দেশের পর্যটন রাজধানী কক্সবাজারের আবাসিক কটেজে এবার দুর্বৃত্তদের টর্চারসেলের সন্ধান পাওয়া গেল। শহরের হোটেল-মোটেল জোনে সাইনবোর্ড বিহীন কটেজে পর্যটকদের আটকে রেখে মোটা অংকের টাকা আদায়ের তৎপরতা চালিয়ে আসছে সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র। গত সোমবার রাতে খবর পেয়ে ট্যুরিস্ট পুলিশের অভিযানে অপরাধের সাথে জড়িত ও দালাল সন্দেহে আটক হয় ১১ জন। পুলিশি অভিযানে উদ্ধার হওয়া ৪ জনের কাছ থেকে এমন তথ্য জানা গেছে। সমুদ্রসৈকতে ঘুরতে আসা এবং কক্সবাজারের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে আসা কয়েকজনকে কম খরচে থাকার রুমভাড়া দেয়ার কথা বলে কথিত কটেজে নিয়ে আসার পর সেখানে রাখা মেয়েদের সাথে আপত্তিকর ছবি তুলে তাদের কাছে মুক্তিপণ দাবি করা হয়। তবে পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে মূল অপরাধীরা কটেজের ফটকে তালা দিয়ে পালিয়ে যায় বলে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়। পর্যটন নগরীতে সংঘবদ্ধ অপরাধীদের তৎপরতা, পর্যটকদের নিরাপত্তাহীনতার ঘটনা নতুন কিছু নয়। এ অভিযানের পর সাংবাদিকদের কাছে পুলিশের পক্ষ থেকে দেয়া বিবৃতিতে বলা হয়, পর্যটন নগরীর হোটেল-মোটেল জোনে থাকা দেড়শতাধিক হোটেল-মোটেলের মধ্যে ২০-৩০টি কটেজ রয়েছে সাইনবোর্ড ছাড়া। সাধারণত এসব কটেজেই সংঘবদ্ধ অপরাধীরা টার্গেট করা নিরীহ পর্যটকদের এনে সর্বস্ব লুটে নেয়। দেশের প্রধান পর্যটন কেন্দ্রে বছরের পর বছর ধরে এমন কর্মকাণ্ড কীভাবে চলে তা খুবই দুঃখজনক ও লজ্জাজনক।
পর্যটনশিল্প দেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক খাত। বিশ্বের বহু দেশের প্রধান আয়ের খাত পর্যটনশিল্প। আমাদের প্রতিবেশী দেশ নেপাল, মালদ্বীপ এবং ইন্দোনেশিয়া-মালয়েশিয়াসহ ইউরোপের স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশগুলো জিডিপির উল্লেখযোগ্য আয় করে পর্যটন খাত থেকে। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত, বিশ্বের বৃহত্তম ও বৈচিত্র্যময় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন, একই সৈকতে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার বিরল সুবিধাসম্পন্য সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটা, পুণ্যভূমি সিলেট এবং নয়ানাভিরাম পার্বত্য চট্টগ্রামে লাখ লাখ দেশি-বিদেশি পর্যটন আকর্ষণের মাধ্যমে বছরে কোটি কোটি ডলার আয়ের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো হয়নি। এ জন্য পরিকল্পিত অবকাঠামো উন্নয়ন, যোগাযোগ ও বিনোদন খাতে বিনিয়োগ এবং নিরাপত্তা ও নাগরিক সুযোগ সুবিধার সমন্বিত উদ্যোগ থাকা প্রয়োজন, যা এখনো গ্রহণ করা হয়নি। উপরন্তু অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে স্থানীয় পর্যটকদের সমাগম বাড়লেও নিরাপত্তাহীনতা ও অপরাধমূলক তৎপরতার কারণে এখনো মানুষের মধ্যে আস্থার সংকট রয়েছে। শুধু পর্যটন শিল্পের জন্যই নয়, দেশের মানুষের সাধারণ নিরাপত্তা ও বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন করতে হলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
করোনাকালীন বাস্তবতায় বিশ্বের পর্যটনশিল্প সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। করোনা মহামারির পর সে সব ক্ষতি পুষিয়ে নিতে দেশে দেশে পর্যটনশিল্পে নানা ধরনের রেয়াত ও নতুন নতুন সুযোগ-সুবিধার ঘোষণা দিয়ে পর্যটক আকর্ষণের চেষ্টা দেখা গেছে। কিন্তু বাংলাদেশে দেখা গেছে সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র। করোনার পর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার পর কক্সবাজারে গলাকাটা ব্যবসার চিত্র গণমাধ্যমে উঠে এসেছিল। গত বছর ডিসেম্বরে ঢাকা থেকে সপরিবারে বেড়াতে গিয়ে কক্সবাজারে দুর্বৃত্তদের দ্বারা অপহরণ ও নারী ধর্ষিত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রই শুধু নয়, কক্সবাজারে পুলিশের অপরাধপ্রবণ কতিপয় সদস্যদের দৌরাত্ম্য এক সময় বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। এক ওসি প্রদীপের হাতে ক্রসফায়ারের নামে অসংখ্য মানুষ খুন ও নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। কক্সবাজারে শত শত হোটেল-মোটেল, রেস্তোরাঁয় হাজার হাজার কোটি টাকার বেসরকারি বিনিয়োগ রয়েছে। সমুদ্র সৈকতের পরিবেশ ও পরিচ্ছন্নতায় ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে। এখন আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার পরিকল্পিত ও সুসমন্বিত উন্নয়ন নিশ্চিত করা জরুরি। সেই সাথে কক্সবাজারসহ দেশের সবগুলো পর্যটন স্পট এবং হাইওয়েগুলোতে যান চলাচলে আন্তর্জাতিক মানের শৃঙ্খলা ও গতিশীলতা নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পর্যটন খাত এক নতুন মাত্রা যুক্ত করতে পারে। প্রতিটি জনপদ ও পর্যটন স্পটে মানুষের নিরাপত্তা ও প্রয়োজনীয় নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকাণ্ডে সমন্বয়, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন