গত শনিবার ছিল হিরোশিমা দিবস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষপ্রান্তে এসে জাপানের হিরোশিমা শহরে প্রথম পারমাণবিক বোমা ফেলে মানব সভ্যতার সবচেয়ে বর্বরতম গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। গত মঙ্গলবার ছিল কারবালা যুদ্ধের মর্মন্তুদ স্মৃতি বিজড়িত পবিত্র আশুরা। এই দুটি দিবসের মাঝখানে ইসরাইল আবারো গাজা উপত্যকায় রক্তক্ষয়ী বিমান হামলা করে অন্তত চল্লিশজন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। আহত করেছে দু’ শতাধিক। তবে ক্রমবর্ধমান পাল্টা রকেট হামলায় বিপর্যস্ত ইসরাইল তিন দিনের মাথায় ইসলামিক জিহাদের সাথে অস্ত্রবিরতি করতে বাধ্য হয়েছে। টার্গেটেড কিলিং মিশনে ফিলিস্তিনিদের হত্যা ও রক্তঝরানো ইসরাইলি বাহিনীর সামরিক কর্মকাণ্ডের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, কানাডাসহ পশ্চিমা অর্থ ও অস্ত্রে বলিয়ান হয়ে ওরা দশকের পর দশক ধরে হত্যা-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৪৮ সালে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের উপর পশ্চিমা প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ইহুদি সশস্ত্র হাগানা মিলিশিয়ারা বর্বর গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে ফিলিস্তিনিদের জমিজমা ও বাড়িঘর জনপদ দখল করে অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে কোনো আরব দেশ কিংবা মুসলিম উম্মাহর কোনো জাতি অবৈধ প্রক্রিয়ায় গঠিত ইসরাইল রাষ্ট্রকে মেনে নিতে পারেনি। উদ্বাস্তু ও বিভিন্ন দেশে আশ্রিত ফিলিস্তিনিরা নিজেদের ভূমি ও দেশ পুনরুদ্ধারে যে শপথ নিয়েছিল তা বংশ পরম্পরায় অব্যাহত আছে। তাদের এই প্রতিজ্ঞা ও প্রত্যাশা ভেঙ্গে দিতেই ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ও সেনাবাহিনী ১৯৪৮ সালের পর থেকে ফিলিস্তিনি তরুণদের হত্যার মিশন চালিয়ে আসছে। বাঙালি কবি সুকান্ত লিখেছিলেন, ‘তিল তিল মরণেও জীবন অসংখ্য, জীবনকে চায় ভালবাসতে’। ফিলিস্তিনের জিহাদি তরুণরা জীবনের মাহাত্ম্যকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে শাহাদাতের মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে ফিলিস্তিনি জাতির সামনে স্বাধীনতার স্বপ্নকে জাগিয়ে রেখেছেন। গত ৭০ বছর ধরে একতরফা যুদ্ধ, সামরিক আগ্রাসন ও নিয়মিত টার্গেট কিলিংয়ে হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে, বছরের পর বছর ধরে গাজা উপত্যকার লাখ লাখ মানুষকে অবরুদ্ধ করে, সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বঞ্চিত রেখেও আল আকসা ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার স্বপ্ন ও প্রতিজ্ঞা থেকে এতটুকুও টলাতে পারেনি। সাম্রাজ্যবাদী নীল নকশায় আরব-ইসরাইল বিরোধ প্রশ্নে আরব বিশ্বের কোনো কোনো দেশ পশ্চিমাদের সাথে হাত মিলিয়ে ফিলিস্তিনিদের অধিকার ও সংগ্রামের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে গোপন চুক্তি করলেও ফিলিস্তিনিরা সে সব চাতুরতা ও বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে সজাগ ও সচেতন থেকে লড়াই অব্যাহত রেখেছে। বিশ্বের সর্বাধুনিক সামরিক ও গোয়েন্দা প্রযুক্তি ও সমরাস্ত্রধারি, ফিলিস্তিনি ও আরবদের রক্তঝরানোর নৈতিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আইডিএফের বিরুদ্ধে পেট্রোডলার সমৃদ্ধ আরবরা হাত গুটিয়ে বসে থাকলেও ফিলিস্তিনের তরুণ-তরুণী, কিশোর থেকে অশীতিপর বৃদ্ধা পর্যন্ত নিজেদের ভূমি পুনরুদ্ধারে ইনতিফাদায় জড়িয়ে আছে। ট্যাংক-কামান, উজিগান-শর্টগানের বিপরীতে ইট-পাথর, গুলতি নিয়ে প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করা ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা এখন ইসরাইলিদের অহংকারের বস্তু আয়রনডোম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ব্যর্থ করে দিয়ে বার বার নতি স্বীকারে বাধ্য করছে। গত দেড় দশকে লেবাননের হেজবুল্লাহ ও ফিলিস্তিনের পর এবার অপেক্ষাকৃত দুর্বল ইসলামিক জিহাদের সাথে অস্ত্র বিরতি ও সমঝোতা চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছে ইসরাইল।
ইসলামিক জিহাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা ভেঙ্গে দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে শুক্রবার রাতে ফিলিস্তিনের গাজায় বিনা উস্কানিতে বিমান হামলা শুরু করে ইসরাইল। ইসলামি জিহাদের কমান্ড কমপ্লেক্স, অস্ত্রাগার ও নেতৃত্ব তাদের টার্গেট বলে উল্লেখ করা হলেও তিনদিনের যুদ্ধে নিহত ২৮ জনের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক। ইসরাইলি সামরিক কর্তৃপক্ষ সাত দিনের মধ্যে ইসলামিক জিহাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা ধ্বংস এবং এর কমান্ডারদের হত্যা অথবা গ্রেফতারের টার্গেট নিয়ে বিমান ও ড্রোন হামলা শুরু করলেও তিন দিনের মাথায় ইসলামিক জিহাদের সব দাবি মেনে নিয়ে যুদ্ধবিরতিতে উপনীত হতে বাধ্য হয়েছে। অন্যদিকে ইসরাইল দাবি করেছে, সে এই তিনদিনেই ইসলামিক জিহাদের শীর্ষ কমান্ডার খালেদ মনসুরসহ সিনিয়র নেতাদের হত্যা করেছে। হত্যা মিশনে ইসরাইলিদের এমন সাফল্যের দাবির পর মিশরের সামরিক শাসক সিসি আল ফাত্তাহ ও কাতারের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির এই সমঝোতা হয়েছে বলে জানা যায়। শনিবার ইরানের ইসলামিক রেভ্যুলুশনারি গার্ডের কমান্ডারের পক্ষ থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনিরা একা নয়, ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাদের পাশে আমরাও আছি। ধারণা করা হচ্ছে, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে হামাস ও হেজবুল্লাহর মতো বড় সামরিক গ্রুপ এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা ছিল। গাজায় ইসরাইলের এই বর্বরোচিত হামলা এবং ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ নেতাদের হত্যার নিন্দা জানিয়ে হামাসের তরফ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই যুদ্ধ ইসরাইলবিরোধী যুদ্ধের রসদ যোগাবে। সাতদিনের অভিযানের কথা থাকলেও রবিবার আইডিএফ ও ইসলামিক জিহাদের মধ্যে যুদ্ধবিরতির ঘোষণাটি ছিল আকস্মিক। যুদ্ধবিরতির পর হাজার হাজার ফিলিস্তিনি গাজা শহরের রাস্তায় ফিলিস্তিনি পতাকা নিয়ে বিজয়োল্লাসে মেতে উঠে। ইসলামিক জিহাদের শত শত রকেট হামলার বেশিরভাগ আয়রনডোমের মাধ্যমে ইন্টারসেপ্ট করার দাবি করা হলেও বেশকিছু রকেট তেল আবিবসহ বিভিন্ন শহরে আঘাত হানতে সক্ষম হয়। এসব হামলায় সামান্য কয়েকজন ইসরাইলি নাগরিক আহত হওয়ার কথা স্বীকার করলেও কেউই নিহত হওয়ার কথা জানা যায়নি। গত বছরের যুদ্ধে হামাসের ছোড়া রকেটে ১৩ ইসরাইলি নাগরিক নিহত ও শতাধিক আহত হওয়ার কথা স্বীকার করেছিল ইসরাইল। রবিবারের যুদ্ধবিরতিকে ফ্রাজাইল বা ভঙ্গুর বলে উল্লেখ করেছে গণমাধ্যমগুলো। তবে সোমবার শেষ খবর পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকলেও ফিলিস্তিনি গ্রুপ এবং ইসরাইলের আইডিএফ উভয়ের পক্ষ থেকে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার হুমকি অব্যাহত ছিল। হামাস, হেজবুল্লাহ, ইসলামিক জিহাদ এবং ইরানের ইসলামিক রেভ্যুলেশনারি গার্ডের সক্রিয় সহযোগিতায় পরিচালিত হামলা প্রতিরোধের ক্ষমতা ইসরাইলের আছে কি না তা নিয়ে সংশয়ের কারণ আছে। এবার অতর্কিত হামলায় ইসলামিক জিহাদের বেশকিছু শীর্ষনেতাকে হত্যা করতে সক্ষম হলেও গত বছর মে মাসে ১১ দিনের যুদ্ধ এবং আগের দেড় দশকে অন্তত তিনবার ইসরাইলের হামলার জবাবে ইসরাইলের অভ্যন্তরে ফিলিস্তিনিদের পাল্টা হামলা এবং ইসরাইলি বাহিনী রণে ভঙ্গ দিয়ে হামাস-হেজবুল্লাহর দাবি মেনে নিয়ে ফিরে যাওয়ার ইতিহাস রয়েছে। ইরানের ইসলামিক রেভ্যুলেশনারি গার্ডের কমান্ডার, মেজর জেনারেল হোসেইন সালামি বলেছেন, এই যুদ্ধাপরাধের জন্য ইসরাইলকে অনেক মূল্য দিতে হবে।
জাতিসংঘের ফিলিস্তিনের অধিকৃত ভূখণ্ড সম্পর্কিত বিশেষ প্রতিনিধি ফ্রান্সেসকা আলবানেজ গাজায় ইসরাইলি বিমান হামলাকে বেআইনী আখ্যা দিয়ে সেখানে যুদ্ধাপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা খতিয়ে দেখতে এ বিষয়ে একটি তদন্ত কার্যক্রম শুরুর আহ্বান জানিয়েছেন। তবে যুদ্ধাপরাধের ঘটনায় ইসরাইলি নেতা এবং আইডিএফ’র বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে নতুন করে অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয়তা নেই। তবে চলমান আগ্রাসন ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো যুক্ত হয়ে ওদের অপরাধের পাল্লা ভারী হয়ে চলেছে। ২০১৪ সালে গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছিল হামাস। সে সময়ও শেষ পর্যন্ত রণে ভঙ্গ দিয়ে যুদ্ধ বিরতিতে বাধ্য হলেও যুদ্ধে মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ ও ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনায় যুদ্ধাপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের নির্দেশে তদন্তে ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধ প্রমাণিত হয়েছিল। আইসিসির সাবেক প্রসিকিউটার, গাম্বিয়ার নাগরিক ফাতু বেনসুদার নেতৃত্বে গঠিত তদন্তে ২০১৪ সালের কনফ্লিক্টে ইসরাইলের আন্তজার্তিক আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন তথা যুদ্ধাপরাধের ঘটনা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে। ইসরাইল আইসিসি’র সদস্য না হওয়ায় এই আদালতের তদন্ত এবং বিচারিক ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও শেষ পর্যন্ত তাদের দাবি প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। তবে দশকের পর দশক ইসরাইলি বর্বরতার পেছনে থাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তিগুলোর সক্রিয় সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা ইসরাইলকে একটি জবাবদিহি মুক্ত সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্রশক্তি হিসেবে টিকিয়ে রেখেছে। ইসরাইলের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধের প্রতিটি ঘটনায় ইসরাইলের উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ও তাদের নেতাদের শাস্তির আওতায় আনার জন্য অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। একইভাবে ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়ায় ন্যাটোসহ পশ্চিমা বাহিনীর যুদ্ধাপরাধের অসংখ্য তথ্য প্রমাণ থাকলেও বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় এসব বিচারের সক্ষমতা বিশ্বসংস্থাগুলোর নেই। চলমান ইউক্রেন যুদ্ধের বাস্তবতায় চীন-রাশিয়া-ইরান-তুরস্কসহ ইউরেশিয়া ও আফ্রিকান শক্তিগুলোর ঐক্য একটি নতুন বিকল্প বিশ্বব্যবস্থাকে সম্ভাব্য করে তুলেছে। অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও গণমাধ্যমের বিশ্বব্যবস্থায় পশ্চিমাদের আধিপত্য একটি বৈষম্যমূলক বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে। এখানে ইউরোপীয়, শ্বেতাঙ্গ বা পশ্চিমা বশংবদ না হলে মানবাধিকারের যেন কোনো মূল্য নেই। রাশিয়ার বিরুদ্ধে যে অভিযোগে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে এবং ইউক্রেনের জন্য শত শত কোটি ডলারের অর্থনৈতিক, সামরিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দেয়া হচ্ছে। ফিলিস্তিনি আরবদের বিরুদ্ধে সেই একই অপরাধ গত ৭০ বছর ধরে করে চলেছে। এ কাজের জন্য শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছর ইসরাইলকে কমপক্ষে তিন বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা দিচ্ছে।
আন্তর্জাতিক কনভেনশন ও বিশ্বসম্প্রদায়ের সব কমিটমেন্ট এবং মানবাধিকারের সব দাবিকে অগ্রাহ্য করে গাজা উপত্যকায় তিরিশ লাখ ফিলিস্তিনির উপর ১৫ বছর ধরে ইসরাইলি অবরোধ চলছে। গাজার সাথে সবগুলো স্থলপথ, নৌপথ এবং আকাশপথ অবরুদ্ধ করে গাজাকে একটি কারাগারে পরিণত করেছে ইসরাইল। গত জুন মাসে আলজাজিরা অনলাইনে প্রকাশিত একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজার ৮ লাখ শিশু-কিশোরের মধ্যে ৬ লাখই মানসিক বিকারগ্রস্ততার শিকার হচ্ছে। জন্মের পর থেকে তারা বার বার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেছে। ওদের পিতামহরা নিজেদের বাস্তুভূমি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার পর পিতৃপুরুষের ভূমি পুনরুদ্ধারের শপথ নিয়েছিল। ওদের পিতারা বার বার রক্তাক্ত আগ্রাসনের মুখেও মাথানত করেনি। নাকবার বিপর্যয় থেকে ইনতিফাদার উত্থানের পেছনে অনেক রক্ত ও ত্যাগের ইতিহাস রয়েছে। নতুন সহস্ত্রাব্দের প্রথম দশকের শুরুতে একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে মুসলিম দেশগুলোর বিরুদ্ধে নজিরবিহীন সন্ত্রাসবাদী সামরিক আগ্রাসন শুরু করে অন্যদিকে জায়নবাদী ইসরাইলি সেনাবাহিনী ফিলিস্তিনিদের সব প্রতিরোধ ক্ষমতা ভেঙ্গে দেয়ার লক্ষ্যে ২০০৮ সাল থেকে ২০২২ সালের এ পর্যন্ত ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে সংঘটিত ৫টি যুদ্ধের সবগুলো ইসরাইল শুরু করলেও কোনো যুদ্ধই শেষ পর্যন্ত একতরফাভাবে শেষ হয়নি। হেজবুল্লাহ, হামাস, ইসলামিক জিহাদ গ্রুপের পাল্টা প্রতিরোধ ও রকেট হামলার মুখে মিশরীয় মধ্যস্থতাকারীদের অস্ত্রবিরতির প্রস্তাব মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে তারা। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের সর্বোচ্চ সহায়তাপুষ্ট জায়নবাদী ইহুদিদের অঢেল সম্পদ ও প্রযুক্তি বলে বলিয়ান ইসরাইলের সাথে বাস্তুচ্যুত, অধিকারবঞ্চিত, ষোল বছর ধরে অবরুদ্ধ গাজাবাসীদের প্রতিরোধ যুদ্ধের কোনো তুলনা চলতে পারে না। ফিলিস্তিন থেকে ছোড়া রকেটগুলোর শতকরা ৯০ ভাগই আয়রনডোম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে ইন্টারসেপ্ট করার দাবি করেছে ইসরাইল। বিধ্বস্ত রকেটের শার্পনেলে কয়েকজন ইসরাইলি আহত হওয়া ছাড়া কোনো মৃত্যুর কথা স্বীকার করেনি। অতর্কিত বিমান হামলার শুরুতেই ইসলামিক জিহাদের বেশ কয়েকজন কমান্ডারকে হত্যা করতে সক্ষম হয় আইডিএফ। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি ইসরাইলের এই অভিযানকে বেআইনী ও অমানবিক বলে আখ্যায়িত করেছে। গত দশকের তিনটি যুদ্ধের প্রতিটিতেই ইসরাইলি বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ উঠেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তরফ থেকে। ইউক্রেনে রাশিয়ান বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো হইচই করলেও গাজা স্ট্রিপে দেড়দশক ধরে ইসরাইলের অবৈধ-অমানবিক অবরোধ, বছরে কয়েকবার বিমান হামলা, ট্যাঙ্ক-ড্রোন নিয়ে হামলা করে ফিলিস্তিনি শিশু হত্যা, শিশুদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দেয়ার দীর্ঘমেয়াদী অমানবিক তৎপরতার বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের রাজতান্ত্রিক দেশগুলোর নিরবতা বিস্ময়কর। কারবালার ময়দানে নবী মোহাম্মদ (সা.) এর দৌহিত্র ইমাম হোসেন (রা.)-এর রক্তের উপর যে ইয়াজিদি শক্তি ও ফিতনার উত্থান ঘটেছিল, সেই শক্তি এখনো মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টিকারী ফিতনা অব্যাহত রেখেছে। এই শক্তি এখন পশ্চিমা পুঁজিবাদী শক্তির দোসর ও জায়নবাদের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। হিরোশিমায় নারকীয় পারমাণবিক বিপর্যয় সৃষ্টির মধ্য দিয়ে যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের উত্থান ঘটেছিল আরব রাজপরিবারগুলো সেই শক্তির বশংবদ শক্তি হিসেবে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে ব্যস্ত রয়েছে। মুসলমানদের প্রথম কিবলা বায়তুল মুকাদ্দাস বা ফিলিস্তিনি শিশুদের রক্তের প্রতি তাদের যেন কোনো দায়বদ্ধতা নেই।
bari_zamal@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন