পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে বিভিন্ন সময়ে অগ্রহণযোগ্য ও বেফাঁস মন্তব্য করেছেন। কয়েক বছর আগে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ককে ‘স্বামী-স্ত্রী’র সম্পর্ক বলে অভিহিত করেছিলেন। এ নিয়ে তখন দেশের মানুষ ব্যাপক সমালোচনা করে। এতে তিনি ক্ষান্ত হননি। একের পর এক বিভিন্ন বক্তব্য দিয়ে গেছেন। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম শহরের জেএমসেন হলে জন্মাষ্টমী উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে যে মন্তব্য করেছেন, তা ভয়ংকর শুধু নয়, দেশের আত্মমর্যাদাকে ভুলুণ্ঠিত করার শামিল। তিনি বলেছেন, ‘আমি ভারতে গিয়ে বলেছি, শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। শেখ হাসিনা আমাদের আদর্শ। তাকে টিকিয়ে রাখতে পারলে আমাদের দেশ উন্নয়নের দিকে যাবে এবং সত্যিকারের সাম্প্রদায়িকতামুক্ত, অসাম্প্রদায়িক একটা দেশ হবে। শেখ হাসিনা সরকাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করা দরকার, আমি ভারতবর্ষের সরকারকে সেটা করতে অনুরোধ করেছি।’ তার এমন বক্তব্যে সচেতন মহল থেকে শুরু করে নেটিজেনরা ক্ষব্ধ ও বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তার এ বক্তব্য ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’তে পরিণত হয়েছে। প্রত্যেকেই এ মত ব্যক্ত করেছেন, একটি স্বাধীন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে কি করে তিনি আরেকটি দেশের কাছে সরকার টিকিয়ে রাখতে অনুরোধ করেন! আমাদের স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদাকে ধুলোয় লুটিয়ে দেয়ার নামান্তর ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে?
অপ্রিয় হলেও বাস্তবতা হচ্ছে, বর্তমান সরকারের মধ্যে ভারত তোষণ নীতি প্রবলভাবে বিদ্যমান। জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে হলেও ভারতের স্বার্থ সংরক্ষণে তৎপর দেখা যায়। ভারত এ পর্যন্ত যা চেয়েছে, তাই দেয়া হয়েছে। বিনিময়ে আমরা তার কাছ থেকে কিছুই পাইনি। এমনকি আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব নিয়ে ভারত সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের একের পর এক বক্তব্যের প্রতিবাদও করা হয়নি। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, ভারতের প্রতি সরকার এমন নতজানু আচরণ প্রদর্শন করছে তার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। অনেকেরই স্মরণ আছে, ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন যখন অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে না এবং সকল রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচন করতে অনিচ্ছুক, তখন ভারতের সে সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুজাতা সিং এসে নির্বাচন কিভাবে করতে হবে, এমন প্রেসক্রিপশন দিয়ে যান। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নির্বাচনে না যাওয়ার জন্য দৃঢ় অবস্থান নিলেও তাকে রাতারাতি রাজি করিয়ে ফেলা হয়। এর নেপথ্যে যে বর্তমান সরকারকে টিকিয়ে রাখার ভারত সরকারের কৌশল ছিল, তা সকলেরই জানা। এ নিয়ে অনেক সমালোচনা হলেও সরকারের তরফ থেকে কোনো ধরনের প্রতিবাদ বা বক্তব্য না দেয়ায় বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন থেকেই ভারতের প্রতি বর্তমান সরকারের অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠে। পরবর্তীতে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্ককে বর্তমান সরকারের মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে নেতা-কর্মী এমন সব বিশেষণে অভিহিত করতে থাকেন যে, যেন তাদের ক্ষমতায় থাকার গ্যারান্টি একমাত্র ভারত। রক্তের বন্ধনে ও রাখি বন্ধনে আবদ্ধ, সর্বকালের সবচেয়ে উন্নত সম্পর্ক, অনন্য উচ্চতার সম্পর্ক থেকে শুরু করে এমন সব মন্তব্যের মাধ্যমে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ককে তুলে ধরা হয়। গত বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে আরও স্পষ্ট হয়েছে, সরকারের থাকা ও না থাকা এবং ক্ষমতায় আসা ও যাওয়ার বিষয়টি নির্ভর করছে শুধু ভারতের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর। তার এ কথা থেকে এটা প্রতীয়মান হয়, জনগণের প্রতি, গণতন্ত্রের প্রতি তার ন্যূনতম আস্তা নেই। যদি ভারতই ক্ষমতায় থাকার গ্যারান্টি হয়ে থাকে, তাহলে নির্বাচন কমিশন, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে বিরোধীদলের নির্বাচন করার দাবী, বিরোধীদলের রাজনীতি-এসব কোনো কিছুরই প্রয়োজন পড়ে না। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বক্তব্য দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য অত্যন্ত অবমাননাকর। ক্ষমতায় থাকার জন্য মানুষ কতটা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়তে পারে, এটা তার সাক্ষ্য বহন করে। দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা ও দেশপ্রেম থাকলে কোনো মানুষ এ ধরনের কথা বলতে পারে না। তিনি ও তার বড় ভাই সাবেক অর্থমন্ত্রী এম এ মুহিত তাদের নিজ জেলা সিলেটের জন্যও ন্যূনতম দায়বদ্ধতা বোধ করেননি এবারের ভয়াবহ বন্যায় তা প্রমানিত হয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনের এ ধরনের অবমাননাকর বক্তব্য কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হয়ে এ ধরনের মন্তব্য অত্যন্ত গর্হিত ও ভয়ানক। এ মন্তব্য শুধু দেশের অসম্মান নয়, জনগণকেও অপমান করার শামিল। অন্য যেকোনো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন দেশের কোনো মন্ত্রী এ ধরনের মন্তব্য করলে সাথে সাথে তাকে সরিয়ে দেয়া হতো। আমাদের দেশেই এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। দেশের জন্য অসম্মানজনক ও অমর্যাদাকর মন্তব্য করলেও তারা বহাল তবিয়তে থেকে যান। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ ধরনের মন্তব্যের জন্য অবিলম্বে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ। সরকারের তরফ থেকে এ বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেয়াও জরুরি। যদি তা না করা হয়, তবে ধরে নিতে হবে এ বক্তব্যের সাথে সরকারের সায় রয়েছে। এটি সরকারের বক্তব্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। এ ধারণাও প্রতিষ্ঠিত হবে, সরকার ক্ষমতায় থাকার জন্য জনগণের মতামতের উপর নির্ভরশীল নয়, ভারতের সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন