শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব

মো. আরাফাত রহমান | প্রকাশের সময় : ১৭ আগস্ট, ২০২২, ১২:০০ এএম

ক্ষতিকারক পদার্থ বাতাসে মেশার ফলে বায়ুদূষণ হয়। বায়ু দূষণের ফলে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়, পরিবেশ এবং সম্পদও নষ্ট হয়। বায়ুমন্ডলে ওজোন স্তর পাতলা হয়ে যায়। এর প্রভাব পড়ে জলবায়ুর উপর এবং বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনেরও কারণ হয়। শিল্প, যানবাহন, জনসংখ্যার বৃদ্ধি এবং নগরায়ন বায়ুদূষণের কয়েকটি প্রধান কারণ। নানা কারণে বায়ুদূষণ ঘটে যার অনেকগুলোই আবার মানুষের নিয়ন্ত্রণে নেই। মরুভূমি অঞ্চলে ধুলোঝড় এবং অরণ্যে বা ঘাসে আগুন লাগার ফলে নির্গত ধোঁয়া বাতাসে রাসায়নিক ও ধুলিকণাজনিত দূষণ ঘটিয়ে থাকে।
মূলত প্রাকৃতিকভাবে অথবা মানুষের কর্মকাÐের ফলে সৃষ্ট ক্ষতিকর ও বিষাক্ত পদার্থের দ্বারা বায়ুমন্ডলের দূষণ ঘটে। বায়ুদূষণপূর্ণ কোন একটি এলাকায় বায়ুতে অবমুক্ত ক্ষতিকর পদার্থসমূহের পরিমাণ অন্যান্য স্থানের তুলনায় অধিকতর হওয়ায় সহজেই দূষণের ক্ষতিকর প্রভাবসমূহ শনাক্ত করা যায়। বায়ুদূষণের প্রধান উৎসসমূহ হচ্ছে, গাড়ি থেকে নির্গত ধোঁয়া, বিদ্যুৎ ও তাপ উৎপাদনকারী যন্ত্র থেকে উৎপন্ন ধোঁয়া, শিল্পকারখানা এবং কঠিন বর্জ্য পোড়ানোর ফলে সৃষ্ট ধোঁয়া। বায়ুদূষণের আরও একটি কারণ অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের ঊর্ধ্বে বায়ুমন্ডলের ওজোন স্তরে ক্রমবর্ধমান ফাটল সৃষ্টি হওয়া। মানবজাতি, উদ্ভিদরাজি, পশুপাখি এবং জলজ প্রতিবেশ ব্যবস্থার ওপর অ্যাসিড বৃষ্টি সংঘটনের মাধ্যমেও বায়ূদূষণ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে আসছে।

সাম্প্রতিককালে বিশ্বের অন্যান্য স্থানের মতো এশিয়াতেও পরিবেশগত ইস্যুগুলোর মধ্যে বায়ুদূষণ অধিকতর প্রাধান্য লাভ করেছে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য বাণিজ্যিক কর্মকাÐের কেন্দ্রগুলিতে সমস্যাটি প্রকট আকার ধারণ করেছে। চট্টগ্রাম, খুলনা, বগুড়া এবং রাজশাহী অঞ্চলের নগর এলাকাগুলোতে বায়ুদূষণের স্বাস্থ্যগত প্রতিক্রিয়া ঢাকার তুলনায় কম। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শহর এলাকায় অনেক সময় এমন সব শিলা ও মৃত্তিকার উপর বাড়ি-ঘর নির্মাণ করা হয় যাদের ভিত্তি থেকে তেজষ্ক্রিয় গ্যাস বিকীর্ণ হয়। দীর্ঘসময় এই গ্যাস নিঃশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করলে ফুসফুসের ক্যান্সার হতে পারে। বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় বায়ুদূষণ এখনও তেমন কোন সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়নি। এ সকল এলাকায় যন্ত্রচালিত গাড়ির সংখ্যা যেমন কম, তেমনি শিল্প কারখানার সংখ্যাও অল্প। তবে ইটের ভাটা এবং রান্নার চুল্লি থেকে শহরতলী ও গ্রামীণ এলাকায় যথেষ্ট পরিমাণে বায়ুদূষণ ঘটছে। গ্রামাঞ্চলে কাঠ, কয়লা এবং বিভিন্ন ধরনের জৈববস্তু জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ফলে গ্রামাঞ্চলে প্রধান বায়ুদূষক হলো কোন নির্দিষ্ট কণিকা উপাদানে গঠিত বস্তু এবং উদ্বায়ী জৈব যৌগ।

বাংলাদেশে প্রধানত দুটি উৎস থেকে বায়ুদূষণ ঘটছে। এ দুটি উৎস হচ্ছে, শিল্প কারখানা এবং যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া। ইটের ভাটা, সার কারখানা, চিনি কল, কাগজ কল, পাটকল, বস্ত্র কারখানা, স্পিনিং মিল, ট্যানারী শিল্প, গার্মেন্ট ফ্যাক্টরী, রুটি ও বিস্কুট কারখানা, রাসায়নিক ও ঔষধ শিল্প, সিমেন্ট কারখানা, মেটাল ওয়ার্কশপ, করাত কল প্রভৃতি শিল্প কারখানা প্রধানত বায়ুদূষণ ঘটাচ্ছে। এছাড়াও কর্ষিত জমি থেকে উৎপন্ন ধুলা এবং উপকূলীয় দ্বীপসমূহ ও উপকূলীয় ভূমি এলাকায় সন্নিকটস্থ সমুদ্র তরঙ্গসৃষ্ট লবণ কণা দ্বারা বায়ুদূষণ হয়ে থাকে। বায়ুদূষণের এসকল উৎস থেকে প্রচুর পরিমাণে ধোঁয়া, বাষ্প, গ্যাস ও ধুলিকণা উৎপন্ন হয় যা কুয়াশা ও ধোঁয়াচ্ছন্ন পরিবেশ সৃষ্টি করে।

বাংলাদেশের কয়েক প্রকার শিল্প কারখানা যেমন ট্যানারী কারখানাগুলি প্রতিনিয়ত হাইড্রোজেন সালফাইড, অ্যামোনিয়া, ক্লোরিনসহ আরও কয়েক প্রকার গন্ধহীন রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করছে যেগুলো একদিকে যেমন বিষাক্ত তেমনি স্থানীয় জনগণের বিরক্তি ও পীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এসকল দূষক মাথাধরা এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যগত সমস্যা সৃষ্টি করছে। অধিক হারে নগরায়নের কারণে নগরে যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফলে অধিকতর হারে বায়ুদূষণ ঘটছে। পরিবেশ অধিদপ্তর এবং পরিবেশ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থা মিনি-ট্রাক ও মোটর সাইকেলকে প্রধান বায়ুদূষণকারী যান হিসেবে চিহ্নিত করেছে। মাত্রাতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল বোঝাই করা, দুর্বল ইঞ্জিনবিশিষ্ট পুরাতন বাস ও ট্রাকসমূহ কালো ধোঁয়া ও বিষাক্ত গ্যাস নির্গত করে নগরীর রাস্তায় চলাচল করছে। প্রকৃতপক্ষে ঢাকার রাস্তায় প্রতিদিন চলাচলকারী অনেক যানবাহন ত্রæটিযুক্ত যেগুলো প্রতিদিন সহনীয় মাত্রার অধিক ধোঁয়া নির্গত করে চলেছে। ডিজেল চালিত যানবাহনগুলো কালো ধোঁয়া নির্গত করে যাতে দহন সম্পূর্ণ না হওয়া সূ² কার্বনকণা বিদ্যমান থাকে।

বাংলাদেশে বর্তমানে বায়ুর দূষক পদার্থ শনাক্তকরণের লক্ষ্যে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হচ্ছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা এবং বগুড়ায় বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ঢাকার তেজগাঁও, ফার্মগেট, মানিক মিয়া এভিনিউ, গুলশান, লালমাটিয়া এবং আগারগাঁও-এ যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া পরীক্ষা করার কেন্দ্র রয়েছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় নিয়মিত বায়ুর গুণাগুণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আসছে।

আবাসিক এলাকা, শিল্প এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা এবং সংবেদনশীল এলাকাসমূহের জন্য বায়ুর গুণাগুণ মাত্রা বিভিন্ন ধরনের। ঢাকা শহরের সর্বাধিক বায়ুদূষণ কবলিত এলাকাসমূহ হচ্ছে হাটখোলা, মানিক মিয়া এভিনিউ, তেজগাঁও, ফার্মগেট, মতিঝিল, লালমাটিয়া এবং মহাখালী। জরিপে দেখা যায়, বায়ুমন্ডলে বিদ্যমান দূষক কণাসমূহের ঘনত্ব প্রতি ঘনমিটারে ৩,০০০ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে, যেখানে গ্রহণযোগ্য মাত্রা হচ্ছে প্রতি ঘনমিটারে ৪০০ মাইক্রোগ্রাম। ফার্মগেট এলাকায় সালফার ডাই অক্সাইডের ঘনত্ব পাওয়া গিয়েছে প্রতি ঘনমিটারে ৩৮৫ মাইক্রোগ্রাম, যেখানে বায়ুমন্ডলে এর সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য সীমা প্রতি ঘনমিটারে ১০০ মাইক্রোগ্রাম। একইভাবে তেজগাঁও শিল্প এলাকায় বায়ুমন্ডলে বিদ্যমান দূষক কণাসমূহের ঘনত্ব পরিলক্ষিত হয়েছে প্রতি ঘনমিটারে ১,৮৪৯ মাইক্রোগ্রাম, যা ঐ এলাকার গ্রহণযোগ্য মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ৫০০ মাইক্রোগ্রামের তুলনায় অনেক বেশি। সচরাচর ডিসেম্বর মাস থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত বিদ্যমান শুষ্ক মাসগুলোতে ঢাকার বায়ুদূষণ সর্বাধিক পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। বায়ুদূষণের কারণে সর্বাধিক ক্ষতির শিকার হয় শিশুরা। বায়ুতে অতিরিক্ত সীসার উপস্থিতি শিশুদের মানসিক বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে। প্রতিবছর ঢাকা মহানগরীর বায়ুতে প্রায় ৫০ টন সীসা নির্গত হচ্ছে। শুষ্ক ঋতুতে অর্থাৎ নভেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসে বায়ুতে সীসার পরিমাণ সর্বোচ্চে পৌঁছে। ঢাকা শিশু হাসপাতালের শিশু বিকাশ কেন্দ্রে শিশুদের দেহে সীসা দূষণের ঘটনা শনাক্ত করা হয়েছে। পরীক্ষাকৃত শিশুদের রক্তে প্রায় ৮০ মাইক্রোগ্রাম/ডি.এল থেকে ১৮০ মাইক্রোগ্রাম/ডি.এল সীসা পাওয়া গিয়েছে যা গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে ৭ থেকে ১৬ গুণ বেশি।

বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন এবং বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ পরিবেশ অধিদপ্তরের সহযোগিতায় ঢাকার বাতাসে সীসার ঘনত্ব পরিমাপ করেছে। ঢাকা শিশু হাসপাতাল, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ঢাকা মহানগরীর শিশুদের রক্তে সীসার মাত্রা পরীক্ষা করেছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া পরিমাপ করার লক্ষ্যে মিরপুরে একটি কেন্দ্র স্থাপন করেছে। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন এক রিপোর্টে উল্লেখ করেছে, নগরবাসীরা রাস্তাঘাটে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে যে সীসা গ্রহণ করছে তা পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক নিরাপদ ঘোষিত মাত্রার চেয়ে প্রায় ১০ গুণেরও বেশি। ইউ.এস সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন-এর নির্দেশনা অনুযায়ী রক্তে ১০ মাইক্রোগ্রাম/ডি.এল পরিমাণ পর্যন্ত সীসার উপস্থিতি নিরাপদ। মধ্যম আয়ের নগর এলাকা অথবা গ্রামীণ এলাকার তুলনায় নগরীয় বস্তি এলাকায় বসবাসকারী অধিবাসীদের রক্তে গড় সীসার মাত্রায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান সীসা দূষণ মানবদেহের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করা ছাড়াও বৃক্কের সচলতাকে নষ্ট করে দেয় এবং উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি করে। শিশুদের রক্তে অতিরিক্ত সীসার উপস্থিতি তাদের মস্তিষ্ক এবং বৃক্ককে নষ্ট করে ফেলতে পারে। পূর্ণ বয়ষ্ক মানুষের তুলনায় শিশুরা সীসা দূষণে তিনগুণ বেশি আক্রান্ত হয়।

ধুলাবালি এবং খনিতে সৃষ্ট গ্যাস কয়লাখনিতে সমস্যার সৃষ্টি করে থাকে। সৌভাগ্যক্রমে দিনাজপুর জেলার বড়পুকুরিয়া কয়লাখনিতে গ্যাসের পরিমাণ খুবই অনুল্লেখযোগ্য হওয়ায় খনি থেকে কয়লা উত্তোলন প্রক্রিয়ায় মিথেন গ্যাস নির্গমন ও মিথেন গ্যাস সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দুর্যোগ ঘটার সম্ভাবনাও রয়েছে খুবই কম। বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে যান্ত্রিক উপায়ে কয়লা আহরণ করা হয় বিধায় প্রচুর পরিমাণে কয়লার গুঁড়াও উৎপন্ন হয়, তবে যথার্থ পদক্ষেপ গ্রহণ করলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হতে পারে।

একইভাবে দিনাজপুর জেলার মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনি থেকেও প্রচুর পরিমাণে ধুলাবালি উৎপন্ন হয়। সেইসঙ্গে ঘন ঘন যান চলাচল এবং পণ্য বোঝাই ও পণ্য খালাসকরণ প্রক্রিয়ায়ও প্রচুর ধুলাবালি উৎপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ভূ-পৃষ্ঠে এবং খনি গহবরে কয়লা, জ্বালানি এবং লুব্রিক্যান্টের দহনের ফলে সৃষ্ট গ্যাস দ্বারা আশপাশের এলাকার বায়ু দূষিত হতে পারে। খনি থেকে কয়লা ও কঠিন শিলা কর্তন, গলানো, চূর্ণ করা এবং পরিবহণের সময় সৃষ্ট ধুলাবালি খনিতে কর্মরত শ্রমিক এবং আশপাশের এলাকার অধিবাসীদের জন্য হুমকিস্বরূপ।

লেখক: সহকারি কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন