শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

স্বাস্থ্য

প্রিডায়াবেটিস ঃ ডায়াবেটিসের পূর্বাবস্থা

| প্রকাশের সময় : ১৯ আগস্ট, ২০২২, ১২:০৫ এএম

প্রিডায়াবেটিস বা প্রাক-ডায়াবেটিস হল ডায়াবেটিসেরই পূর্বাবস্থা। প্রিডায়াবেটিস হলো রক্তের গ্লুকোজ স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি কিন্তু ডায়াবেটিক মাত্রায় এখনও পৌঁছেনি, এমন পর্যায়।

তবে, এটিকে গুরুত্বহীনভাবে নেবার কোন সুযোগ নেই। ডায়াবেটিসের চেয়েও মারাত্মক হতে পারে প্রিডায়াবেটিস। প্রিডায়াবেটিসেও দেহে ডায়াবেটিস হবার অস্বাস্থ্যকর পরিবর্তন সাধিত হয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, অনেক প্রিডায়াবেটিস রোগী ডায়াবেটিসজনিত দীর্ঘস্থায়ী (ক্রনিক) জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে যান।

প্রাথমিক অবস্থায় শরীরে শর্করার মাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে বিভিন্ন লক্ষণ প্রকাশ পায়। ডায়াবেটিসের সংকেত বলা হয় সেসব লক্ষণকে। হয়তো অনেকেই প্রাথমিক এসব লক্ষণ টের পান না। যার ফলাফল হয় মারাত্মক। ডায়াবেটিসের চেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করা হয় প্রিডায়াবেটিসের সময়কালকে।

দেহে গ্লুকোজ বা শর্করার মাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে বিভিন্ন লক্ষণ প্রকাশ পেয়ে থাকে যেগুলোকে ক্লাসিক্যাল লক্ষণ বলা হয়, তা সাধারনত টাইপ-১ ডায়াবেটিসের বেলায় প্রযোজ্য, টাইপ ২-এর বেলায় উপস্থিত নাও থাকতে পারে অধিকাংশ ক্ষেত্রে। আর প্রিডায়াবেটিসের বেলায় প্রায়শই কোন উপসর্গ দেখা দেবে না, যার ফলাফল হয় মারাত্মক। অনেক ক্ষেত্রেই ডায়াবেটিসের চেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করা হয় প্রিডায়াবেটিসকে।

রক্তে এইচবিএ১সি যদি ৫.৭ থেকে ৬.৪%; অভুক্ত অবস্থায় রক্তের গ্লুকোজ ৫.৬ থেকে ৬.৯ মিলিমোল/লি বা ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খাবার ২ ঘণ্টা পর ৭.৯ থেকে ১১.০ মিলিমোল/লি হয় তাকে প্রিডায়াবেটিস বলা হবে।

ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশনের হিসেব মতে, ২০২১ এ পৃথিবীতে ৮৬০ মিলিয়ন (১৬.৮%) মানুষ প্রিডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন, যেখানে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল ৫৩৭ মিলিয়ন (১০.৫%)। বাংলাদেশের ১৪% (২ কোটির বেশি) মানুষ প্রিডায়াবেটিসে আক্তান্ত।

প্রিডায়াবেটিস কিভাবে জানান দেয়-
১. ঘন ঘন প্রস্রাব করা। ২. উচ্চ রক্তচাপ। ৩. কাজ না করে খুব ক্লান্ত। ৪. হঠাৎ ওজন বৃদ্ধি পায়। ৫. খুব তৃষ্ণার্ত হয়ে যায়। ৬. ক্ষুধা বেড়ে যাওয়াও প্রিডায়াবেটিসের লক্ষণ। ৭. উচ্চ কোলেস্টেরল। ৮. মহিলাদের পিসিওডি থাকলে পিরিয়ডগুলি অনিয়মিত হয়ে যায়। এটি প্রিডায়াবিটিসের লক্ষণ হতে পারে। যদি হঠাৎ আপনার সমস্যা দেখা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের কাছে যান। এটি প্রিডায়াবিটিসের হওয়ার কারণও হতে পারে। উচ্চ কোলেস্টেরল, যদি আপনি এই লক্ষণগুলি দেখতে শুরু করেন তবে আপনার রক্তে শর্করার পরীক্ষা করা জরুরি। রক্তে শর্করার পরীক্ষাটি নির্দেশ করে যে আপনার রক্তের গ্লুকোজ স্তর স্বাভাবিকের চেয়েও বেশি।

প্রিডায়াবেটিসের অনেক রোগী অনেক সময় ডায়াবেটিসের রোগীর মতই হৃদরোগসহ অন্যান্য মেটাবলিক রোগের ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। যদি সময়মতো প্রিডায়াবেটিস মুহূর্ত থেকে জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনা না যায়; তাহলে তা বিপজ্জনক হতে পারে।

ডায়াবেটিসের পরীক্ষা করা জরুরী।
প্রিডায়াবেটিসের ঝুঁকি সমুহঃ
প্রিডায়াবেটিস বস্তুতঃ নন-ডায়াবেটিস থেকে ডায়াবেটিসে রুপান্তরিত হবার মধ্যবর্তী অবস্থা; অর্থাৎ যে কারণে ডায়াবেটিস [বিশেষত, টাইপ-২ ডায়াবেটিস] হয়, ঠিক একই কারণে প্রিডায়াবেটিস হয়ে থাকে। যে কেউ যে কোন বয়সে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে নিম্নের শ্রেণীর লোকদের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে:

১) বংশে ডায়াবেটিস- নিকট আত্মীয়ের ডায়াবেটিস -বাবা-মা, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে, চাচা-ফুফু, মামা-খালা, দাদা-দাদী ও নানা-নানী।
২) বয়স- বয়স বৃদ্ধির সাথে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে।
৩) ওজানাধিক্য/স্থূলতা- যাদের ওজন ও কোমরের পরিধি বেশি।
৪) শারীরিক পরিশ্রম- যারা ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম করেন না।
৫) গর্ভাবস্থা-গর্ভকালীন।
৬) মা ডায়াবেটিক-গর্ভকালীন অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে সন্তানের ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে।
৭) ঔষধ- বহুদিন ধরে বিশেষ কোন কোন ঔষধ ব্যবহার করলে।

প্রিডায়াবেটিস প্রতিরোধে করনীয়ঃ
যাদের ডায়াবেটিস হবার ঝুঁকি বেশি তাদের চিহ্নিত করে প্রতিরোধের চেষ্টা করা হয়। আর এভাবে প্রিডায়াবেটিস, ডায়াবেটিস এবং ডায়াবেটিস জনিত জটিলতা সংক্রান্ত চিকিৎসা খরচ কমানো সম্ভব। এটা সত্যি যে টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব; অন্তত অর্ধেক রোগীর ক্ষেত্রে। স্বাভাবিক ওজন ধরে রাখা এবং প্রতিদিন কিছু শারীরিক পরিশ্রমের লক্ষ্যে জীবন যাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমে টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব।
দু’টি ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে প্রাথমিক প্রতিরোধ করা সম্ভব।

সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা:
১. জাতীয় এবং বেসরকারী বিভিন্ন সংস্থাকে সাহায্য করা। ২. প্রতিরোধের অর্থনৈতিক উপকারিতা সম্পর্কে জন সাধারণকে অবহিত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা।

বেসরকারী উদ্যোগ:
১) কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করা। ২) স্বাস্থ্যকর খাদ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।

সামাজিক সহায়তা:
১. পুষ্টি/স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস/ব্যায়াম ইত্যাদি বিষয়ে স্কুল থেকেই সময়োপযোগী শিক্ষা প্রদান করা। ২. নগর পরিকল্পনার সময় স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, ব্যায়াম করার পর্যাপ্ত সুযোগ এবং স্বাস্থ্যসম্মত নগরায়ন নিশ্চিত করা। ৩. সাধারণ জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজনীয় খেলাধুলার ব্যবস্থা করা।

প্রচার মাধ্যম:
১. জনসাধারণের পরিচ্ছন্ন শিক্ষা ও ধারণা প্রদানের মাধ্যমে তাদের উদ্বুদ্ধ করা। এ কাজে সংবাদপত্র, টিভি, রেডিও ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারে।

ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্য দৈনন্দিন জীবনধারার যে সকল বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সেগুলো হলো:
১) প্রতিদিন অন্তত: ৩০ মিনিট মাঝারী ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম করতে উৎসাহিত করা
২) প্রত্যেক ব্যক্তিকে আদর্শ ওজন ধরে রাখতে উৎসাহিত করা
৩) যাদের ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি তাদের অন্তত: ৫-১০% ওজন কমানোর চেষ্টা করা
৪) অপ্রাপ্ত বয়স্কদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে আদর্শ উচ্চতা ও আদর্শ ওজন লাভ নিশ্চিত করা

ডাঃ শাহজাদা সেলিম
সহযোগী অধ্যাপক
এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন