গত শুক্রবার দিবাগত রাতে হঠাৎ করেই সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এই বর্ধিত দাম রাত ১২টা থেকে কার্যকর হয়েছে। ডিজেল, কেরোসিন, অকটেন ও পেট্রোলের দাম গড়ে ৪৭ শতাংশের বেশি বাড়ানো হয়েছে। এক লাফে তেলের দাম এত বাড়ানোর নজির আর নাই। এই দাম বৃদ্ধি রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। ৯ মাস আগে গত বছরের ৪ নভেম্বর দাম বাড়ানো হয়েছিল। জ্বালানি তেলের এই মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষকে প্রচণ্ড আঘাত করেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ও বিপিসিকে লোকসানের হাত থেকে বাঁচাতে দাম বাড়ানো হয়েছে বলে সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে। ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৮০ টাকা থেকে ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা, অকটেন ৮৯ টাকা থেকে ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা এবং পেট্রোল ৮৬ টাকা থেকে ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা করা হয়েছে। জ্বালানি তেলের এই রেকর্ড দাম বৃদ্ধিকে বিশেষজ্ঞরা ‘কল্পনার বাইরে’ বলে অভিহিত করেছেন।
এ কথা ঠিক, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। ডলারের দামও বেড়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় ইউরোপের দেশগুলোতেও জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। উপমহাদেশে ভারত ও পাকিস্তানে তেলের মূল্য বেড়েছে। শ্রীলঙ্কা তো জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় পড়েছে। এ প্রেক্ষিতে, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করা ছাড়া সরকারের হয়তো বিকল্প পথ ছিল না। তবে বিশ্ববাজারে এখন জ্বালানি তেলের দাম কমতির দিকে। এ অবস্থায় দাম এত বাড়ানো কতটা যৌক্তিক হয়েছে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। ক্রাইসিস সময়ে যুক্তরাষ্ট্রও জ্বালানি তেলের দাম ৩ ডলার থেকে ৫ ডলার করেছিল। এখন তা ধাপে ধাপে কমিয়ে চার ডলারের নিচে নামিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সরকার আইএমএফ-এর কাছ থেকে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়ার জন্য তেলের দাম বাড়িয়েছে। কারণ, ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে সংস্থাটির অন্যতম শর্ত, বিভিন্ন খাতের ভর্তুকি কমানো। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম বলেছেন, ‘বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে সরকারকে হয়তো দাম বাড়াতে হতো। তবে একবারে এত বেশি বাড়ানো যু্িক্তসঙ্গত হয়নি। সম্ভবত সরকার জ্বালানি তেলের ওপর থেকে পুরো ভর্তুকি তুলে নিয়েছে। দাম কম বৃদ্ধি করে কিছুটা ভর্তুকি সরকার রাখতে পারত।’ এ মতামতের পাশাপাশি বিশেষজ্ঞরা এ কথাও বলেছেন, বিশ্ববাজারে যখন জ্বালানি তেলের দাম কম ছিল, সে সময় সরকার দাম কমায়নি। বিগত ৮ বছরে বিপিসি প্রায় ৪৮ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। সেই অর্থ গেল কোথায়? লাভের এ অর্থ দিয়ে একটি তহবিল গঠন করলে বর্তমান সংকট মোকাবেলা করতে পারত। তারা বলছেন, প্রতি লিটার জ্বালানি তেল থেকে সরকার ৩০-৩২ শতাংশ ভ্যাট-ট্যাক্স নেয়। এ ভ্যাট-ট্যাক্স কমালে দাম বৃদ্ধির প্রয়োজন হতো না। হঠাৎ করে আকাশ ছোঁয়া দাম বাড়ানোর কোনো যুক্তি নেই। নিত্যপণ্যের লাগামহীন দাম বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষ শোচনীয় অবস্থার মধ্যে রয়েছে। এখন তাদের অবস্থার আরো অবনতি হবে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। পণ্যমূল্য, যাত্রী পরিবহন ভাড়া, কৃষি সেচের ব্যয়, পণ্য উৎপাদন ব্যয়, সবকিছুই বাড়বে। সারের দাম বৃদ্ধির পর তেলের দাম বৃদ্ধিতে কৃষি উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে কৃষকরা মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বে। তারা কৃষি উৎপাদনে নিরুৎসাহী হবে। এতে উৎপাদন কমে খাদ্যনিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলবে। মানুষের পুষ্টি নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে।
আমাদের দেশে কোনো পণ্যের দাম একবার বাড়লে তা কমানোর নজির খুব কম রয়েছে। কমালেও যে হারে বাড়ায়, সে হারে কমাতে দেখা যায় না। যা কমায় তা যৎসামান্য। সয়াবিন তেলে দাম যে হারে বাড়ানো হয়েছিল, সে হারে কমায়নি ব্যবসায়ীরা। এখন যেভাবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে, বিশ্ববাজারে দাম কমে গেলে সেভাবে কমানো হবে তার নিশ্চয়তা কি? সরকারের উচিৎ, তেলের এই দাম বৃদ্ধির ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের যে মূল্য বৃদ্ধি পাবে, তা থেকে সাধারণ মানুষকে কিভাবে রক্ষা করা যায়, এ চিন্তা করা। সরকার ইতোমধ্যে জ্বালানি তেল ও বিদ্যুত সাশ্রয়ের যে নির্দেশনা দিয়েছে, তার ব্যত্যয় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিরাই ঘটাচ্ছে। তাদের বিলাস-বহুল জীবনযাপন বহাল তবিয়তেই রয়ে গেছে। কোনো ক্ষেত্রেই তাদের সাশ্রয়ী হতে দেখা যাচ্ছে না। সরকারের তরফ থেকেই যদি কৃচ্ছ্র সাধনের কোনো বালাই না থাকে, তবে সাশ্রয় হবে কিভাবে? সব দায় কি কেবল সাধারণ মানুষের ওপর চাপিয়ে দিতে হবে এবং তাদের তা মেনে নিতে হবে? সরকারকে আগে নিজের কৃচ্ছ্র সাধন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন