বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সাহিত্য

কথা যেন অস্ত্র

নুসরাত জাহান | প্রকাশের সময় : ১২ আগস্ট, ২০২২, ১২:০৩ এএম

সাধারণত যুদ্ধের দামামায়, নিজেকে শৃঙ্খল মুক্ত করার কাজে কিংবা নিজের অধিকার আদায়ে ব্যবহৃত অনত্যম হাতিয়ার হলো অস্ত্র। কিন্তু কথাও কখনো কখনো অস্ত্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এমনকি একটি জাতিকে স্বাধীনতার পথে অগ্রসর করে। শৃঙ্খল মুক্ত হবার জন্য উৎসাহ-উদ্দীপনার বীজ বপন করে দেয় হৃদয়ের মানসপটে। সে কথা হয়ে ওঠে কবিতা, সে কথা হয়ে ওঠে অস্ত্র। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে এমনি এক বিপ্লবী কবিতা কিংবা অস্ত্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া সেই ভাষণ। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ভাষণ। আঠারো মিনিটের সেই বুদ্ধিদীপ্ত কথামালা। যে কথা কানে বাজলে আজও যেকোনো বাংলাদেশির হৃদয়ে শিহরণ জাগে। শিউরে ওঠে গায়ের লোম।
প্রতি মিনিটে গড়ে ৪৮-৫০টি উচ্চারিত এবং সর্বমোট ১১০৮টি শব্দে যেন তিনি রচনা করেছেন একটি জাতির মুক্তির জন্য আকাঙ্ক্ষিত কবিতা। সে সময়ের সেরা অস্ত্র। হয়তো তাই কবি নির্মলেন্দু গুণ তার ‘স্বাধীনতা, এ শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো?গ্ধ -কবিতায় খুব চমৎকার করে তুলে ধরছেন সেদিনের সেই শ্রেষ্ঠ বিকেলের গল্প। বঙ্গবন্ধুকে আখ্যা দিয়েছেন কবি। আর তার বুদ্ধিদীপ্ত কথামালা যথার্থই কবিতা। শুধু তাই নয়, ৭ মার্চে রেসকোর্সের ভাষণের পরে নিউইয়র্কের দ্য নিউজউইক ম্যাগাজিন ৫ এপ্রিলে প্রকাশিত সংখ্যায় বঙ্গবন্ধুকে ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’ বা ‘রাজনীতির কবি› বলে আখ্যায়িত করে।
২ মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধুর আহŸানে সারা বাংলায় পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অসহযোগ চলছিল। তৎকালীন পাকিস্তানি জনগণই শুধু নয়, বহির্বিশ্বেরও অনেকে ব্যাপক উদ্দীপনা নিয়ে তাকিয়ে ছিল বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে কী বলেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য এ ছিল অন্তিম মুহূর্ত। অন্যদিকে স্বাধীনতার চেতনায় প্রদীপ্ত বাঙালি জাতির জন্য এ ভাষণ ছিল পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন–শোষণের নাগপাশ ছিন্ন করে জাতীয় মুক্তি বা কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে চূড়ান্ত সংগ্রামের সূচনা। কিন্তু এ ভাষণে কী বলবেন তিনি? এ নিয়ে ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগসহ অঙ্গসংগঠনসমূহের নেতৃবৃন্দের সাথে চলে দফায় দফায় আলোচনা। সকলেই তাকে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পরামর্শ দেয়। বঙ্গমাতা তাকে বলেন, ্র৭ই মার্চ তোমার মনে যা আসবে তাই বলবে।গ্ধ বঙ্গবন্ধু ড. কামাল হোসেনকে ডেকে বলেন, ্রআমি তো লিখিত বক্তব্য দেবো না; আমি আমার মতো করে দেবো। তুমি পয়েন্টগুলো ফরমুলেট করো।গ্ধ
মঞ্চে উঠে চিরাচরিত ভঙ্গিতে সম্বোধনের মাধ্যমে শুরু করেন তার বক্তৃতা। শুধু একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে নয়, বাঙালি সেদিনের ভাষণকে কেন্দ্র করে মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিল। তাই সরাসরি স্বাধীনতার ডাকে সম্ভাব্য ভয়াবহতার কথা চিন্তা করে তিনি তার বক্তব্যে রাজনৈতিক দুরদর্শিতার পরিচয় দেন। বিশেষত ভাষণের শেষ পর্যায়ে তিনি ‘স্বাধীনতার’ কথা এমনভাবে উচ্চারণ করেন, যাতে ঘোষণার কিছু বাকিও থাকল না, আবার তাঁর বিরুদ্ধে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার অভিযোগ উত্থাপন করাও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর জন্য সম্ভব নয়। বস্তুত এ ভাষণ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতারই ঘোষণা। তবে সরাসরি তা ঘোষণা না করে তিনি কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করেন। উজ্জ্বল ও বিশেষ বৈশিষ্ট্যমÐিত অলিখিত এ ভাষণ নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে রাতারাতি সশস্ত্র করে তোলে। একটি ভাষণকে অবলম্বন করে স্বাধীনতার জন্য ৩০ লাখ বাঙালি জীবন উৎসর্গ ও কয়েক লাখ মা–বোন সম্ভ্রম বিসর্জন দেন। ’৭১–এর স্বাধীনতা যুদ্ধকালে এ ভাষণ রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের শত্রæর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অনুপ্রাণিত করে। বলা যায়, এই একটি ভাষণ একটি জাতিরাষ্ট্র, বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছে, যা বিশ্বে নজিরবিহীন।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ পৃথিবীর অনেক ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। গবেষণা হয়েছে। ইউনেস্কো এ ভাষণকে ৩০ অক্টোবর ২০১৭ বিশ্ব–ঐতিহ্য সম্পদ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার’–এ অন্তর্ভুক্ত করেছে। গবেষকেরা বলেন, ৭ই মার্চের ভাষণের বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সার্বজনীনতা এবং মানবিকতা। যা যে কোনো নিপিড়ীত জাতিগোষ্ঠীর মুক্তির পথে অগ্রসর হতে অনন্য ভূমিকা রাখে।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন