শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব

ড. মোহাম্মদ আবু তাহের | প্রকাশের সময় : ২৩ আগস্ট, ২০২২, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশে পরিবেশের অবক্ষয় ও দূষণ একটি বড় সমস্যা। বন্যা, খরা ও ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ আবহাওয়ার অস্থিরতাসহ অন্যান্য পরিবেশগত সমস্যা এখন মানুষের নিত্যপাঠ। এসবের মূলে মানুষের কর্মকাণ্ডই প্রধানত দায়ী। যথেচ্ছ বৃক্ষ নিধন, অধিক জনসংখ্যা, দারিদ্র, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, জোরালো শব্দের হর্ন, আবাসিক এলাকায় শিল্পকারখানা ও ইটভাটার অবস্থান ইত্যাদি পরিবেশকে দূষিত করছে। পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার কারণে জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিবেশগত ঝুঁকির মধ্যেই আছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেশের নিরাপত্তা ও অর্থনীতি এখন হুমকির মুখে। দেশে এখনও বন্ধ হয়নি পলিথিনের ব্যবহার। নিষিদ্ধ ঘোষিত পলিথিনের ব্যবহারের কারণে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। নিয়ন্ত্রণহীনতার সুযোগ নিয়ে কিছু অসাধু মানুষ নিষিদ্ধ পলিথিন উৎপাদন করে চলছে। পলিথিন ব্যবহার করে যেখানে সেখানে ফেলে দেয়া হচ্ছে। সেগুলো পানিবাহিত হয়ে ড্রেনে গিয়ে পড়ছে। ক্রমাগতভাবে ড্রেন বন্ধ হয়ে এক সময় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে মারাত্মকভাবে। বায়ুদূষণে ফিটনেসবিহীন যানবাহন মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এসব নিম্নমানের গাড়ি আমাদের পরিবেশকে ধুলিময় করে তোলে, যা স্বাস্থ্যের জন্যও অত্যন্ত ক্ষতিকর। তাছাড়া ফিটনেসবিহীন গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা দুরূহ হওয়ায় মারাত্মক দুর্ঘটনায় প্রায় প্রতিদিনই মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। সম্পদ ও প্রাচুর্যে পিছিয়ে থাকলেও বিশ্বের উন্নত দেশসমূহকে পিছনে ফেলে শান্তিপ্রিয় মানুষের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে ভুটান। সেই দেশের নাগরিকদের মধ্যে আইন মেনে চলার প্রবণতা খুব বেশি। সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, যত জনবহুল জায়গাই হোক, সবখানেই নীরবতা একটা শান্তি শান্তি ভাব, কোথাও ধুলাবালি কিংবা ময়লা আবর্জনা জমে থাকতে দেখা যায় না। এই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার পেছনে মূল কারণ হচ্ছে পরিচ্ছন্নতা নিয়ে ভুটানে কঠোর আইন রয়েছে। আইনের বাস্তবায়ন রয়েছে। ময়লা-আবর্জনা রাস্তায় ফেললে মোটা অংকের জরিমানা গুণতে হয়। বিপন্ন পরিবেশের প্রভাব থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হলে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদী বহুমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। ১৯৭২ সালে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে মানব পরিবেশ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক। সম্মেলনে পরিবেশের অবনতির জন্য প্রধান দুটি কারণকে চিহ্নিত করা হয়। কারণ দুটি হলো: ১. উন্নত দেশগুলোতে অপরিকল্পিত আর্থিক উন্নয়ন, অতিভোগ ও অপব্যয়, ২. উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিরাজমান দারিদ্র্য। ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও-ডি-জেনিরো শহরে ধরিত্রী শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য শিল্পোন্নত দেশের অভিযোগ ও উন্নয়নশীল দেশের চরম দারিদ্রদের কথাই পুনরায় বলা হয়। এতে বোঝা যায়, পৃথিবীর আর্থিক ও সামাজিক ভারসাম্য পুনরুদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত বিপন্ন পরিবেশের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা এবং জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকি মোকাবেলা করা সম্ভব নয়।

জলবায়ু পরিবর্তনে বাড়ছে বৈশ্বিক তাপদাহ, যার কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা দুষছেন মানুষের সৃষ্ট বিপর্যয়কে। বর্তমান বিশ্বের উষ্ণতার কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, কয়লা, তেল ও গ্যাস পোড়ানোর ফলে কার্বন ডাই অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড উৎপন্ন হচ্ছে। অপরদিকে গাছ বায়ুমন্ডল থেকে প্রতিনিয়ত কার্বন ডাই অক্সাইড এবং নাইট্রাস অক্সাইড শোষণ করে তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। কিন্তু মানুষ দিন দিন বন উজাড় করে চলেছে। ফলে বিষাক্ত গ্যাস শোষণের সম্ভাবনা রূপ নিয়েছে সংকটে, যার প্রভাব পড়ছে প্রকৃতিতে। ১৯৪৮ থেকে ২০২২ সালের আবহাওয়ার তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ৭০ থেকে ৭৪ বছরের ইতিহাসে জুলাই(২০২২) মাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শুধু বাংলাদেশ নয়, ইউরোপসহ অর্ধেক পৃথিবীই এখন দাবদাহ ও দাবানলে পুড়ছে। যুক্তরাজ্যসহ পাঁচটি দেশে ইতোমধ্যে জরুরি অবস্থাও জারি করা হয়েছে।

এখন পৃথিবীতে চলছে অন্যরকম পরিস্থিতি। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসে পৃথিবীর। লক্ষ লক্ষ মানুষ মরেছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, বায়ুদূষণে করোনার মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি। বায়ুদূষণ শ্বাসকষ্ঠজনিত সমস্যার ঝুঁকি বাড়ায়, যা করোনাভাইরাস সংক্রমিত রোগীর জন্য মারাত্মক হতে পারে। এই ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মৃত্যুহারের সঙ্গে বায়ুদূষণের সম্পর্ক রয়েছে বলে এক বিশ্লেষণে উঠে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনের হার্ভার্ড টি এইচ চ্যান স্কুল অব পাবলিক হেলথের গবেষকরা এ তথ্য জানিয়েছেন। গবেষকরা দাবি করেছেন, দেশজুড়ে বিষাক্ত বায়ুস্তরের বিশাল পার্থক্যের পরিপ্রেক্ষিতে গবেষণাটি প্রমাণ করেছে যে, দূষিত বায়ু অঞ্চলের লোকের তুলনায় তুলনামূলকভাবে কম দূষিত বায়ু অঞ্চলে বসবাসকারীদের মারা যাওয়ার আশংকা কম। ইতালির পরিস্থিতি নিয়ে গবেষকরা পৃথক একটি গবেষণা করেছেন। ওই গবেষণায় দেখা গেছে, দেশটির উত্তরাঞ্চলে উচ্চ মৃত্যু হারের সঙ্গে বায়ুদূষণের সর্বোচ্চ স্তরের বিষয়টি সম্পর্কিত।

সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রতিবছর যতো মানুষের মৃত্যু হয় তার ২৮ শতাংশই মারা যায় পরিবেশ দূষণজনিত অসুখ-বিসুখে। কিন্তু সারা বিশ্বে এ ধরণের মৃত্যুর গড় মাত্র ১৬ শতাংশ। পরিবেশ দূষণের কারণে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধিও এখন হুমকির মুখে। এজন্য বিশ্বব্যাংক জলাভূমি দখল ক্ষতিকর বর্জ্য ঠিকমত না ফেলা ইত্যাদিকে দায়ী করেছে। বেশ কয়েকবছর পূর্বে বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রকাশিত বিশ্বের ৯০ জন পরিবেশ বিজ্ঞানী কর্তৃক প্রস্তুতকৃত এক বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদনে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশংকার কথা বলা হয়েছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়, তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে আবহাওয়া চরম আকার ধারণ করবে, তীব্রমাত্রার সাইক্লোন হবে। ফলে খাদ্য উৎপাদন জীবিকা ও অবকাঠামো হুমকির মুখে পড়বে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশই বেশি ক্ষতির শিকার হবে। এতে আরও বলা হয়, ২০৫০ সালে সিডর এর মতো সাইক্লোনে তিন মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। এতে প্রায় ৯৭ লাখ মানুষের জীবন ও জীবিকা হুমকির মুখে পড়তে পারে। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে গরীবরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফসল উৎপাদন কমে যেতে পারে, ফলে গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসন বাড়তে পারে। এজন্যই এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে পরিবেশের উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ অপরিহার্য। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলার কার্যকর পরিকল্পনা নিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকি ও পরিবেশের বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে হলে সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চালাতে হবে। বৃক্ষনিধন, প্রাকৃতিক জলাশয় ভরাট থেকে বিরত থাকতে হবে। কৃষি জমিতে রাসায়নিক সার, কীটনাশক ব্যবহার কমাতে হবে। নদীনালা-খালবিলে শিল্প ও পয়োবর্জ্য ফেলা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে। শিল্পকারখানায় উৎপাদিত বর্জ্যগুলোকে উৎপাদনশীল উপকরণে পরিণত করতে হবে। পরিকল্পিত নগরায়ন করতে হবে। দেশের সর্বত্র বেশি করে বনজ, ফলজ বৃক্ষরাজি সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে বড় করে তুলতে হবে। ইউনিসেফের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে ১ কোটি ১০ লাখ শিশু, যাদের বসবাস বাংলাদেশের নদীতীরবর্তী এলাকায়। তাদের ক্ষেত্রে নদীভাঙ্গন একটি নিয়মিত ব্যাপার।

পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়নে সুপারিশ:
(১) সব জাতীয় সম্পদের টেকসই উন্নয়ন এবং পরিবেশবান্ধব ব্যবহার বিষয়ে সমন্বিত সচেতনতার জন্য পরিবেশ সংক্রান্ত জ্ঞান ও আইন সম্পর্কে সচেতন করে তোলার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ।

(২) গণমাধ্যমকে সম্পৃক্ত করে এবং এনজিওগুলোর মাধ্যমে জনগণের সচেতনতা তৈরির কাজ অব্যাহত রাখা।

(৩) পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ত্বরিত প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দেশের প্রতিটি জেলায় একটি করে পরিবেশ আদালত স্থাপন।

(৪) প্রতিটি বিভাগে একটি করে পরিবেশ আপিল আদালত স্থাপন।

(৫) পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালায় যথাযথ প্রয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ।


(৬) অবৈধ পলিথিন ব্যবহার ও বিক্রি বন্ধে সারাদেশে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে অভিযান জোরদার করতে হবে।


লেখক: ব্যাংকার, গবেষক ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন