কালিম উদ্দিনের চোখ দুটি খুশিতে চিকচিক করছিল। মুখ ভর্তি স্ফীত হাসি। হৃদয়ে সুখের দোলা। দুপুরের পর পরই বাড়ির উদ্দেশ্যে পথ ধরেছিল। আর ভিক্ষা করতে মন চাইছিল না। মনে মনে ভাবছিল- আজ কার মুখ দর্শণে যে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম। এমন সুদিন আমার জীবনে খুব কমই এসেছে। আজ চৌধুরী বাড়ি পার হবার সময় স্বয়ং চৌধুরী তাকে নাম ধরে ডেকেছে। চৌধুরীর মুখে নাম শোনা আর আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া সমান কথা। কি যে ভালো লেগেছে চৌধুরীর মুখে ‘কলিম উদ্দিন’ নামটি শোনে, তা সে বলে বুঝাতে পারবে না। চৌধুরী বলেছে- কালিম উদ্দিন, বাড়ির ভীতরে আসো। কলিম ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল চৌধুরীর মুখ পানে। নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। চৌধুরী আসলেই তাকে ডেকেছে, নাকি অন্য কাউকে? এক কদম, দু’কদম করে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠেছিল। চৌধুরী তাকে খাটে বসতে বলেন। খাটে বসার সাহস পায়নি কলিম। ফ্লোরে বসেছিল। সাদা ভাত আর রুই মাছের মাথা দিয়ে তাকে খেতে দেয়া হলো। গোগ্রাসে খেল কালিম। কতদিন ধরে এমন সুস্বাদু খাবার খেতে পাওে না। মন চেয়েছিল পাতিলের সমস্ত ভাত-তরকারী খেয়ে ফেলতে। চৌধুরীর মুখে নাম শুনে, সাদা ভাত আর রুই মাছের মাথা দিয়ে ভাত খেয়ে, যতটা খুশি হলো, তার চেয়ে দ্বিগুণ খুশি হলো, যখন চৌধুরী তার হাতে দুটি কম্বল সঁপে দিল। আহা! চকচকে আর দামি দু’টি কম্বল। বউ কম্বল দু’টি পেয়ে কতই না খুশি হবে। বউ কতদিন ধরে প্যানরপ্যানর করছে-এই, শীত আয়া গেল। শীতে রাত্রিরে ঘুমাতে বেশ কষ্ট অয়। কারো কাছে চায়া একখান কম্বল-কাঁথা আনতে পার না? তোমার মতন নিমোরাইদ্যা সোয়ামীর ঘর করা থাইক্যা মইর্যা যাওন অনেক ভালা, অন্তত তহন আর শীতে কষ্ট করুন লাগব না। কলিমের খুশির যেন বাঁধ মানছে না। এই শীতে কম্বল দুটি গায় দিয়ে আরামচে ঘুমাবে। বউয়ের প্যানপ্যান ধ্বনি আর শুনতে হবে না। এবার আর গত শীতের মতো মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে যাবে না। কম্বলের অভাবে হাড় কাঁপবে না।
এত আনন্দের মাঝেও মনে একখ- সন্দেহের দানা উঁকি দেয়। চৌধুরী এত খাতির যতœ করল কেন? ভিক্ষুক জীবন তো আর একদিন দু’দিন ধরে নয়। চৌধুরী এমন খাতির যতœ তো আর কোনো দিন করে না। তাহলে আজ কেন? আনন্দ আর দ্বিধার পালে দোল খেতে খেতে কলিম উদ্দিন বাড়ি ফিরে আসে। দু’দিন পর চৌধুরী কালিম উদ্দিনের বাড়িতে হাজির। চৌধুরীকে বাড়িতে দেখে যারপরনাই খুশি কালিম উদ্দিন। চৌধুরী রক্ত-চুষা। গরীবের রক্ত চুষে চুষে বড়লোক হয়েছে। পাষা-। হৃদয়হীন। চৌধুরীর উপস্থিতি দেখে কলিম উদ্দিনের এই কথাগুলি বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। কত বড়লোক আর বিদ্বান লোক হয়েও চৌধুরী নিজ পায়ে হেঁটে বাড়িতে উপস্থিত হয়েছে। কলিম উদ্দিনের বাড়িতে চৌধুরীকে বসতে দেওয়ার মতো কোনো চেয়ার নেই। দৌড়ে রান্নাঘর থেকে একটি পিড়ি নিয়ে আসে। কাঁধের গামছা দিয়ে পিড়ি মুছে বাড়িয়ে বলে- সাব, বসেন। আপনি নিজে আমার বাড়িত আইছেন, আমি কত্ত যে খুশি অইছি হেই কতা আপনারে বইল্যা বুঝান যাব না। কিন্তুএই খুশি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। ঘনকালো মেঘে ঢাকা পড়ে যায় চাঁদের চিকচিকে আলো। চৌধুরী গম্ভীরমুখে বলেন- কালিম, তোমাকে যে এই বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। কালিম কিছু বুঝতে পারে না। বলে, চৌধুরী সাব কী কইতাছেন? চৌধুরী গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দেন- না, ঠিকই বলছি। তিনি একটি রেজিস্ট্রি পত্র দেখিয়ে বলেন, এই যে জমির দলিল। তুমি তো আবার পড়তে পারো না, তোমাকে দেখিয়ে কী হবে? এই জমি তুমি আমার কাছে বিক্রি করেছ। কালিম, জায়গাটা বেশ উচু। এখানে আমি লেয়ার মুরগীর ফার্ম দিব। তোমাকে বর্তমান বাজার দরে টাকা দিয়ে দিব, এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকো। কালিম এবার বুঝতে পারল কিছুদিন আগে চৌধুরীর ছোট ছেলে কেন তাকে মোবাইল কিনে দেবার কথা বলে শহরে নিয়ে গিয়েছিল। কেনই বা মোবাইল সিম রেজিস্ট্রেশনের কথা বলে তার টিপ সই নিয়েছিল। আসলে মোবাইল রেজিস্ট্রেশনের আড়ালে জমির দলিলে টিপ সই নিয়েছিল। মনে মনে বলে, মৃত গবাদী পশুর হাড়ও ক্ষুধার্ত শকুনের দৃষ্টি সীমার বাহিরে নয়। তাই বলে এত বড় প্রতারনা করতে পারল চৌধুরীর ছোট ছেলে? সে ভেজা কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বলে, চৌধুরী সাব, আমার বাপ-দাদার ভিটা ছাইড়া কই গিয়া থাকব? দাঁড়ি-গোঁফের ফাঁক গলে চৌধুরীর মুচকি হাসির রেখা দেখা যায়। বলেন, সে নিয়ে চিন্তা করো না। আমার বাড়ির গোয়াল ঘরটা আছে না? ওটা এখন পতিতই পড়ে থাকে। তুমি ইচ্ছে করলে সেখানে না হয়....। মাথা নিচু হয়ে আসে কালিম উদ্দিনের। এ জীবন তো আর একদিন দু’দিনের নয়। কতবার কতজনের কাছে কত মারপ্যাঁচে পরাজিত হয়েছে কলিম, তার হিসাব মিলানো কঠিন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন