একমাসের বেশী সময় ধরে রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের সরকারী বাহিনীর নির্মম গণহত্যা অব্যাহত থাকলেও জাতিসংঘ ও বিশ্বসম্প্রদায় নিধিরাম সর্দারের ভূমিকা পালন করছে। তবে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য বর্ডার খুলে দিয়ে মানবিক আশ্রয় দিতে জাতিসংঘের তরফ থেকে এরই মধ্যে একাধিকবার বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। রোহিঙ্গা নৃগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করতে মিয়ানমারের সরকারী বাহিনী প্রকাশ্য গণহত্যা বা এথনিক ক্লিনজিং চালিয়ে যাচ্ছে। নিরস্ত্র সাধারণ দরিদ্র মানুষগুলোর বাড়িঘরে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিচ্ছে। যুবক ও শিশুদের ধরে বীভৎস কায়দায় নির্যাতন করে হত্যা করছে। নারীদের ধর্ষণ করার পর হত্যা করছে। মিয়ানমারের সেনারা হেলিকপ্টার গানশিপ দিয়ে রাখাইন গ্রামগুলোতে বৃষ্টির মত গুলিবর্ষণই করছে না পলায়নপর লোকদের ওপরও গুলিবর্ষণ করছে, হত্যা করছে। গণমাধ্যমগুলোর বিস্ময়কর নীরবতার মধ্যেও কেউ কেউ এসব কর্মকা-কে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সরকারের যুদ্ধঘোষণা বলে অভিহিত করেছে। দশকের পর দশক ধরে নাগরিক স্বীকৃতিহীন ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অধিকার বঞ্চিত পশ্চাৎপদ একটি সুসভ্য সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করার এই জাহেলিয়াতের বিরুদ্ধে বিশ্বের মুসলমানরা ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত হলেও বিস্ময়করভাবে মুসলিম দেশগুলো বা ওআইসি’র মত সংস্থাও যথাযথ কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ইতিহাস-ঐতিহ্য হাজার বছরের। ষোড়শ শতকে রাখাইন রাজ্য বাংলাদেশের কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। এ কারণেই রাখাইনের মুসলমানদের সাথে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের স্থানীয়দের ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির এক ধরনের মেলবন্ধন ঘটেছিল। রাখাইনের বৌদ্ধ মগদের সাথে রোহিঙ্গাদের এই ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক পার্থক্য তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে রোহিঙ্গারা তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও জাতিগত স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় সর্বদাই আপসহীন রয়েছে। ব্রিটিশ শাসনামলেই রাখাইন মুসলমানরা জাতিগত বৈষম্যের শিকার হয়েছিল। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে বার্মিজ শাসকরা সে ধারা অব্যাহত রাখে। সে দেশে সামরিক জান্তার শাসন কায়েম হওয়ার পর বৌদ্ধ মগদের মুসলিম বিদ্বেষকে কাজে লাগিয়ে সামরিক শাসকরাও নিজেদের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে রোহিঙ্গা বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে। এমনকি সেনাশাসকদের হাতে কারা নির্যাতিত মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক নেত্রী, শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত অং সান সুচির এনএলডি সরকার ক্ষমতায় আসার পরও মিয়ানমারের সেনাবাহিনী নতুন করে রোহিঙ্গা নিধনে মেতে উঠেছে। গণতন্ত্র, মানবাধিকারের ধ্বজাধারী পশ্চিমা শাসকরা বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে পূর্ব তিমুর বা দক্ষিণ সুদানের মত ক্ষুদ্র খ্রিস্টান জাতিগোষ্ঠীর স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার জন্য অতি উৎসাহী ভূমিকা পালন করলেও স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের জন্য দশকের পর দশক ধরে সংগ্রামরত মুসলমানদের জন্য যেন তাদের কোন দায় নেই।
গতকাল প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর রোহিঙ্গা বিরোধী অভিযান অব্যাহত রয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার রোহিঙ্গা পরিবার প্রাণভয়ে বাংলাদেশসহ আশপাশের দেশগুলোতে আশ্রয়ের জন্য ছুটছে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় না দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত থাকার পরও ইতিমধ্যে অন্তত ১০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে বলে জানা যায়। তবে নাফ নদী পেরিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অনেক নৌকা বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীরা ফিরিয়ে দিচ্ছে বলেও খবর প্রকাশিত হয়েছে। অন্যদিকে মিয়ানমারের সীমান্ত পুলিশ বিজিপি রোহিঙ্গাদের সেখান থেকে শুধু পালিয়ে যেতেই বাধ্য করছে না, তারা নদীতে পলায়নপর রোহিঙ্গাদের নৌকায় নির্বিচার গুলি চালাতেও দ্বিধা করছে না। এহেন বাস্তবতায় জাতিসংঘসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এসব রোহিঙ্গা শরণার্থীর সাহায্যে ত্রাণ তৎপরতা চালাতে বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদন ও সমর্থনের আহ্বান জানিয়েছে। বিশেষত, নাফ নদীতে ভাসমান অথবা প্রাণভয়ে জঙ্গলে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গা শরণার্থীরা এখন খাদ্যাভাব, ওষুধ ও শীতবস্ত্রের অভাবে বিপন্ন হয়ে পড়েছে। তাদের বাঁচাতে মানবিক সহায়তার কথা বলা হচ্ছে। একদিকে সামরিক বাহিনীর গণহত্যার টার্গেট, অন্যদিকে বৈরী পরিস্থিতির সম্মুখীন রোহিঙ্গাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া আমাদের এবং বিশ্বসম্প্রদায়ের একটি মানবিক দায়িত্ব। তবে সাময়িক আশ্রয় দিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান অতীতে হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এবং বর্তমান সরকারকে অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। ইতিমধ্যে চীন সরকার সামরিক শক্তির পথ পরিহার করে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে। ইতিপূর্বে জাতিসংঘের আহ্বানে সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত একটি কমিটি রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কাজ শুরু করেছিল। সেই কমিটিও উগ্রবাদী বৌদ্ধদের বৈরিতার সম্মুখীন হয়েছে। মূলত সেই কমিটি কাজ শুরু করার পর থেকেই সেখানে নতুন করে রোহিঙ্গা নিধন শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে কয়েক হাজার মৃত্যু ও লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাস্তচ্যুত হয়েছে। মানুষ হিসেবে, রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে, সভ্য দুনিয়ার মুক্ত আদম সন্তান হিসেবে তাদের মানবাধিকার ও নিরাপত্তার দাবী আর কতকাল অগ্রাহ্য হবে? দশকের পর দশক ধরে লাখ লাখ রোহিঙ্গা অভিবাসীর বোঝা বহন করছে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ। এবার সকলের সম্মিলিত উদ্যোগে রোহিঙ্গা সমস্যার একটি স্থায়ী ও গ্রহণযোগ্য সমাধানের দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন