বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ভিকটিম ও সাক্ষীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে

অ্যাডভোকেট মো. সাইফুদ্দীন খালেদ | প্রকাশের সময় : ২০ আগস্ট, ২০২২, ১২:০০ এএম

ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বিচারের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হল মামলার সাক্ষ্য-প্রমাণ। এরই ভিত্তিতে বিচারকার্য তরান্বিত ও প্রসারিত করার উদ্দেশ্যই সাক্ষ্য আইনের সৃষ্টি। গণতান্ত্রিক দেশে বিচার বিভাগের দায়িত্ব যদি ঠিকভাবে পালন করতে হয়, তাহলে ভিকটিম ও সাক্ষী সুরক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা অতীব জরুরি। সাক্ষ্য হচ্ছে, আদালত কর্তৃক কোনো বিচার কার্য সম্পাদনের সময় পক্ষগণ কর্তৃক তাদের সাক্ষীর রেকর্ড বা দলিল ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের বক্তব্য সর্ম্পকে আদালতের মনে বিশ^াস স্থাপনের প্রয়াসে আইন সঙ্গতভাবে উপস্থাপিত প্রমাণের কোনো নমুনা। প্রয়োজনীয় সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়েই অপরাধীকে সাজা দেওয়া সম্ভব হয়। কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিপুল সংখ্যক মামলায় সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে অনীহা প্রকাশ করে বলে খবর আসে। আদালতে সাক্ষী হাজির না হওয়ায় গুরুতর ফৌজদারী মামলার বিচার বিলম্বিত হচ্ছে। সাক্ষী অনুপস্থিত থাকার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। সাক্ষ্য দেওয়ার কারণে আসামিপক্ষ থেকে সাক্ষীকে ভয়ভীতি দেখানোসহ জীবননাশের হুমকির কথা বলে থাকে। এমনকি সাক্ষীর জীবননাশের ঘটনাও ঘটেছে। হত্যা, ধর্ষণসহ নানা গুরুতর অপরাধের অভিযোগে দায়েরকৃত ফৌজদারী মামলায় প্রায়শই সাক্ষী যথাসময়ে হাজির হয় না। আসামি পক্ষের হুমকি, ভয়-ভীতি প্রদানসহ নানা কারণে সাক্ষীরা হাজির হয় না। এছাড়া কর্মস্থল পরিবর্তন হওয়ায় যথাসময়ে সমন না পৌঁছায় হাজির হতে পারে না অনেক অফিসিয়াল সাক্ষী। আবার সমন পেয়েও সাক্ষ্য দিতে অনীহা বোধ করে কেউ কেউ। অন্যদিকে সাক্ষীদের অনুপস্থিতিতে অনেক ফৌজদারী মামলায় অভিযোগ প্রমাণ করা যায় না, পাশাপাশি বিলম্বিত হয় বিচার কার্যক্রমও। এমনকি মামলার আসামিরা খালাস পর্যন্ত পেয়ে যায়। সাক্ষীর যথাযথ নিরাপত্তা ও সঠিক সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলা নষ্ট হয়ে বিচারপ্রার্থীরা হতাশ হচ্ছে এবং অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। বারবার সমন দিয়েও সাক্ষী হাজির করা যাচ্ছে না। সাক্ষী হাজির না হওয়ায় বিলম্বিত হচ্ছে গুরুতর ফৌজদারী অপরাধ মামলার বিচার। ফৌজদারী কার্যবিধি আইন ১৮৯৮ ও দণ্ডবিধি ১৮৬০, সাক্ষ্য আইন ১৮৭২ ভিকটিম ও সাক্ষীদের সুরক্ষার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো বিষয় প্রদান করা হয়নি। সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২-এ কেবল ১৫১ ও ১৫২ ধারায় কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে, যা সাক্ষীদের যথেষ্ট নিরাপত্তা দিতে সক্ষম না। দেশে প্রচলিত অন্যান্য সকল আইনের ন্যায় সাক্ষ্য আইন একটি সংবিধিবদ্ধ দলিল। এর উপর ভিত্তি করে বিচারকার্য পরিচালিত হয়। বিচারককে সুনিশ্চিত করার জন্য সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। বিচার কার্যের উদ্দেশ্য হলো সত্য প্রতিষ্ঠা করা। সত্য অন্বেষণের স্বার্থেই সাক্ষ্য আইনের প্রয়োজন। দেশে প্রচলিত দেওয়ানি, ফৌজদারী আইন এবং সংবিধানের শব্দ ও বাক্যে সঠিকভাবে উদ্ধারের ও ব্যাখ্যা দানের মাধ্যমে সাক্ষ্য আইনকে কার্যকর করা হয়। সাক্ষ্য আইনের মূল উপাদান হলো সাক্ষী। সাক্ষ্য আইনের বিধান মতে, প্রত্যেক মামলায় তার বিচার্য় বিষয় প্রমাণের জন্য সাক্ষ্য গ্রহণ করা প্রয়োজন। তাই উভয় পক্ষের বক্তব্য শোনার পর বিচারক বিচার্য বিষয় স্থির করেন। স্বভাবতই সংশ্লিষ্ট মামলার পক্ষগণ তাদের ইচ্ছামত কোনো সাক্ষ্য প্রদান করতে পারে না। সাক্ষ্যদানকালীন তাদের সাক্ষ্য আইনের বিধিবদ্ধ বিধান মেনে চলতে হয়। বস্তুতপক্ষে সাক্ষীর উদেশ্য হলো আইনানুগ সাক্ষ্য প্রদান-গ্রহণ করে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা। সাক্ষী সাক্ষ্য প্রদানের মাধ্যমে পক্ষগণের দায়দায়িত্ব, দেনা বা অধিকারসমূহের নিশ্চিয়তা দান করে। মামলা নিম্পত্তি তথা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকল্পে সাক্ষ্যের ভূমিকা সবিশেষে উল্লেখযোগ্য। কারণ মামলা নিষ্পত্তির মূল ভিত্তি হলো সাক্ষ্য। তাদের সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরি। সাক্ষ্য আইনের ১৩২ ধারায় বিধান করা হয়েছে যে, কোন প্রশ্নোত্তর সাক্ষীকে অপরাধ মুক্ত করবে কিংবা উত্তর দিলে তার সাজা হতে পারে, এ অজুহাতে প্রশ্নের উত্তর এডিয়ে যাওয়া যাবে না। তবে এরূপ প্রশ্নের উত্তরের ফলে তাকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। অবশ্য সাক্ষ্য আইনের এই বিধান বৃটিশ সাক্ষ্য আইনের সাথে বিরোধীয়। কারণ, বৃটিশ সাক্ষ্য আইনে অপরাধের সাথে সংযুক্ত হতে পারে কিংবা ফৌজদারী মামলা হওয়ার সম্ভাবনা আছে এরূপ প্রশ্নোত্তর দিতে সাক্ষী বাধ্য নয়। সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে দোষী ব্যক্তিদের বিচারকালীন নিরাপত্তা বা রক্ষাকবচের কথা বলা আছে। এখানেও সংক্ষুব্ধ বা সাক্ষীদের নিরাপত্তার বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। ২০১১ আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে প্রস্তাব আনা হয়েছিল। আইন কমিশন এ প্রস্তাব এনেছে। প্রস্তাবটি বিভিন্ন দেশের ও আন্তর্জাতিক আইনের আলোকে তৈরি করা হয়। জাতিসংঘের ১৯৮৫ সালের সনদটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন (টঘ উবপষধৎধঃরড়হ ড়ভ ইধংরপ চৎরহপরঢ়ষবং ড়ভ ঔঁংঃরপব ভড়ৎ ঠরপঃরসং ড়ভ ঈৎরসব ধহফ অনঁংব ড়ভ চড়বিৎ), নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু নিবারণ আইন ২০১৩, মানব পাচার প্রতিরোধ আইন ২০১২, শিশু আইন ২০১৩। এই আইনসমূহে ভিকটিম ও সাক্ষীদের সুরক্ষার বিষয়ে কিছু দিক নির্দেশনা রয়েছে। সরকার ২০১১ সালে ‘সাক্ষী সুরক্ষা আইন’ শিরোনামে আইনটি তৈরির উদ্যোগ নেয় এবং জাতীয় আইন কমিশন এ সংক্রান্ত আইন তৈরির খসড়া পাঠায়। ২০০৬ সালে ভিকটিম ও সাক্ষী সুরক্ষা আইনের খসড়া উপস্থাপন করা হয় এবং ২০১১ সালে উক্ত আইন প্রয়োগে বিস্তারিত সুপারিশ হিসাবে ১৯ দফা সুপারিশ করলেও অদ্যাবধি তা আলোর মুখ দেখেনি। কমিশন তার সুপারিশমালায় সুরক্ষার অধিকার, সুরক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে তথ্য জানার অধিকার, সুরক্ষা বিষয়ে জাতীয় নীতিমালা কর্মসূচি ও বাস্তবায়ন সংস্থা, সুরক্ষা প্রোগ্রামে অন্তর্ভুক্তির আবেদন, আবেদনের শর্তাবলী, সুরক্ষাপ্রাপ্ত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি (ভিকটিম) বা সাক্ষীর অধিকার, সাক্ষীদের অধিকার ভোগ নিশ্চিত করা, সাক্ষীর অঙ্গীকার, সাক্ষীর নিরাপত্তা উল্লেখ করে।

অপরাধীদের দৌরাত্ম্য কমানো, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে সাক্ষীর সুরক্ষার বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। কেননা, সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে বাধার সম্মুখীন হতে হবে। এর ফলে মামলার অভিযোগ প্রমাণ করাও কষ্টসাধ্য হবে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে ভবিষ্যতে কোনো সাক্ষী মামলার সাক্ষ্য দিতে আসবে না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সাক্ষীর সুরক্ষায় উন্নত আইন রয়েছে। কোনো মামলায় সাক্ষী কেন আসেনি, জানা দরকার। সাক্ষীরা একটি মামলার গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। যাতে নির্বিঘ্নে-নির্ভয়ে সাক্ষ্য দিতে পারে এবং তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে সময়োপযোগী আইন প্রণয়ন করা দরকার। স্পর্শকাতর মামলা প্রমাণে সাক্ষীর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন। সম্প্রতি জাতীয় সংসদের এক অধিবেশনে আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী সাক্ষীদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষায় আইন করার বিষয়টি সরকারের বিবেচনাধীন বলে জানিয়েছেন। যত তাড়াতাড়ি এ আইন প্রণয়ন করা যায়, ততই কল্যাণ।
লেখক: আইনবিদ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন