জ্বালানি সংকটে নাজেহাল দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার নিশ্চিত করতে রাশিয়া থেকে তেল আমদানির প্রস্তাব বিবেচনা করছে সরকার। উল্লেখ্য, গত মে মাসেই রাশিয়া বাংলাদেশকে কমদামে ক্রুড অয়েল আমদানির প্রস্তাব দিয়েছিল। সে সময় আমরা সরকারের কাছে রাশিয়ার এই প্রস্তাব যথাশীঘ্র আমলে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলাম। সম্ভবত বৈশ্বিক ভ’রাজনীতি ও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণেই সরকার তখন সে পথে অগ্রসর হয়নি। ইউক্রেন যুদ্ধের বাস্তবতায় ইতিমধ্যে বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট এবং সরবরাহ ব্যবস্থায় যে প্রতিবন্ধকতা দেখা দিয়েছে, খোদ ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোনো কোনো দেশ রাশিয়া থেকে গ্যাস ও তেল আমদানি বন্ধ করেনি। দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অংশীদার ভারতও রাশিয়া থেকে তেল আমদানি বন্ধ করেনি। এহেন বাস্তবতা থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাশিয়া থেকে ক্রুড অয়েল আমদানির উদ্যোগ নিয়ে কাজ করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন। ডলারের বদলে রুবল বা বিকল্প মূদ্রায় রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানির সম্ভাব্যতা পর্যালোচনার বিষয়টি বর্তমান বিশ্ববাস্তবতায় খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বিশেষত ডলারের একচ্ছত্র আধিপত্য ও নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে বিকল্প মূদ্রায় জ্বালানি আমদানির সিদ্ধান্ত সময়ের বাস্তবতায় খুবই সাহসী ও বাস্তবানুগ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও রাশিয়ার উপর পশ্চিমা বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার শুরু থেকেই ভারত নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করে নিজেদের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রতি মনোযোগী ছিল। সে রাশিয়া থেকে কমদামে ক্রুড অয়েল আমদানির সুযোগ লুফে নিয়ে সম্ভাব্য জ্বালানি সংকট সামাল দিতে সক্ষম হয়েছে। বাণিজ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি জ্বালানি ও বিদ্যুত খাতে রাশিয়া বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। রূপপুরে দেশের একমাত্র পারমানবিক বিদ্যুতকেন্দ্র বাস্তবায়নে রাশিয়ান প্রযুক্তিবিদ, শ্রমিক এবং বিনিয়োগের অগ্রণী ভ’মিকা রয়েছে। রাশিয়া থেকে কমদামে ক্রুড অয়েল আমদানি নিরুৎসাহিত করার অজুহাত হিসেবে দেশের একশ্রেণীর আমলা ক্রুড অয়েল রিফাইনের সক্ষমতা না থাকার কথা বলেছেন। এ ক্ষেত্রে আমাদেরকে ক্রুড অয়েল আমদানির সাথে পুরনো ইষ্টার্ন রিফাইনারির সক্ষমতাবৃদ্ধি এবং সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে নতুন অয়েল রিফাইনারি স্থাপনের জরুরি উদ্যোগ নিতে হবে। অয়েল রিফাইন সক্ষমতা বৃদ্ধির আগে রাশিয়া থেকে আমদানিকৃত ক্রুড অয়েল সিঙ্গাপুর, ভারত বা অন্যকোনো দেশ থেকে রিফাইন করে আনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এশিয়ার বড় দুই অর্থনীতি ভারত ও চীনের মধ্যে পারস্পরিক বৈরীতা সত্ত্বেও রাশিয়া থেকে নিয়মিত মূল্যের চেয়ে ৩৫ শতাংশ কমদামে তেল আমদানি করছে। গতকাল প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, বাংলাদেশের তেল পরিশোধনে সক্ষমতা না থাকায় রাশিয়ার একটি রাষ্ট্রায়াত্ত কোম্পানি বাংলাদেশকে পরিশোধিত তেল আমদানির প্রস্তাব দিয়েছে। রাশিয়ার কাছে চীন ও ভারতের অনুরূপ মূল্যে তেল পাওয়ার দাবি করতে পারে বাংলাদেশ।
অব্যাহত মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন যখন দুর্বিষহ, তখন আরেক দফা জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির ধকল সামলানো যাচ্ছে না। কথা ছিল আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে মূল্য কমানো হবে। গত দুই মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য অনেকটা কমলেও আমাদের দেশে বাড়ানো হয়েছে। এখন রাশিয়া থেকে কমদামে তেল আমদানির সুযোগ গ্রহণ করে জ্বালানির মূল্য কমিয়ে জনজীবনের নাভীশ্বাস ও দুর্দশা লাঘবের সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। রাশিয়া থেকে কমদামে জ্বালানি তেল আমদানির পাশাপাশি দেশের জ্বালানি খাতের উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সাগরের ব্লকগুলো থেকে তেল-গ্যাস উত্তোলনে ন্যায্যতার ভিত্তিতে বিডিং নিশ্চিত করার পাশাপাশি রাষ্ট্রায়াত্ত পেট্টোলিয়াম কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও অগ্রাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, শিল্পায়ন ও নগরায়ন বৃদ্ধির সাথে সাথে দেশে জ্বালানির চাহিদাও বাড়ছে। এহেন বাস্তবতায় স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে এসেও পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠিত ইষ্টার্ন রিফাইনারির সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ না নেয়া বিষ্ময়কর ঘটনা। প্রায় একযুগ আগে সউদি আরব বাংলাদেশে নতুন তেল শোধনাগার নির্মান ও ইষ্টার্ন রিফাইনারির সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছিল। বেশি দামে পরিশোধিত আমদানির ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগিদের সুযোগ সুবিধা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ে কোনো নেপথ্য শক্তি দেশের স্বার্থের এসব প্রস্তাবকে অগ্রাহ্য করছে কিনা তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। জ্বালানি ও খাদ্য নিরাপত্তা সর্বাধিক রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকার প্রাপ্ত ইস্যু। এসব ক্ষেত্রে আপস করার সুযোগ নেই। সাধারণ মানুষের চাহিদা ও সক্ষমতার সাথে সঙ্গতি রেখে জরুরি ভিত্তিতে জ্বালানি নিরাপত্তা ও মূল্যস্ফীতির বিষয়গুলোকে আমলে নিয়ে মূল্য নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন