মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

সারের মূল্যবৃদ্ধিতে উৎপাদন কমার শঙ্কা

# খরচ বেড়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তায় কৃষক # বিশেষজ্ঞদের অভিমত খাদ্যঘাটতিতে পড়তে পারে দেশ # দাম কমানোর দাবি বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের

রফিক মুহাম্মদ | প্রকাশের সময় : ৬ আগস্ট, ২০২২, ১২:০৩ এএম

ইউরিয়া সারের মূল্য কেজি প্রতি ৬ টাকা বৃদ্ধিতে কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এটি কৃষির জন্য একটি অশনিসংকেত। এর ফলে দেশে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। হঠাৎ করে সারের দাম বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত দেশের কৃষকের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ এর অবস্থা। এমনিতেই দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে কৃষক সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। ধার-দেনা করে সংসার চলাতে হচ্ছে। এ অবস্থায় এবার সারের মূল্যবৃদ্ধিতে কৃষকের মাথায় হাত। এমনিতেই তেল ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে বেড়েছে জমি তৈরী ও সেচের খরচ। তার সঙ্গে সারের এই মূল্যবৃদ্ধি কৃষকদের দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। ইউরিয়ার মূল্যবৃদ্ধির কারণে উৎপাদন খরচ বাড়বে, ব্যাহত হবে খাদ্য উৎপাদন। সেই সাথে খাদ্যপণ্যের দাম আরও বাড়বে।
গত কয়েক বছর দেশে কৃষি উৎপাদনে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে। এ সাফল্যের পেছনে পর্যাপ্ত ভর্তুকি দিয়ে কৃষকদের কম দামে সার সরবরাহ করায় উৎপাদনে এমন সাফল্য বলেই কৃষকরা মনে করেন। কৃষকদের অসুবিধার কথা ভেবে সরকার এত দিন অভ্যন্তরীণ বাজারে, অর্থাৎ কৃষক পর্যায়ে সারের দাম বাড়ায়নি। যার ফলে একদিকে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে, অন্যদিকে কৃষক সরাসরি আর্থিকভাবে উপকৃত হয়েছেন। তবে সারের মূল্যবৃদ্ধি করার ফলে এবার কৃষক সে সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে।
ময়মনসিংহের গৌরীপুরের কৃষক আব্দুল হালিম বলেন, সারের দাম বাড়ানোর ফলে জমিতে উৎপাদন কমে যেতে পারে। কেননা আগে যে জমিতে ২০ কেজি ইউরিয়া সার দিয়ে ধান ফলানো হতো দাম বেড়ে যাওয়ায় সে জমিতে এখন ১৫ কেজি সার দিতে হবে। এর ফলে ফলনও আগের চেয়ে কম হবে। শুধু ধান নয় অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রেও এমনটি হতে পারে। যদি ফলন বাড়াতে হয় তাহলে সারের পরিমাণও বৃদ্ধি করতে হবে। এতে উৎপাদন খরচ আগের চেয়ে অনেক বেড়ে যাবে। অনেক কৃষক এ খরচ জোগার করতে পারবে না। এ জন্য কম সার দিয়েই অনেকে ফসল ফলাতে চেষ্টা করবে। এর ফলে ফসলের উৎপাদনও কম হবে।
আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাবের ফলে এমনিতেই অসময়ের বন্যায় গত মৌসুমে হাওর অঞ্চলের বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষতি করে। বর্তমানে আউশ ও আমন ধান রোপণের ভরা মৌসুম চলছে। কিন্তু ভরা বষায়ও চলছে খরা। ্এতে রোপনেও ব্যাঘাত ঘটছে। লক্ষমাত্রার অর্ধেক জমিতেও এখনও আমন রোপন করা সম্ভব হয়নি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাব মতে, দেশে ৫৯ লাখ হেক্টরেরও বেশি জমিতে রোপা আমন ধান চাষ হয়। সে হিসাবে এখনও ৩০ লাখ হেক্টরের বেশি জমিতে আমন রোপন করা বাকি আছে। এসব জমিতে চাষ করতে কৃষকের খরচ অনেক বেড়ে যাবে। ইউরিয়া সারের দাম কেজিতে ছয় টাকা বাড়ায় শুধু চলতি আমন চাষই নয় আগামী বোরো মৌসুমেও কৃষকের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাবে। এতে চালসহ কৃষিপণ্য এবং কৃষিভিত্তিক শিল্পপণ্যের দাম বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন কৃষি অর্থনীতিবিদরা। এ ছাড়া উৎপাদন কমে যাওয়ার পাশাপাশি চালের আমদানিনির্ভরতা বাড়তে পারে বলেও আশঙ্কা তাদের।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের সাবেক সদস্য পরিচালক কৃষিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান ইনকিলাবকে বলেন, ইউরিয়া সারের মূল্যবৃদ্ধি উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়বে। চলতি আমন মৌসুমে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকরা খরচ ঠিক রাখার জন্য জমিতে সার ব্যবহার কমিয়ে দেবে। একই সঙ্গে অন্যান্য সারের ব্যবহারও কমিয়ে দেবে। এর ফলে আমন ধানের উৎপাদন বিঘ্নিত হবে। কৃষক নিরুৎসাহী হয়ে আগামী বোরো মৌসুমে আবাদ কমিয়ে দিতে পারেন। এতে বোরো মৌসুমেও ধানের উৎপাদন কমতে পারে। ফলে দুই মৌসুমে উৎপাদন কমার কারণে খাদ্যঘাটতিতে পড়তে পারে দেশ।
তবে ইউরিয়া সারের দাম বৃদ্ধির ফলে উৎপাদনে তেমন প্রভাব পড়বে না বলে দাবি করেছেন কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক। তিনি জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম কমলে দেশেও সারের দাম কমানো হবে।
তবে ইউরিয়া সারের বর্ধিত মূল্য প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। সারের মূল্য বৃদ্ধিতে দেশে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হবে এবং খাদ্য ঘাটতি দেখা দেবে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে রাজনৈতিক দলগুলো সারের দাম কমানোর দাবিতে প্রতিবাদ বিক্ষোভও করেছে। তারা বলেছে বৈশ্বিক মহামারী করোনার অভিঘাতের মধ্যেও কোনো ধরণের বাড়তি প্রণোদনা ছাড়াই দেশের কৃষক সমাজ কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত রেখেছেন। সরকার হঠাৎ করেই ইউরিয়া সারের দাম কেজি প্রতি ছয় টাকা বাড়িয়েছে। এর ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে এবং খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে। ফলে দেশে খাদ্য ঘাটতি দেখা দেবে।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সারের পরিমিত ব্যবহারের লক্ষ্যে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পাওয়ায় দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এটিও বলছে, চাহিদার বিপরীতে বর্তমানে দেশে সব ধরনের সারের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। সারের পর্যাপ্ত মজুত থাকার অর্থ দাঁড়ায়, এখন যে সার বাজারে বা মজুত আছে, তা বাড়তি দামে আমদানি কিংবা উৎপাদিত নয়। তাহলে এ মুহূর্ত থেকে দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নীতিগতভাবে কতটুকু যৌক্তি রাজনৈতিক দলগুলো ক এ প্রশ্নও তুলেছে ।
দেশে গ্যাস সঙ্কটের কারণে ইউরিয়া উৎপাদনকারী যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড প্রায় এক মাস ধরে সার উৎপাদন করতে পারছে না। চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড কোম্পানিও বন্ধ রয়েছে। অন্য কোম্পানিগুলোও নামে মাত্র উৎপাদনে রয়েছে। যে কোন সময় সেগুলোও বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে সার উৎপাদন মারাত্মকভাবে কমে যাবে। এতে কৃষকেরা বেশি দাম দিয়েও যে সময়মতো সার পাবেন, তার নিশ্চয়তা নেই। সারের মূল্যবৃদ্ধি এবং প্রাপ্যতা নিয়ে উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা ভবিষ্যতের ফসল এবং খাদ্য নিরাপত্তার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। এ কারণে বিশেষজ্ঞরা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা করছেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন