন্তা করে। গণতন্ত্র, বাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত করার সমালোচনা সরকার দেশে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও বিদেশে বা বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশ ও সংস্থার মুখ বন্ধ করতে পারেনি। তারা বিভিন্ন সময়ে এসব নিয়ে কথা বলেছে এবং প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এমনকি মানবাধিকার পরিস্থিতির যে চরম অবনতি ঘটেছে, এ নিয়েও বারবার বলেছে। সরকার এসব পাত্তা দেয়নি। উল্টো তিরস্কার করেছে। এই পাত্তা না দেয়ার ফলস্বরূপ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে গত বছর নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এই নিষেধাজ্ঞা সরকারের উত্যুঙ্গ আত্মবিশ্বাস এবং বেতোয়াক্কা মনোভাবে বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করেও নিষেধাজ্ঞা তুলতে পারেনি। বরং যুক্তরাষ্ট্র অবাক হয়েছে, নিষেধাজ্ঞার কারণে সরকারের বিস্ময় প্রকাশ দেখে। বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস স্পষ্ট করেই বলেছেন, আমরা অবাক হয়েছি বাংলাদেশ সরকারের অবাক হওয়া দেখে। কারণ, এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশকে সতর্ক করে আসছে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার বিষয়টি দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। বলার অপেক্ষা রাখে না, গণতন্ত্র, বাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার নিশ্চিত করাই সুশাসন এবং উন্নয়নের অন্যতম প্রধান শর্ত। এগুলো দমিয়ে বা সংকুচিত রেখে যতই উন্নয়ন করা হোক না কেন, তা টেকসই হয় না। তাছাড়া, আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশকে উন্নত বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর কথা শুনতে হয়। তাদের ক্ষমতা এবং প্রভাব-প্রতিপত্তি দ্বারা প্রভাবিত হতে হয়। কারণ, তাদের এবং তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন সংস্থা থেকে আমাদের ঋণ নিতে হয়। ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে নির্ভর করতে হয়। এছাড়া এগিয়ে যাওয়া কঠিন। সরকার এসব বিষয় খুব একটা আমলে না নিয়ে অনেকটা জেদের বশে নিজেই বড়লোক হবো, এমন মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পথ ধরায় বিপত্তি বেঁধেছে। তাছাড়া, প্রভাবশালী দেশ ও সংস্থাগুলো যেসব বিষয় নিয়ে কথা বলেছে, সেগুলো তো আমাদের দেশের মানুষের মতের সঙ্গে মিল রয়েছে। যদি এমন হতো, তারা এগুলো চায় না, তাহলে একটা কথা থাকত। গণতন্ত্র, সুশাসন, মানবাধিকার, বাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অবারিত করার ক্ষেত্রে তো কারো দ্বিমত নেই। আমাদের স্বাধীনতার মূল অনুরণন তো এগুলোই। এগুলো দাবিয়ে রেখে শুধু উন্নয়নের তত্ত্ব দেশের মানুষ মানবে কেন? বিশ্বগ্রামে বসবাস করে এসব মৌলিক বিষয় উপেক্ষা করলে তো যে কেউ এ নিয়ে কথা বলবে। ক্ষমতাধর দেশগুলো প্রভাব খাটাবে। কারণ, আমরা তাদের দেশের মতো অর্থনীতি, সমরনীতি থেকে শুরু করে বিশ্ব রাজনীতির নিয়ামক শক্তিতে পরিণত হইনি। আমরা পারমাণবিক শক্তিধর দেশও নই এবং সেই সক্ষমতাও আমাদের নেই। কাজেই, উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা আমাদের লাগবে, এ বাস্তবতা অস্বীকার কারার উপায় নেই। অনেক উন্নত দেশ যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশ্ব মোড়লের ধামাধরা, সে তুলনায় আমরা তো অনেক পিছিয়ে। আমাদের দেশের মানুষ যথেষ্ট সচেতন ও বুঝদার। তারা গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক মুক্তি, স্বাধীকার নিয়ে লড়াই করেছে। লড়াই করে স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়েছে। তারা কম গণতন্ত্র, বেশি উন্নয়ন, এমন তত্ত্ব মানতে নারাজ। যদি মানত এবং না বুঝত, তাহলে আইয়ুব খান এবং এরশাদের স্বৈরশাসন টিকে থাকত। সরকার অনেকটা সেই পথ ধরে এগিয়েছে। এ কারণে, কেউ কেউ আড়ালে-আবডালে সরকারকে ‘কর্তৃত্ববাদী’ হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে। গত ১৯ জুলাই ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছে। আমাদের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার যদি ঠিক থাকত, তাহলে ইইউ কেন এ কথা বলবে? নিশ্চয়ই এর ব্যত্যয় ঘটেছে বলেই বলছে। নিবন্ধের শুরুতে যে আওয়ামী লীগ সমর্থকের কথা উল্লেখ করেছি, তার কথার জবাব হয়তো এতক্ষণে কিছুটা হলেও পাওয়া গেছে। এত উন্নয়ন জনগণ দেখছে না কেন? তার এ কথার জবাব আরও স্পষ্ট হবে শ্রীলঙ্কার উদাহরণ দিলে। শ্রীলঙ্কার রাজাপাকসে সরকারও বড় বড় মেগাপ্রকল্প নিয়ে উন্নয়নের বিলবোর্ড জনগণের সামনে তুলে ধরেছিল। এর আড়ালে এন্তার দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থপাচার আর ঋণ নিয়ে দেশটিকে দেউলিয়া করে দিয়েছে। জনগণ খাওয়ার অভাব, শিক্ষার্থীদের স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়া, জ্বালানি সংকট থেকে শুরু করে চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। অথচ, রাজাপাকসে তামিল বিদ্রোহীদের দমন করে জনগণের বিপুল সমর্থন নিয়েই ক্ষমতায় এসেছিল। শ্রীলঙ্কার জিডিপি এবং মাথাপিছু আয়ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বেশি ছিল। সেই দেশটি এভাবে দেউলিয়া হয়ে যাবে, তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। এটা হয়েছে, রাজাপাকসের উন্নয়ন তত্ত্বের আড়ালে সুশাসনের অভাব এবং বেশুমার দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণে। যার কুফল জনগণকে ভুগতে হয়েছে এবং তারা অসন্তুষ্ট হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে। সরকার পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শ্রীলঙ্কায় যে ঘটনা ঘটেছে, এ ধরনের সিম্পটম বা আলামত মৃদু হলেও আমাদের দেশে রয়েছে। এই আলামতের কারণে নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী, সাধারণ মানুষের জীবনযাপনে টানাপড়েন, দরিদ্রতার হার বেড়ে যাওয়া, বেকারত্ব হু হু করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারের উন্নয়নের ফানুসের বাতাস ধীরে ধীরে বের হতে শুরু করেছে। একসময় তা চুপসে যেতে পারে। এসব কারণেই মানুষের মধ্যে অসন্তোষ, যাকে বলে জনঅসন্তোষ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঐ সমর্থকের কথা অনুযায়ী সরকারকে ‘গালাগাল’ দিচ্ছে।

তিন.
দেশে উদ্ভুত পরিস্থিতি ও জনঅসন্তোষ সৃষ্টি হওয়ায় বৃহত্তম রাজনৈতিক বিরোধীদল হিসেবে বিএনপি’র খুশি হওয়া স্বাভাবিক। আমাদের দেশে সরকার বিপাকে থাকলে বিরোধীদলের জন্য তা আনন্দের খবর। সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষ বিরূপ হওয়ার অর্থ হচ্ছে, তাদের সমর্থন বিরোধীদলের দিকে ঝুঁকে পড়া। তারা সরকার পরিবর্তন এবং বিরোধীদলকে সমর্থন দিয়ে ক্ষমতায় বসানোর চিন্তা করে। উন্নত বিশ্ব থেকে শুরু করে সব গণতান্ত্রিক দেশেই এই পালাবদলের ঘটনা ঘটে। সেক্ষেত্রে সরকারের প্রতি জনগণ কেন অসন্তুষ্ট তা সূক্ষ্মভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে তা সমাধান ও অধিকতর জনকল্যাণে বিরোধীদলকে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ও লক্ষ্য স্থির করতে হয়। সরকারের প্রতি জনঅসন্তোষকে পুঁজি করে তাদের যাতে জনগণ নির্বাচিত বা ক্ষমতায় যেতে সমর্থন দেয়, তার বাস্তব সম্মত ও জনতুষ্টকারি এজেন্ডা তুলে ধরতে হয়। জনগণের সামনে যদি এ আশা-ভরসা না থাকে, তাহলে তারা সরকারের পরিবর্তে কাকে সমর্থন দেবে? তাদের সামনে তো এমন কাউকে থাকতে হবে, যারা তাদের চলমান সমস্যা নিরসন করে সুখে রাখতে পারবে? বিএনপি কি সেই দল, যাকে জনগণ ভরসা করে ক্ষমতায় যেতে সমর্থন দেবে? দলটির চলমান রাজনীতিতে কি জনগণকে সুখে রাখার কোনো এজেন্ডা আছে? ক্ষমতায় গিয়ে দলটি দেশ ও জনগণের কল্যাণে কী করবে, এ কথা কি বলছে? বলছে না। বরং দলটি মনে করছে, সরকার বিপাকে আছে, তার পতন অনিবার্য, কাজেই জনগণ তাকে কোলে করে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে। যদি এমন মনে করে থাকে, তাহলে দলটির ক্ষমতায় যাওয়া দূরে থাক, কপালে দুর্গতি ছাড়া কিছু নেই। বলার অপেক্ষা রাখে না, সরকারের প্রতি সৃষ্ট জনঅসন্তোষ, তার জন্য সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় গেলে দলটি জনগণের জন্য কী করবে, এমন পরিকল্পনা তুলে ধরে তাদের সমর্থন আরও জোরালো করে তুলতে পারে। বিএনপি কি এ কাজটি করছে? দলটির নীতিনির্ধারকরা কেন এ চিন্তা ও পরিকল্পনা করছে না? কেবল আন্দোলনের হুংকার আর সরকারের সমালোচনা করলেই কি তারা ক্ষমতায় যেতে পারবে? ধরে নেয়া যাক, সরকার সরে গেল। বিএনপি’র দাবি মোতাবেক নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিল। তাতেই কি জনগণ বিএনপিকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে? আর আওয়ামী লীগকে ডুবিয়ে দেবে? জনগণ কি এতই বোকা? বরং তখন দুই দলকে সামনে রেখে তারা বিচার করবে। আওয়ামী লীগ কী করেছে আর বিএনপি তাদের জন্য কী করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তা মাপার জন্য পাল্লা-পাথর নিয়ে বসবে। এ বিচার যদি করতে বসে তখন তাদের সামনে আওয়ামী লীগের কাজ করার তালিকা থাকবে। হিসাব করবে সে এটা-ওটা করেছে। বিএনপি’র হিসাব করতে গেলে তাদের সামনে কি কোনো কিছু থাকবে? তারা কেবল শূন্যতাই দেখবে। যদি এমন হতো, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তাদের কল্যাণে কী কী করবে তার ফিরিস্তি তাদের সামনে থাকত, তাহলে তারা তা হিসাব করত। এ হিসাব করার কোনো কিছুই যদি জনগণের সামনে না থাকে, তাহলে তারা কি এমনি এমনি দলটিকে সমর্থন দিয়ে ক্ষমতায় বসাবে? জনগণের সামনে লক্ষ্য না থাকলে কিংবা তাদের লক্ষ্য স্থির করে না দিলে তারা কি অন্ধকারে পা বাড়াবে বা ঢিল ছুঁড়বে? তা করবে না। কারণ, পাগলও তার বুঝ ভালো বোঝে। আর জনগণ তো আরও বেশি বুঝবে। তারা যে আওয়ামী লীগের প্রতি অসন্তুষ্ট, তা কি এমনিতেই হয়েছে? হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকার যে একেবারে উন্নতি করেনি, তা কোনোভাবেই বলা যাবে না। তারপরও তার প্রতি জনঅসন্তোষ সুশাসন, মানবাধিকার, মত ও বাক স্বাধীনতা ইত্যাদি বিষয় নিশ্চিত করতে না পারা এবং এর সাথে যুক্ত হয়েছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, দুর্নীতি, অর্থ পাচারের ঘটনা। যেকোনো দেশে একটি ঘটনাই গণতান্ত্রিক সরকারের গদি উল্টে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। স্বৈরশাসকের বিদায়ের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। যুক্তরাজ্যের মতো গণতান্ত্রিক দেশে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি একটু খারাপ হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে স্বেচ্ছায় বিদায় নিতে হয়েছে। আমাদের মতো দেশে এক ডা. মিলন হত্যার ঘটনায় এরশাদ সরকারের পতন ঘটেছে। মাগুরার বিতর্কিত নির্বাচনের ঘটনায় বিএনপিকেও বিদায় নিতে হয়েছে। আর বর্তমান সরকারের আমলে এতসব ইস্যু এবং জনঅসন্তোষের ঘটনা, যা দেশে-বিদেশে প্রবলভাবে সমালোচিত, তা বিএনপি ক্যাশ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ কারণেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রায়ই বিএনপিকে কটাক্ষ করে বলে থাকেন, বিএনপি’র আন্দোলন আষাঢ়ে তর্জন-গর্জন সার, দিবাস্বপ্ন কিংবা তার দাবী মামার বাড়ির আবদার। গত শনিবারও তিরস্কার করে বলেছেন, যারা দলের প্রধান নেত্রীকে মুক্ত করতে পারে না, তারা নাকি সরকার পতন ঘটাবে! এ কথাও বলেছেন, বিএনপি’র নেতারা বলেছেন জনগণ জেগে উঠেছে, আর তারা জেগে জেগে ঘুমায়। তার এ কথা যৌক্তিক। কারণ, জনগণ জাগলেও বিএনপি’র নেতৃবৃন্দ জেগে উঠে না কিংবা জনগণের জেগে উঠাকে কাজে লাগায় না। তারা হয়তো এ অপেক্ষায় আছেন, তাদের আন্দোলন করা লাগবে না, শ্রীলঙ্কার মতো জনগণ দলে দলে ছুটে এসে সরকারের পতন ঘটিয়ে দেবে। ওবায়দুল কাদেরের কথাই সঠিক। এটা তাদের ‘দিবাস্বপ্ন’ ছাড়া কিছু নয়।

চার.
বাস্তবতা হচ্ছে, সরকার দেশে এবং বিদেশে যথেষ্ট চাপের মধ্যে রয়েছে। বিরোধীদলের জন্য এমন অনুকূল পরিবেশ বিগত এক দশকে সৃষ্টি হতে দেখা যায়নি। এ সুযোগে তারা জনগণের চলমান সমস্যা নিয়ে সমালোচনা বা রাজনীতির পাশাপাশি জনগণ যেসব কারণে সরকারের ওপর অসন্তুষ্ট, ক্ষমতায় গিয়ে তা কীভাবে নিরসন এবং আরও অধিক কল্যাণকর কী করবে, এমন এজেন্ডা তুলে ধরতে পারে। এ কাজটি বিএনপি নেতৃবৃন্দ করতে ব্যর্থতার পরিচায় দিচ্ছে। তাদের রাজনীতিতে জনকল্যাণমূলক কোনো দিকনির্দেশনা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। সরকারের দায়িত্ব পালন করা এবং বৃহত্তম বিরোধীদল হওয়া সত্ত্বেও বিএনপি’র এ ব্যর্থতায় জনগণের মধ্যে হতাশা বিরাজ করা স্বাভাবিক। তারা না পারছে, সরকারের নানা ব্যর্থতা সইতে, না পারছে বিএনপি’র ওপর নির্ভর করতে। বিএনপি যদি ক্ষমতায় যেতে চায়, তাহলে তাকে জনগণের এই পরিস্থিতি অনুধাবন করতে হবে। জনসম্পৃক্ততা বাড়িয়ে জনকল্যাণকর ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করতে হবে, যাতে জনগণ তার ওপর আস্থা রাখতে পারে।

darpan.journalist@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন