জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য সারাদেশে দিনে একবার এক ঘণ্টা লোডশেডিং করার ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। অন্যদিকে শিল্পনগরী এলাকায় সপ্তাহে একদিন শিল্প-প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার কথা বলা হয়। সে মোতাবেক প্রতিটি বিতরণ কোম্পানিকে লোডশেডিংয়ের শিডিউল ঘোষণার নির্দেশ দেয়া হয়। বিতরণ কোম্পানিগুলো শিডিউলও ঘোষণা করে। কিন্তু ঘোষণা অনুযায়ী শুরু থেকেই দেশের কোথাও শিডিউল মানা হয়নি। দিনে একবার এক ঘণ্টা লোডশেডিং কিংবা এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং কোনোটাই কার্যকর হয়নি। সারাদেশে যথেচ্ছ লোডশেডিং করা হচ্ছে। এক ঘণ্টা থেকে ১৩ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হচ্ছে। এক্ষেত্রে শহরে ও গ্রামে খুব একটা তারতম্য বা পার্থক্য নেই। রাজধানীতে দিনে-রাতে ৫/৬ বার করে লোডশেডিং করা হচ্ছে। গ্রামে কোনো কানো এলাকায় ১২/১৩ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ থাকছে না। লোডশেডিংয়ের এহেন দৌরাত্ম্যে এই প্রচণ্ড রোদ ও গরমের সময়ে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ। অফিস-আদালত, বাসা-বাড়ি কোথাও এতটুকু স্বস্তি নেই। কৃষি-শিল্পের উৎপাদন, পানি সরবরাহ ইত্যাদি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। পানি ও সারের অভাবে আমনের আবাদ ব্যাপকভাবে ক্ষতির শিকার হতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ চালিত সেচযন্ত্র বিদ্যুতের অভাবে সারাদিনের অধিকাংশ সময় বন্ধ থাকছে। ওদিকে সারের দাম ও সংকট এত বেশি যে, বর্ধিত দাম দেয়ার সামর্থ্য যাদের আছে, তাদের পক্ষেও সার পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। দেশে হাজার হাজার ছোট-মাঝারি ও বড় শিল্প-কারখানা আছে। এসব শিল্প-কারখানায় লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ইপিজেড ও রফতানিমুখী গামেন্টসহ অন্যান্য শিল্প-কারখানার উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মানে যে রফতানি ব্যাহত বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, তা বলাই বাহুল্য।
আমাদের সবচেয়ে বেশি রফতানি আয় আসে গার্মেন্ট থেকে। সেই গার্মেন্টের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, সাভার, ধামরাই, গাজীপুর প্রভৃতি এলাকায় গার্মেন্ট শিল্প-কারখানায় বিদ্যুতের অভাবে উৎপাদন কম হচ্ছে। কোথাও কোথাও সম্পূর্ণ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এমনিতেই গার্মেন্ট রফতানি কমছে। বিশ্বের বড় বড় আমদানিকারক কোম্পানি আমদানি কমিয়ে দিচ্ছে। কোনো কোনো কোম্পানি আমদানির অর্ডার বাতিল পর্যন্ত করে দিচ্ছে। এ অবস্থায় শিডিউল মতো উৎপাদন ও রফতানি না করতে পারলে উৎপাদনকারী ও রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান বিপাকে পড়বে এবং ক্ষতির সম্মুখীন হবে। একথা স্মরণ রাখা দরকার, আমরা গার্মেন্টপণ্য রফতানিতে শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে যে রয়েছি, তার কারণ, এখানে শ্রমমূল্য কম এবং উৎপাদন খরচও কম। আমরা কম দামে দিতে পারি বলেই ক্রেতাদের আগ্রহ আমাদের প্রতি বেশি। গার্মেন্ট কারখানার মালিকদের বক্তব্য: বিদ্যুতের অভাব থাকায় কারখানা চালু রাখতে জেনারেটর চালু রাখতে হচ্ছে। ডিজেলের দাম সাম্প্রতিককালে বড় হারে বাড়ানোর ফলে জেনারেটরের খরচ বেড়েছে, যা উৎপাদন খরচের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। অথচ গার্মেন্টপণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়েনি, বরং কমেছে। ক্রেতারা দাম কমানোর জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছে। এই সার্বিক পরিস্থিতি গার্মেন্ট শিল্পের ও রফতানির জন্য মোটেই অনুকূল নয়। অন্যান্য শিল্পপণ্যের ক্ষেত্রেও এটা বলা বাহুল্য, উৎপাদন ব্যাহত হলে কিংবা উৎপাদন ব্যয় বেশি হলে পণ্যের সংকট ও দাম বেশি হবে। আমাদের দেশের ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা যেভাবে কমছে, তাতে তাদের পক্ষে উচ্চ বা বেশি দামে পণ্য কেনা সম্ভবপর হবে না। খাদ্যপণ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যাদির দাম প্রতিদিনই বাড়ছে। সাধারণ মানুষসহ নিম্ন ও মধ্যবিত্তের জীবনধারণ কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি অব্যাহত থাকবে এবং আগামী মাসে ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। তাদের মতে, মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি ক্ষমতাসীনদের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ। মানুষের ক্ষোভ-অসন্তোষ, আন্দোলন এর ফলে দ্রুত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়।
দৈনন্দিন জীবনযাপন, কৃষি-শিল্পের উৎপাদন, উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালন ইত্যাদির জন্য জ্বালানি ও বিদ্যুতের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম ও প্রশ্নাতীত। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বাড়ায় বিশ্বের সব দেশের মতো আমাদের দেশেও তেল-গ্যাসের দাম বেড়েছে। মোটা দাগে তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। তেলের দাম বাড়ার প্রতিক্রিয়া কৃষি, শিল্প, পরিবহনসহ সকল ক্ষেত্রে পড়েছে। মানুষের জীবন ও দেশের অর্থনীতিতে একটা বড় রকমে ধাক্কা লেগেছে। পরিস্থিতি যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সাশ্রয় কর্মসূচি রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা করা হয়েছে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। শুরুতে লোডশেডিংসহ যেসব উদ্যোগ ও পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সেগুলো তারই অংশ। তেলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু সেটা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। বিদ্যুৎকেন্দ্রে যথারীতি তেল পুড়ছে। এই সঙ্গে জেনারেটর চালাতেও তেল পুড়ছে। তাহলে তেলের সাশ্রয় হলো কীভাবে? কীভাবেই-বা বিদ্যুৎ সাশ্রয় হলো এত লোডশেডিং করার পরও? অনেকেরই স্মরণ আছে, বিএনপি সরকারের আমলে কানসাটে বিদ্যুৎ নিয়ে একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছিল। তা নিয়ে বর্তমান সরকারি দল ব্যাপক আন্দোলন সৃষ্টি করেছিল। অথচ, এখনকার বিদ্যুতের অভাব, আর তখনকার অভাবের মধ্যে তেমন কোনো ফারাক দেখা যাচ্ছে না। তাহলে এ সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে কী বিপ্লব সাধন করলো? বিদ্যুৎ নিয়ে আরো প্রশ্ন আছে। ক্যাপাসিটি চার্জের নামে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা রেন্টাল-কুইক রেন্টালওয়ালাদের কেন দেয়া হলো, তার জবাব কী? পরিস্থিতিটা এখন এমন যে, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের বিকল্প নেই। আবার জীবনযাপন, উৎপাদন ও পণ্যমূল্য স্বাভাবিক রাখাও আবশ্যক। এই দু’য়ের মধ্যে সমন্বয়সাধন বা সামঞ্জস্য বিধান করতে হবে। সরকারকে এদিকে দ্রুত নজর দিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন