গাজায় নির্বিচারে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। ফিলিস্তিনের গোষ্ঠিগুলোর তরফে ইসরাইলী শহরগুলো লক্ষ্য করে পাল্টা রকেট হামলা চালানো হয়েছে। গত শনিবার ছিল দুই পক্ষের হামলার দ্বিতীয় দিন। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে জানানো হয়েছে, ইসরাইলী বিমান হামলায় গাজায় ইসলামিক জিহাদ গ্রুপের একজন নেতা ও কয়েক জন সদস্যসহ বেসামরিক নাগরিকদের মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে শিশুও আছে। এছাড়া আহত হয়েছে অন্তত ৮০ জন। ওদিকে পশ্চিম তীরে ইসরাইলী বাহিনী অভিযান চালিয়ে কমপক্ষে ১৯ জনকে আটক করেছে। ইসরাইল জানিয়েছে, অভিযানের বিষয়টি আগেই ঠিক করে রাখা ছিল। এ থেকে বুঝা যায়, হামলা ও হত্যাকাণ্ড পরিকল্পিত। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে গাজা সীমান্ত মোটামুটি শান্ত ছিল। তার আগে ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের মধ্যে কয়েক দিনের টানা সংঘর্ষে গাজায় ২৫০ জন এবং ইসরাইলে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল। নতুন করে গাজায় ইসরাইলী হামলা ও বেসামরিক নাগরিক হত্যায় বিভিন্ন দেশ গভীর উদ্বেগ ও তীব্র নিন্দা প্রকাশ করেছে। তারা হামলা-পাল্টা হামলা অবিলম্বে বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে। মাঝে মধ্যেই গাজা ও পশ্চিম তীরে হামলা, বেসামরিক নাগরিক হত্যা, বাড়িঘর, দোকানপাট ও স্থাপনা ধ্বংস আগ্রাসী ইসরাইলের রুটিন কাজে পরিণত হয়েছে। নিয়মিত বিরতিতে একাজটি ইসরাইল বছরের পর বছর ধরে করে আসছে। এর যেন কোনো প্রতিকার নেই। নামকাওয়াস্তে নিন্দা জানানোর মধ্যে দিয়ে দায়িত্ব শেষ করছে বিশ্ব সম্প্রদায়। পৌনে এক শতাব্দী ধরে ফিলিস্তিনীরা ইসরাইলের হামলা, হত্যা, জুলুম, নির্যাতন ও নিপীড়নের ভয়াবহ শিকার। আর কত দিনে তারা স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও শান্তির সাক্ষাৎ পাবে, কে জানে।
এমুহূর্তে যখন গাজায় হামলা ও পশ্চিম তীরে ধরপাকড় চলছে, তখন আগের মতই যুক্তরাষ্ট্র নিরব, ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিশ্চুপ। যেন কোথাও কিছু হয়নি বা হচ্ছে না। অথচ, রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে অস্ত্রসজ্জিত এবং যুদ্ধ প্রলম্বিত করার ক্ষেত্রে এমন কোনো উদ্যোগ-পদক্ষেপ নেই, যা নিচ্ছে না। খ্রিস্টান ও শেতাঙ্গ ইউক্রেনীদের নিরাপত্তা ও আশ্রয় প্রদানে গোটা ইউরোপ উন্মুক্ত ও অপেক্ষমান। ইতোমধ্যে এক কোটি ইউক্রেনীয় বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে। পক্ষান্তরে ফিলিস্তিনী, সিরীয়, লিবীয়, রোহিঙ্গা প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠির কোথাও কোনো জায়গা নেই, আশ্রয় নেই, নিরাপত্তা নেই। কারণ, তারা মুসলমান এবং শ্বেতাঙ্গ নয়। সাম্রাজ্যবাদীদের যোগসাজস ও ষড়যন্ত্রে ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদীদের গুছিয়ে এনে এখানে জড়ো করা হয়েছে। তাদের নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করা হয়েছে। অন্যদিকে ফিলিস্তিনের ‘মাটির সন্তান’ ফিলিস্তিনীদের রাষ্ট্রহীন ও উদ্বাস্ত জনগোষ্ঠিতে পরিণত করা হয়েছে। তাদের জীবন, সম্পদ ও ইজ্জতের এতটুকু নিরাপত্তা নেই। বরাবরই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইসরাইলের পক্ষে। তারা ইসরাইলের রক্ষক। তার বিপদাপদ ও সমস্যা-সংকটে সব সময় পাশে দণ্ডায়মান। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের একটি ‘তত্ত্ব’ সকলেরই জানা। ফিলিস্তিনীদের ইটের জবাবে যখন বিমান বা রকেট হামলায় তাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, বাড়িঘর ধ্বংস করা হয় তখন বলা হয়, আত্মরক্ষার অধিকার ইসরাইলের আছে। এই তত্ত্ব এবারও সামনে আনা হয়েছে। ইসরাইলের হামলাকে সমর্থন করে যুক্তরাষ্ট্রের তরফে তার জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সমন্বয়কারী জিন কিরবি বলেছেন, আত্মরক্ষার জন্য আমরা ইসরাইলের অধিকারকে সমর্থন করি। প্রশ্ন হলো, ইসরাইলের হামলা ও হত্যা কাণ্ড থেকে আত্মরক্ষার অধিকার কি ফিলিস্তিনীদের নেই?
নিজের নিরাপত্তার আশংকা করে রাশিয়া ইউক্রেনে অভিযান চালিয়েছে। নিশ্চয় সেটা তার অধিকার। তা নিন্দনীয় হবে কেন? রুশ অভিযানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন অতিমাত্রায় সোচ্চার। তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিশ্বের অর্থনীতি, জীবনযাত্রা, খাদ্যসংস্থান, পণ্যবিস্তার মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। একই তত্ত্বের বরাতে রাশিয়া অভিযান চালালে দোষের, আর ইসরাইল চালালে দোষের নয় কেন? এক যাত্রায় পৃথক ফল হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা আগাগোড়াই দ্বৈতনীতির চর্চা ও অনুসরণ করে আসছে। ফিলিস্তিনীদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার ও স্বাধীনতার ব্যাপারে তারা মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছে। অথচ, তাদেরই মানবাধিকার ও স্বাধীনতার পক্ষে কখনো কখনো অতিমাত্রায় সরব হতে দেখা যায়। তাদের কায়েমী স্বার্থবাদ, দ্বৈতনীতি, যথেচ্ছাচার এবং সম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদী আচরণ বিশ্বের সকল বিবাদ-বিরোধ, সংকট ও সমস্যার মূল কারণ। বিশ্বশান্তি, নিরাপত্তা উন্নয়ন ও কল্যাণ যদি তাদের আদৌ কাম্য হয়, তাহলে এসব পরিহার করতে হবে। ইসরাইলের আগ্রাসী তৎপরতা রুখে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে ফিলিস্তিনীদের অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। বলা বাহুল্য, মানুষের মানবিক, গণতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক ও সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কাক্সিক্ষত বিশ্ব নির্মাণ সম্ভব। এক্ষেত্রে তাদের ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন