শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ে দরকার জনসচেতনতা

ড. মো. আওলাদ হোসেন | প্রকাশের সময় : ৭ আগস্ট, ২০২২, ১২:০৪ এএম

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকটে আন্তর্জাতিক বাজারে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধান উপকরণ গ্যাস ও জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। এ কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বাংলাদেশেও বিদ্যুৎ বিভাগকে বাধ্য হয়ে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। চলমান বৈশ্বিক সংকটের ফলে সৃষ্ট প্ররিস্থিতি মোকাবেলায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি মন্ত্রীদের গাড়ি নিয়ে ছুটাছুটি না করার নির্দেশ দিয়েছেন। সুতরাং জ্বালানি সাশ্রয় করার লক্ষ্যে মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরে বা সংস্থার প্রধান কার্যালয়ে মিটিং করার জন্য ঢাকার বাইরে বা মিটিংস্থল থেকে দূরে অবস্থানরত কর্মকর্তাকে ঢাকায় ডেকে না পাঠিয়ে অফিস পরিচালনায় ভার্চুয়াল মিটিং উৎসাহিত করা প্রয়োাজন।

দৈনিক পত্রিকাসমূহে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, (সূত্র: বাংলাদেশ ইজিবাইক আমদানি ও সরবরাহকারী ব্যবসায়ী সমিতি) বিভাগীয় শহর, জেলা শহর, উপজেলা ও গ্রাম পর্যায়ে প্রায় ১৫ লাখ ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও রিকশা-ভ্যান চলাচল করছে। প্রতিটি ইজিবাইক চলাচলের জন্য ৪-৫টি ১২ ভোল্টের ব্যাটারি প্রয়োজন। এসব ব্যাাটারী চার্জ করতে দৈনিক ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হয়। বিদ্যুতের এই অবৈধ ব্যবহার শুধুমাত্র বেআইনি নয়, রাষ্ট্রের ক্ষতিসাধনও করছে, যা জাতীয় সম্পদ বিদ্যুতের অপচয়। এই অপচযয় রোধে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যথাযথ কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।

সরকারি, বেসরকারি ভবন, অফিস-আদালত, ব্যক্তিগত বাসভবনে যথেচ্ছ বিদ্যুৎ অপচয়ের উদাহরণ রয়েছে। আমি সেদিকে না গিয়ে জাপানের অভিজ্ঞতা থেকে একটি দৃষ্টান্ত দিতে চাই। জাপানে Nagoya University-তে অধ্যয়নকালে Professor Murata একদিন আমাকে বলেছিলেন, Mr. Hossain, electricity is our national property. Please use electricity properly. Don’t misuse. আমি লক্ষ করেছি, বিভাগীয় অধ্যাপক মহোদয়সহ ছাত্র, শিক্ষক সকলেই সবসময়ই নিজ নিজ কক্ষ থেকে বের হওয়ার সময় দরজার ডান পাশে থাকা সুইচটা বন্ধ করে বের হতেন। নামিদামি আবাসিক হোটেলে যেমনি Door Key card ব্যবহার করে বিদ্যুৎ সাশ্রয় করে, ঠিক তেমনিভাবে জাপানের সকল সরকারি-বেসরকারি ভবনের সকল কক্ষ থেকে বের হওয়ার দরজার ভিতর দিকে একটি সুইচ ব্যবহার করে কক্ষের সকল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে বিদ্যুৎ সাশ্রয় করে। আমাদের দেশেও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা সংশোধন করে ভবনের নকশায় তেমনি সুইচ ব্যবহার নিশ্চিত করে বিদ্যুৎ সাশ্রয় করার পদ্ধতি চালু করা যায়।

একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা জ্বালানি সাশ্রয়ে রাস্তায় গাড়ির গতি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে। রাস্তায় বের হলেই দেখা যায়, হাজার হাজার গাড়ি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্র্যাফিক জ্যামে আটকা পড়ে আছে। সবগুলো গাড়ির ইঞ্জিন চালু অবস্থায় রাখা হয়েছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র সংযুক্ত গাড়িগুলোতে এসি সিস্টেম চালু করে রাখা হয়েছে, যা জ্বালানির অপচয়। এই অপচয় রোধে রাস্তায় গাড়ির গতি বাড়ানোর ব্যাপারে জরুরি পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। গাড়ির গতিভেদে রাস্তায় লেন নির্দিষ্ট করে দিয়ে কম গতিসম্পন্ন গাড়ি সর্ববামে, বেশি গতি সম্পন্ন গাড়ি ডানে চলাচল করার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। রাস্তায় গাড়ি চলাচলে শৃখলা নিয়ন্ত্রণে অতিরিক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নিয়োগ দেয়া যায়। জাতীয় স্বার্থে প্রয়োজনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সহায়তাও নেয়া যায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, আমাদের নাগরিকদের ‘আমি বিদ্যুৎ ব্যবহার করবো, আমি বিল পরিশোধ করবো’ এমন মানসিকতা পরিহার করতে হবে। বরং এমন মানসিকতা পোষণ করতে হবে যে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি জাতীয় সম্পদ, যা প্রবাসীদের কষ্টার্জিত রেমিটেন্স ও দেশে শ্রমিকের ঘামের বিনিময়ে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি করে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে আমদানি করতে হয়। জাপানসহ পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশ বিদ্যুৎ সাশ্রয় করার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে থাকে। আমি জাপানে অবস্থানকালে দেখেছি, টোকিও শহরে একটি পাঁচ তারকা হোটেলের বিছানার উপরে রাখা একটা বড় কাগজে লেখা রয়েছে: ‘বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। সুতরাং বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হই’। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. মহ. শের আলী বিদ্যুৎ সাশ্রয় নিয়ে আলাপচারিতায় বললেন, দক্ষিণ কোরিয়া সফরকালে তিনি দেখেছেন, লিফটের সামনে লেখা আছে: Burn calories not electricity.

দেশের বিদ্যুৎ বিভাগ লোডশেডিং করছে। কিন্তু জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, সেপ্টেম্বর ২০২২ অতিক্রান্ত হওয়ার পর গরমের প্রভাব কমতে থাকবে, সাথে সাথে বিদ্যুতের সংকটও কমতে থাকবে। এছাড়া আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে কয়লা দিয়ে পরিচালিত রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটে বিদ্যুৎ উৎপাদনে শুরু হবে। পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ শেষ হয়েছে, সঞ্চালন লাইনের কাজ চলছে, ঐ সঞ্চালন লাইন ব্যবহার করে রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লা ব্যবহারে উৎপাদিত ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঢাকায় এনে সংযোগ করা হলে আগামী মার্চ মাস নাগাদ লোডশেডিং কমবে। সেখানে তেল, গ্যাস প্রয়োজন হবে না। কয়লা ব্যবহারে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিয়ে চলমান সংকট মোকাবেলা করতে পারবে বিদ্যুৎ বিভাগ। লোডশেডিং থাকবে না’। চলমান সংকট মোকাবেলায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও পানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়া এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বে সম্ভাব্য খাদ্য সংকট মোকাবেলায় উৎপাদন বাড়ানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নে তৃণমূল পর্যায়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতাদের নিয়ে কর্মীসভা ও গসণসংযোগ কর্মসূচির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে চলমান সংকটের কারণসমূহ ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। সংকট মোকাবেলায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার জন্য জনপ্রতিনিধি, সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিন সাহেবগণ এবং স্কুলের শিক্ষকমন্ডলী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। মসজিদের ইমাম সাহেবের বয়ান (বক্তব্য) এবং ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি শিক্ষকদের নির্দেশনা সামাজিক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে।

লেখক: রাজনীতিবিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক সহকারী একান্ত সচিব

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন