রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

রডসহ নির্মাণসামগ্রীর মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২২ আগস্ট, ২০২২, ১২:০০ এএম

রডের দাম সর্বকালের রেকর্ড ছুঁয়েছে। গত বৃহস্পতিবার প্রতিটন ৭৫ গ্রেডের এম এস রড মিলগেটে বিক্রী হয়েছে হাজার ৯০ থেকে ৯৩ হাজার টাকায়। গত সপ্তাহের তুলনায় এটা প্রায় ৫ হাজার টাকা বেশি। অটো অথবা সেমিঅটো মিলে উৎপাদিত ৬০ গ্রেডের এম এস রডের দামও প্রতিটনে ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা বেড়েছে। রডের দামে এই ঊর্ধ্বলম্ফ অস্বাভাবিক এবং তা সরকারের চলমান উন্নয়ন কাজ ও বেসরকারি আবাসন খাতকে বড় ধরনের বিপাকে ফেলবে বলে পর্যবেক্ষকরা আশংকা করছেন। রড, বালু, সিমেন্ট, ইট প্রভৃতি নির্মাণ-উপকরণের যে-কোনো একটির দাম বাড়লে অন্যগুলোরও দাম বাড়ে। এটা আমাদের দেশে একটা সাধারণ প্রবণতা। তাই ধরেই নেয়া যায়, অন্যান্য উপকরণের দামও রডের পদাংঙ্ক অনুসরণ করবে এবং তাতে সরকারি-বেসরকারি নির্মাণ ও আবাসন খাত মারাত্মক হুমকিতে পতিত হবে। হঠাৎ রডের দাম এত বাড়ার কারণ সম্পর্কে রড কারখানার মালিকদের বক্তব্য: ডলার সংকটেজনিত কারণে আমদানির কড়াকড়িতে রডের প্রধান কাঁচামালা স্ক্র্যাপের আমদানি কমে গেছে। অন্যদিকে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবও রয়েছে। তাদের মতে, স্থানীয় বাজারে স্ক্র্যাপ, প্লেট ও বিলেটের দাম বেড়েছে টনে অন্তত ৫ হাজার টাকা। গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি ও সংকটের কথাও কারো অজানা নেই। এমতাবস্থায়, রডের দাম বাড়া অস্বাভাবিক নয়। ব্যবসায়ীরা অবশ্য তাদের সঙ্গে একমত নয়। ব্যবসায়ীদের মতে, কারখানা-মালিকেরা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে স্ক্র্যাপের দাম বৃদ্ধি, আমদানিতে প্রতিবন্ধকতা, স্থানীয় বাজারে রডের কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি এবং জ্বালানিমূল্য ও সংকটের কারণে রডের দাম বাড়তে পারে, তবে এতটা কখনোই নয়। বলা বাহুল্য, এটা এক অনিঃশেষ বির্তক। এ বিতর্ক শেষ হবার নয়। নিরেট সত্য তো এই যে, রডের দাম বেড়েছে বা বাড়ছে, অন্যান্য নির্মাণসামগ্রীর দামও বাড়তির দিকে। কীভাবে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করা যায়, সেটাই এখন প্রধান বিবেচ্য।

সরকারি আবাসন ও নির্মাণ খাত একটি বিশাল খাত। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প এখন বাস্তবায়িত হচ্ছে। নতুন নতুন প্রকল্পও নেওয়া হচ্ছে। এসব প্রকল্প নির্দিষ্ট সময়েও ব্যয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, সরকারি প্রায় কোনো খাতের প্রকল্প বা কাজই নির্ধারিত সময়ে শেষ হয় না। প্রাক্কলিত অর্থেও শেষ হয় না। এজন্য সময় বাড়াতে হয়, বাজেট বাড়াতে হয়। এই বিলম্বও অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রধান কারণ। বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের কাজের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, প্রকল্পের অনুমোদন, অর্থছাড় ও কাজ শুরুর দায়িত্ব যেসব কর্তৃপক্ষের ওপর, তারা যথাসময়ে দায়িত্ব পালন করে না। কোনো প্রকল্প বা কাজ শুরু হতে যত সময় ব্যয় হয়, ততই নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ে, অন্যান্য ব্যয়ও বাড়ে। এমনও দেখা গেছে, কোনো কোনো প্রকল্প বা কাজ শুরু হওয়ার আগেই ব্যয়বরাদ্দ নতুন করে বাড়াতে হয়েছে। এতে প্রধানত: দুটি ক্ষতি হয়। প্রথমত: সরকারি বা রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় হয়। দ্বিতীয়ত: প্রকল্প বা কাজের সুবিধা থেকে মানুষ অধিক দিন বঞ্চিত থেকে যায়। আরো একটি বিষয়, এতে দুর্নীতি উৎসাহিত হয়। বিভিন্ন অজুহাতে সরকারি অর্থের লুণ্ঠন চলে। আবার এতে কাজেরও ব্যাঘাত ঘটে। প্রকল্প বাস্তবায়নের মাঝখানে ব্যয় বাড়াতে হলে নানা ঝামেলা হয়। কখনো কখনো কাজ আটকে থাকে। সাধারণত প্রকল্প সংশোধন বা প্রকল্পের নতুন বিষয় সংযোজন এবং নির্মাণ-উপকরণের মূল্য বৃদ্ধির দোহাই দিয়েই প্রকল্প বা কাজের ব্যয়বরাদ্দ বাড়ানো হয়। একবারই শুধু নয়, বহুবার বাড়ানো হয়। তাতে প্রকল্পের প্রথমে প্রাক্কলিত ব্যয় অপেক্ষা কয়েকগুণ বেশি ব্যয় দাঁড়িয়ে যায়। এই ক্ষতির খেসারত দিতে হয় আসলে দেশের মানুষকে। অথচ, প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতা ও কাজের সমন্বয় থাকলে এবং অনিয়ম ও দুর্নীতির পথ রুদ্ধ হলে এমনটি হওয়ার কথা নয়।

বেসরকারি খাতের রিয়েল এস্টেট ও হাউজিং খাতের ব্যাপকত্ব ও বিশালত্ব সম্পর্কে আমরা অবহিত। এখাতে হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। লাখ লাখ শ্রমিক ও কর্মচারীর কর্মসংস্থান রয়েছে এখানে। সবার জন্য আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করার রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার বাস্তবায়নে কাজ করছে এ খাতের বিনিয়োগকারীরা। তাছাড়া এ খাতনির্ভর বিভিন্ন উদ্যোগ ও শিল্পের সংখ্যাও কম নয়। এসব ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজেও লাখ লাখ লোক কাজ করছে। সঙ্গত কারণে রড, সিমেন্ট, বালু, ইট প্রভৃতির দাম বাড়লে ফ্ল্যাট নির্মাণের ব্যয়ও বাড়ে। ফ্ল্যাটের মালিকদেরও অসুবিধায় পড়তে হয়। রডের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে রিহ্যাবের সভাপতি ইনকিলাবকে বলেছেন, আমরা আবাসন সংশ্লিষ্টরা বিপাকে আছি, হিমশিম খাচ্ছি। কারণ, আমাদের বিক্রী আগে, তারপর নির্মাণ করে গ্রাহককে হস্তান্তর। তৈরির ৬ মাস আগেই অধিকাংশ ফ্ল্যাট বিক্রী করা হয়েছে। সব কিছুর দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে কীভাবে এটা সমন্বয় করা যাবে, সেটা নিয়েই আমরা বিপাকে। এটা একটা অনিবার্য বাস্তবতা ও সংকট। এই বাস্তবতা ও সংকটের মুখোমুখী হতে হতো না, যদি নির্মাণসামগ্রীর মূল্য স্থিতিশীল থাকতো। নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য সামান্য এদিক-সেদিক হলেও হয়তো কাউকেই তেমন একটা ভাবতে হতো না। কিন্তু বড় বৃদ্ধি আবাসন ব্যবসায়ী ও ফ্ল্যাটের মালিক উভয়কেই ভাবনায় ফেলছে, তাতে সন্দেহ নেই। এই পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বেসরকারি আবাসন খাতে শ্লথতা নেমে আসতে পারে। কাজকর্মে ও বিক্রীতে টান পড়তে পারে। সেক্ষেত্রে খাতসংশ্লিষ্ট সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এই দুদির্নে, যখন জ্বালানি নিরাপত্তা ও খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে, সাধারণ মানুষের জীবনযাপন অত্যন্ত কঠিন অবস্থায় পতিত, তখন ব্যাপক কর্মসংস্থানদায়ী এত বড় আবাসন খাতের দুরাবস্থা বাঞ্ছনীয় হতে পারে না। আমরা আশা করবো, সরকার নির্মাণসামগ্রীর মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও যুক্তিসঙ্গত পর্যায়ে স্থিতিশীল করার প্রয়োজনীয় কার্যব্যবস্থা অবিলম্বে গ্রহণ করবে।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন