তথ্য-প্রযুক্তি বিশ্বের অন্যতম দ্রুত সম্প্রসারণশীল অর্থনৈতিক খাত। এ খাতে প্রতি বছর লাখ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। ব্যাপক শ্রমঘন শিল্প হিসেবে বিশেষ সফ্টওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি, আউটসোর্সিং ও রফতানীখাতে বাংলাদেশের সম্ভাবনা এ খাতের দেশী-বিদেশী উদ্যোক্তাদের দ্বারা অনেক আগেই চিহ্নিত হলেও যথাযথ উদ্যোগের অভাবে সে সম্ভাবনা কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি। তবে হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে চলার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের তথ্য-প্রযুক্তি ও সফ্টওয়্যার শিল্প তার সম্ভাবনাকে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে, গত অর্থবছরে দেশীয় সফ্টওয়্যার রফতানীকারক প্রতিষ্ঠানগুলো এ খাত থেকে প্রায় ৭০ কোটি (৭০০ মিলিয়ন) ডলার আয় করেছে। আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা ১০০ কোটি ডলারে উন্নীত হবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে সফ্টওয়্যার রফতানী থেকে আয় ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হওয়ার যে উচ্চাভিলাষী প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাস্তবতা এবং আমাদের সামর্থ্যরে নিরিখে তা অসম্ভব না হলেও এ লক্ষ্য অর্জনে যে ধরনের উদ্যোগ, গাইডলাইন ও কর্মতৎপরতা প্রয়োজন তা আদৌ দেখা যাচ্ছে না।
তৈরী পোশাক বাংলাদেশের রফতানী আয়ের প্রধান খাত হয়ে উঠেছে। অথচ অনেক কম বিনিয়োগ এবং পরিবেশবান্ধব শিল্পোদ্যোগের সুযোগসহ আইটি সেক্টরের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা এর চেয়েও অনেক বেশী। তৈরী পোশাক রফতানীতে নানা ধরনের সমস্যা সত্ত্বেও দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ তার অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কার মত দেশগুলো গ্যাস-বিদ্যুৎ, জ্বালানি, বন্দর ও অবকাঠামোখাতে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার পরও বাংলাদেশের রফতানীকারকরা প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার মাধ্যমে তাদের সক্ষমতার প্রমাণ রাখছেন। তবে তথ্য-প্রযুক্তি ও সফ্টওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ও প্রমোশন খাতে বাংলাদেশের যাত্রারম্ভ ভারতের চেয়ে অনেক দেরিতে না হলেও এ খাতে তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে পড়ার বাস্তবতাকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। এ জন্য বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে বিএনপি সরকারের সাবমেরিন ক্যাবলে সংযুক্ত হওয়ার প্রথম দিকের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানসহ রাজনৈতিক দোষারোপ করা হলেও গত নব্বই দশকের মাঝামাঝিতে শুরু হওয়া সফ্টওয়্যার রফতানী খাতের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে ব্যর্থতার দায়ভার বর্তমান সরকারও এড়াতে পারে না। বিগত জোট সরকারের সময়ও তথ্য-প্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে কিছু প্রশংসনীয় উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপদ্রষ্টা মহাজোট সরকারও এ খাতের উন্নয়নে অনেক পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নিয়েছে। এসব উদ্যোগের যথাযথ বাস্তবায়ন হলে অনেক আগেই সফ্টওয়্যার রফতানী বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করতে পারত।
তথ্য-প্রযুক্তি খাতে ট্রিলিয়ন ডলারের বিশ্ববাজারে আমাদের প্রতিবেশী ভারত ইতিমধ্যে একটি বড় অংশ দখল করে নিতে সক্ষম হয়েছে। শতকোটি জনসংখ্যার বড় দেশ ভারত শ্রমঘন সফ্টওয়্যার রফতানী বাণিজ্যে যে লিডারশিপ গ্রহণ করেছে একইভাবে তৈরী পোশাক খাতের মত বাংলাদেশও কাছাকাছি অবস্থানেই থাকার কথা। গত অর্থবছরে ভারতের সফ্টওয়্যার রফতানীকারকরা ৮২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানী করতে সক্ষম হয়েছিল। অর্থাৎ বাংলাদেশের সফ্টওয়্যার রফতানীর পরিমাণ ভারতের শতভাগের একভাগেরও কম। ভারতীয় রফতানীকারকরা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৫ ভাগ বেশী সফ্টওয়্যার রফতানী করেছে। আর গত অর্থবছরে এ খাতে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ১৪ ভাগের কাছাকাছি। এর আগের অর্থবছরে আমাদের রফতানীকারকরা লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। গত অর্থবছরে ৭০ কোটি ডলারের সফ্টওয়্যার রফতানীর তথ্যকে সঠিক বলে ধরে নিলে ২০২১ সালের মধ্যে এ খাতের রফতানী আয় ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে হলে আগামী ৫ বছর কমপক্ষে ৫০ ভাগ রফতানী প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। বর্তমানে দেশে সফ্টওয়্যার শিল্পে প্রায় ৭ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে বলে জানা যায়। প্রয়োজনীয় শিল্পোদ্যোগ, সৃজনশীলতা ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির মাধ্যমে এ খাতের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে ২০২১ সালের মধ্যে দেশের অর্থনৈতিক চালচিত্রই পাল্টে যেতে পারে। দেশী-বিদেশী সামগ্রিক বাস্তবতাকে সামনে রেখে প্রয়োজনীয় ও অগ্রাধিকারভিত্তিক পদক্ষেপ নিতে পারলে এমন কি ৫ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়। ভারত যখন সফ্টওয়্যার রফতানী খাতে শত বিলিয়ন ডলার রফতানী লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করতে চলেছে, তখন বাংলাদেশ এ খাতে ১০ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ খুব দুঃসাধ্য বিষয় নয়। এ খাতের জন্য আমাদের প্রয়োজনীয় শ্রমশক্তি বা মানব সম্পদ রয়েছে। আগ্রহী দেশী-বিদেশী উদ্যোক্তাও আছে। প্রয়োজন শুধু সরকারী সহায়তা, সঠিক নীতিমালা এবং অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন