পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনের বেহেশত বিষয়ক বক্তব্যের রেশ কাটতে না কাটতেই আরেক বিস্ফোরক মন্তব্য করে বসেছেন। ‘শেখ হাসিনাকে সরকারে টিকিয়ে রাখতে যা যা করা দরকার, তা করতে ভারত সরকারকে অনুরোধ করেছি’ এমন বক্তব্যে ফের আলোচনা-সমালোচনার কবলে পড়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের আগে মন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্যে বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। একটা দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দফায় দফায় এমন অযাচিত বক্তব্য সরকার ও দেশকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলেছে। বিএনপিসহ সকল বিরোধী দলের দাবি, মন্ত্রী সরকারের গোমর ফাঁস করেছেন। মন্ত্রীর নিজের দল আওয়ামী লীগও তার এ বক্তব্যকে সমর্থন করছে না। দলটির নেতারা জানিয়েছেন, এটা দল বা সরকারের বক্তব্য নয়, তার ব্যক্তিগত মত। তিনি আমাদের দলের কেউ নন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য প্রসঙ্গে ক‚টনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, এমন বক্তব্য দেওয়ার এখতিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেই। তিনি এসব কথা বলে শুধু সরকার নয়, জনগণকেও বিব্রত করেছেন। তাদের মতে, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। এদেশের সরকার ঠিক করবে জনগণ। ক্ষমতায় থাকার জন্য বিদেশিদের অনুরোধ দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না। এ ধরনের অনুরোধ দেশের জন্য সম্মানজনক তো নয়ই, মর্যাদাহানিকরও বটে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সব সময় আলোচনায় থাকতে পছন্দ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে অতিকথনের কারণে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনার খোরাক হচ্ছেন। আবার চাপে পড়ে গণমাধ্যমের কাঁধে দায় চাপিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা করছেন। কিছুদিন আগে সিলেটে এক মতবিনিময়সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, বাংলাদেশ শ্রীলংকা হয়ে যাবে, একটি পক্ষ থেকে এমন প্যানিক ছড়ানো হচ্ছে। বাস্তবে এর কোনো ভিত্তি নেই। বৈশ্বিক মন্দায় অন্যান্য দেশের তুলনায় আমরা বেহেশতে আছি। তার এমন বক্তব্য প্রচারের সাথে সাথে সব মহলে শুরু হয় সমালোচনার ঝড়। খোদ আওয়ামী লীগও তার এমন মন্তব্যে বিব্রতবোধ করে। বরাবরের মতো মিডিয়ার ওপর দোষ চাপিয়ে তিনি সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনারা তো আমারে খায়া ফেললেন।’ যদিও পরবর্তীতে তিনি এ ধরনের বক্তব্যের জন্য দুঃখপ্রকাশ করেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচলেটের ঢাকায় পা রাখার দিনে দুঃখ প্রকাশ করতে গিয়ে সরকার ও দলের উচ্চপর্যায় থেকে ধমক খাওয়ার কথাও বলেছেন সাংবাদিকদের কাছে। তিনি বলেছেন, গÐগোলটা সাংবাদিকরাই বাধিয়েছেন। সাংবাদিকরা তার বক্তব্য টুইস্ট করেছেন, বাক্যের শব্দ গোলমাল করেছেন-এ দাবি করতে গিয়ে আবার আগের কথাই বলে ফেলেন। এর আগেও অতিকথকদের বিভিন্ন বক্তব্যের জন্য ধমক আসে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ।
অনেক আগেই সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে মন্ত্রী-এমপিদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, কাÐজ্ঞান খরচ করে কথা বলতে। একটি দলীয় অনুষ্ঠানে কড়া ভাষায় ওবায়দুল কাদের মন্ত্রী-এমপিদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন, দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে কথা না বলতে। এই পরামর্শের সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, যেখানে সংকটে মানুষের দুশ্চিন্তায় প্রধানমন্ত্রী রাতে নির্ঘুম থাকেন, সেখানে অনেকের বেফাঁস বক্তব্য ও ক্ষমতার বাহাদুরি দুঃখজনক।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেহেশতের কথা টেনে না আনলে সম্ভবত তার বক্তব্য এতো ভাইরাল হতো না। বেহেশত শব্দ ব্যবহার না করে এর আগে এ ধরনের কথা অবশ্য তার সহকর্মী মন্ত্রীদের অনেকেই করেছেন। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম সুখী দেশ, আয়-আয়ুতে টইটুম্বুর মানুষ, গরুও এখন ভাত খায়, মানুষ এখন ৩ বেলা গোশত খেতে পারে, উন্নয়নের জোয়ারে দেশে এখন ভিক্ষা দেওয়ার লোকও পাওয়া যায় না, কোরবানির গোশত নেওয়ার লোক নেই, এমন বক্তব্য হরহামেশাই দেয়া হয়েছে। করোনার সময় ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘আমরা করোনার চেয়েও শক্তিশালী’। রূপপুরের বালিশ কাÐের সময় বলেছিলেন, বালিশের কোটি কোটি টাকা চুরি যারা করেছে তারা ছিঁচকে চোর। ডেঙ্গুর প্রকোপের সময় স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, দেশের উন্নয়ন হওয়ায় ডেঙ্গু এসেছে। টিভি-চলচ্চিত্র নায়িকাদের নিয়ে মন্ত্রীদের রাস্তা ঝাড়– দেওয়ার দৃশ্য এখনও সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে। ক্ষমতাসীন দলের অনেকেই ট্রলের শিকার হয়েছেন তাদের কর্মকাÐ ও বক্তব্যের জন্য। করোনা, বন্যা-খরা কাটিয়ে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, ভোজ্যতেলের কারসাজি, ডলার সংকট, নিত্যপণ্যের আগুনের মাঝেও তাদের বাহুল্য কথা বলা বন্ধ হচ্ছে না। যানজটকে উন্নয়নের প্রমাণ বলতেও দ্বিধা করে না। বিদেশের মন্ত্রীরা এখন বাংলাদেশের মন্ত্রীদের অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য বসে থাকে-এই কথাও বলেছেন এক মন্ত্রী। উড়োজাহাজ থেকে দেখলে ঢাকাকে প্যারিস মনে হয় বলেও বলেছেন।
বলা বাহুল্য, এসব অযাচিত মন্তব্যে সমালোচনা শুরু হলে তারা দোষ চাপান সাংবাদিকদের ওপর। অথচ বলার সময় তারা সচেতন থাকেন না। কথা বলার সময় সরকারের দায়িত্বশীলরা মনে হয়, তাদের অবস্থান ভুলে যান। তা নাহলে, বেফাঁস কথাবার্তা কেন বলবেন? এতে যে সরকারের বদনাম হচ্ছে, দেশের মানুষের সাথে তামাশা করা হচ্ছেÑএ বিষয়গুলো তারা বেমালুম হয়ে যান। অর্থনৈতিক টানাপড়েনে এমনিতেই সাধারণ মানুষ দিশাহারা। তাদের জীবনযাপন কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। এক দুর্বিষহ সময়ের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের দায়িত্বশীলদের অনেক সচেতন, সংযত ও সতর্ক হওয়া উচিৎ। তাদের এমন কথা বলা ঠিক নয়, যা সাধারণ মানুষের দুর্ভোগকে পরিহাসে পরিণত করে।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন