একুশ আর বইমেলাÑযেন একে অপরের সহোদরা। ফেব্রুয়ারির একুশ, মনে এলেই বইমেলার কথাও এসে যায় অনিবার্যভাবেই। ভাষা আন্দোলন, বাংলা একাডেমি, বইমেলা এবং বইমেলা সংশ্লিষ্ট লেখক, প্রকাশক, পাঠক এসবকিছুই মূলত একে অন্যের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
‘ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার আগুনে পুড়তে পুড়তে ফিনিক্স পাখির মত বেঁচে থাকবে, ডানা মেলে আকাশে উড়বে এবং মৃত্তিকা স্পর্শ করবে বই’। বৃষ্টি’র কথা-য় অমল সাহার বলা কথাটির সাথে ওমর খৈয়ামের চিরন্তন সেই বাণীটিকে মনে পড়ল, ‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত যৌবনা’। ঠিক তা-ই। বইয়ের চেয়ে ভালো বন্ধু আর কিছু নেই, কেউ নেই।
অন্যদিকে, সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর বই কেনা গ্রন্থে বলেছিলেন, ‘মুসলমানদের পয়লা কেতাব কোরানের সর্বপ্রথম যে বাণী মুহম্মদ শুনতে পেয়েছিলেন তাতে আছে, ‘আল্লাম বিল কলমি’ অর্থাৎ আল্লা মানুষকে জ্ঞান দান করেছেন ‘কলমের মাধ্যমে’। আর কলমের আশ্রয় তো পুস্তক। বাইবেল শব্দের অর্থ বইÑবই ঢ়ধৎ বীপবষষবহপব. সর্বশ্রেষ্ঠ পুস্তক Ñ ঞযব ইড়ড়শ.’
বইমেলার আদির কথা খানিকটা বলি, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ১৮০২ সালে পৃথিবীতে প্রথম ম্যাথু কেরির উদ্যোগে বইমেলার যাত্রা শুরু। এক’শ জন প্রকাশক একই শহরে ১৮৫৭ সালে বড়ো আকারের বইমেলার আসরে বসেছিলেন। চীনে ৯৬০ সাল থেকে শানবিন নামক গ্রন্থশালায় বই সংগ্রহ করত। জার্মানিতে খ্রিস্টীয় পনেরো শতকে জোহানস গুটেনবার্গ মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের পর থেকেই বইমেলার প্রচলন। ধীরে সতেরো শতকের পর থেকে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও বইমেলার আয়োজন চালু হয়। সারাবিশ্বে আন্তর্জাতিক বইমেলার মাঝে লন্ডন বইমেলা, বুক এক্সপো আমেরিকা (বিইএ), আবুধাবি বইমেলা, আন্তর্জাতিক কলকাতা পুস্তকমেলা, নয়াদিল্লি বইমেলা, কায়রো বইমেলা, হংকং বইমেলা ইত্যাদি অন্যতম। বিশ্বে সবচেয়ে বড় এবং স্থায়ী বইমেলা হল জার্মানির ফ্রাঙ্কফুটের বইমেলাটি।
ভারতের মুম্বাইয়ে চার্চ গেট ময়দানে ১৯৬০ সালে এনবিটি (ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট) প্রথম জাতীয় বইমেলার আয়োজন করেছিলো। পশ্চিমবঙ্গে আন্তর্জাতিক কলকাতা পুস্তকমেলা (পূর্বনাম কলিকাতা পুস্তকমেলা) ১৯৭৬ সালে প্রবর্তিত হয়ে ১৯৮৪ সালে তা আন্তর্জাতিক বইমেলার স্বীকৃতি লাভ করে। যা প্রতিবছর জানুয়ারি মাসের শেষ বুধবার থেকে ফেব্রুয়ারির প্রথম রবিরার বারোদিনব্যাপী (শুরুতে সাতদিন ছিলো) বইমেলা চলে। ১৯৯১ সাল থেকে প্রতিবছরই ফ্রাঙ্কফুট বইমেলার আদলে একটি বিদেশি রাষ্ট্র ‘ফোকাল থিম’ ও অন্য একটি রাষ্ট্র ‘সম্মানিত অতিথি রাষ্ট্র’ নির্বাচিত হয়। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০২২ সাল অব্দি কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় তৃতীয়বারের মত বাংলাদেশ থিম কান্ট্রি ছিল। বাংলাদেশ প্যাভেলিয়নে গতবছর অংশ নিয়েছিল ৫০ টি স্টল। চলতি বছরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরসহ ৪৩টি প্রকাশনা সংস্থা অংশ নিয়েছে। ঐতিহ্যবাহী সে মেলার প্যাভিলিয়নটি বঙ্গভবনের আদলে তৈরি করা হয়েছে। এবং বাংলাদেশ দিবস পালিত হয়েছে ৪ ফেব্রুয়ারি।
বাংলাদেশে ষাটের দশকে বাংলা একাডেমির গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক জয়েনউদ্দীন একাডেমিতে সংরক্ষিত বিদেশি বই ডড়হফবৎভঁষ ডড়ৎফ ড়ভ ইড়ড়শং বইয়ের দইড়ড়শ’, ঋধরৎ’ এই শব্দ দুটোর দ্বারা তিনি বইমেলার গুরুত্ব অনুধাবন করে মেলার আয়োজন করেন। (শিশু গ্রন্থমেলা। তিনি তখন ইউনেস্কোর শিশু-কিশোর গ্রন্থমালা উন্নয়ন প্রকল্পে কর্মরত ছিলেন)। স্বাধীন বাংলাদেশে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের আট ফেব্রুয়ারি চিত্তরঞ্জন সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বর্ধমান হাউসের বটতলায় কলকাতা থেকে আনা বত্রিশটি বই দিয়ে গোড়াপত্তন করেন। তাঁরই প্রতিষ্ঠিত প্রথম প্রকাশনা স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমানে মুক্তধারা প্রকাশনী)। বর্তমানে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে বইমেলা চলে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। তিনিই আবার ১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বইমেলা সংশ্লিষ্ট ‘বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি’ সংস্থাটি। বইমেলাকে বাংলা একাডেমির সাথে যুক্ত করেন ১৯৭৮ সালের বাংলা একাডেমি মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী। পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কাজী মনজুরে মওলা প্রথম এ বইমেলাকে, ‘অমর একুশে বইমেলা’ নামে একাডেমি প্রাঙ্গণেই আয়োজন করেন। সে থেকেই আজ অব্দি প্রতি বছর একই জায়গায় মহা সাড়ম্বরে ফেব্রুয়ারির সারা মাসব্যাপী বইমেলা চলে। কেন এই মাসেই বইমেলার আয়োজন? এর জবাবে ভুসুকু’র কথাটি স্মরণ করা যেতে পারে। হাজার বছর আগেকার বাঙালি কবি ভুসুকু অপমানদগ্ধ হৃদয়ে বলেছিলেন, ‘আজি ভুসুকু বাঙ্গালি হইলী’। ১৯৫২ সালের একুশ তারিখে স্বৈরশাসক পাকবাহিনীর সদস্যদের নৃসংশতায় প্রাণ হারায় অসংখ্য বাঙালি। ভাষার বাংলা জন্যে প্রাণ দিয়েছিলেন বাঙালি বীরেরা। সেই একুশ তারিখকে স্মরণে রেখেই ফেব্রুয়ারি মাসে বইমেলার আয়োজন চালু হয়। এখন তা বর্ধিত হয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রর্যন্ত প্রসারিত করা হয়েছে। সাংবাৎসরিক মাসব্যাপী এ আয়োজনে সাহিত্য-সংস্কৃতির এ মিলনমেলাকে কবি, লেখক, পাঠক ও প্রকাশকের সীমানা পেরিয়ে বৃহৎ এক সামাজিক অনুষ্ঠান বলা চলে। প্রতি বছরই আসছে নবীন প্রবীণের নানা বিষয়ের ওপর নতুন নতুন অসংখ্য বই। দর্শনার্থীর ভিড়ও চোখে পড়ার মতো। এ বছরে ১লা ফেব্রুয়ারি বেলা ৩ টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধনী বক্তব্যের মাধ্যমে শুরু হয়েছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। ‘পড় বই গড় দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’ এটিই এ বছরের বইমেলার প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০২৩ সালে মেলার বিন্যাসে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। বাংলা একাডেমি অংশে থাকবে মেলার মূল মঞ্চ এবং গ্রন্থ উন্মোচন ও লেখক বলছি মঞ্চ থাকবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। পরিবর্তন করা হয়েছে মেলার প্রবেশ পথও। দর্শনার্থীদের জন্য নির্দিষ্ট স্টল খুঁজে পেতে ডিজিটাল বোর্ড ও প্ল্যাকার্ডের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। রাখা হয়েছে ওয়াশরুম, নামাজের জায়গা, ফুডকোর্টের পর্যাপ্ত ব্যবস্থাও। শিশুদের বিনোদনের জন্য রাখা হয়েছে সিসিমপুরসহ নানা আয়োজন। নিরাপত্তার জন্য বইমেলার চারপাশে সিসি টিভি ক্যামেরা স্থাপনসহ নিয়োজিত থাকবে নিরাপত্তা বাহিনির সদস্যরাও। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৪৭০টি (৩৬৭টি সাধারণ প্রতিষ্ঠান, শিশু চত্বর ৬৯টি প্রতিষ্ঠান, প্যাভেলিয়ন ৩৪টি) এবং বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে সাধারণ প্রতিষ্ঠান ১০৩টি ও প্যাভেলিয়ন ১৪৭টি প্রতিষ্ঠান থাকছে। বিকেল তিনটা থেকে রাত সাড়ে আটটা অব্দি মেলার সময়সীমা। প্রতি বছরের মতো এবারও বইমেলায় সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগারো ক্যাটাগরিতে ১৫জনকে ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০২২’ পুরস্কৃত করা হয়েছে। কবিতায় ২জন, প্রবন্ধ/গবেষণায় ১জন, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণায় ১জন, বঙ্গবন্ধু বিষয়ক গবেষণায় ১জন, কথাসাহিত্যে ২জন, শিশুসাহিত্যে ১জন, নাটকে ২জন, আত্মজীবনী/স্মৃতিকথায়/ভ্রমণকাহিনিতে ১জন, অনুবাদে ১জন, বিজ্ঞান/কল্পবিজ্ঞান/পরিবেশ বিজ্ঞানে ১জন, ফোকলোরে ২জনসহ মোট ১৫জনকে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারে পুরস্কৃত করা হল। বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প মূলত বইমেলাকে কেন্দ্র করেই বেড়ে ওঠা।
বইমেলায় সবাই যে বই কিনতে যান এমনটিও নয়। অনেকেই যান পরিচিত জনের সাথে দেখা করতে, ঘুরতে, আড্ডা-গল্প করতে, ডিজিটাল যুগের অনেকেই ছবি আপলোড করতেও যান। প্রায় প্রতিদিনই স্টলে স্টলে নতুন বইয়ের আগমনের সাথে পালা করে বাড়ছে বইয়ের সংখ্যা, পাঠক ও ক্রেতার সংখ্যাও। যদিবা অতি মুদ্রাস্ফীতির ঝড়ে কাগজ ও শ্রমমূল্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বইয়ের দাম বেশি পড়ছে। এতে ক্রেতার সংখ্যাটি আগের তুলনায় কমেছে। ঢাকার বাইরে এ মেলা বছর জুড়ে সারা বাংলার প্রায় প্রতিটি জেলা পর্যায়েও হয়ে থাকে। বইমেলা মূলত বাংলা একাডেমি, লেখক, প্রকাশক, পাঠক ও দর্শনার্থীর এক মহা মিলনমেলা। যে মেলায় কেবল জ্ঞান ও বুদ্ধির মননশীল চাষ হয়। তাতে করে সমাজে বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা বাড়ে, গড়ে ওঠে পাঠের অভ্যাসও।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন