করোনা আতঙ্কের মধ্যেই আবার উদ্বেগ বাড়াচ্ছে মাঙ্কিপক্স। গত ৭ মে লন্ডনে প্রথম এক ব্যক্তির শরীরে মাঙ্কি পক্স ভাইরাসের খোঁজ মেলে। এরই মধ্যে ভাইরাসটি পর্তুগাল, স্পেন, ইউরোপ ও আমেরিকার মতো কয়েকটি দেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। মাঙ্কিপক্স সম্পর্কে অনেকেরই এখনো তেমন কোনো ধারণা নেই। মাঙ্কিপক্স এক বিশেষ ধরনের বসন্ত রোগ। প্রাণীদেহের মাধ্যমে ভাইরাসটি ছড়ানোর ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে, ইঁদুরের মাধ্যমে এই ভাইরাস দ্রুত ছড়ায়। বিশ্বব্যাপী এ পর্যন্ত প্রায় ১৭,০০০ মাংকিপক্স রোগী পাওয়া গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রোস আধানম গেব্রেইসাস ২৩ জুলাই মাঙ্কিপক্সের সর্বোচ্চ স্তরের সতর্কতা জারি করেছেন। মাঙ্কিপক্স সরাসরি সংশ্রবের মাধ্যমে ছড়ায়, যার মধ্যে শেষ্মা ঝিলি এবং ত্বকের ক্ষতের মাধ্যমে বা দূষিত বস্তুর সংপর্শে আসা অন্যতম। এটি শ্বাসপ্রশ্বাসের ফোঁটা বা ড্রপলেট দ্বারাও সংক্রামিত হতে পারে, স্বল্প দূরত্বে এবং দীর্ঘক্ষণ সান্নিধ্যে থাকার সময়ে। মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত অন্য ব্যক্তির সাথে ঘনিষ্ঠ শারীরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে যে কেউ ঝুঁকিপূর্ণ। প্রধান ফ্যাক্টর হল একাধিক সঙ্গী থাকা: দেখা গেছে ৭৪% রুগীর বহুগামিতায় অভ্যস্ত। আর ২৬% রোগীর মাংকিপক্সের সাথে এইচআইভি-পজিটিভ ধরা পড়ে। ১৯৫৮ সালে ল্যাবরেটরিতে প্রথম বানরের দেহে এই ভাইরাসের সংক্রমণ প্রথম দেখা দিয়েছিল বলে ১৯৭০ সালে এর নামকরন হয় মাঙ্কিপক্স।
> আমাদের থেকে কত দূরে?
যখন মাত্র করোনা সংক্রমণের চাপ থেকে বেরিয়ে মানুষজনের মধ্যে একধরনের স্বস্তির ছাপ পড়তে শুরু করেছে, তখনই খবর আসছে মাঙ্কিপক্সের। গত মাসে ঢাকা বিমানবন্দরে একজন তুর্কি পর্যটককে সন্দেহ করে হাসপাতালে নেওয়ার পরে বোঝা গিয়েছিল তিনি মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত নন। বাংলাদেশ এখনো এই রোগমুক্ত, কিন্তু চিন্তামুক্ত নয়।
বাড়ির কাছে পৌঁছে যাওয়ায় এই চিন্তা বাড়ছে। এর মধ্যেই প্রতিবেশী দেশে মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত একাধিক রোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে এখন পর্যন্ত কেরালায় ও দিল্লিতে মিলে ৮ জন রুগী সনাক্ত হয়েছে। বলে রাখা ভালো কেরালা দিয়েই করোনা ঢুকেছিল ভারতে। এই রাজ্যের অনেক মানুষ প্রবাসে থাকে। বিদেশি পর্যটকদের যথেষ্ট আকর্ষণ আছে কেরালার প্রতি। লাগোয়া রাজ্য তামিলনাড়ুতে এখন ঢাকা থেকে সরাসরি যাওয়া যায়।
কলকাতার পরেই ভারতে আমাদের দ্বিতীয় প্রধান গন্তব্য চেন্নাই। সেটাও একটা চিন্তার বিষয়। পশ্চিমবঙ্গে সন্দেহের বশে একজনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। যে যুবকের শরীরে ওই রোগের লক্ষণ দেখা দিয়েছিল তাঁর নমুনা পরীক্ষায় জানা গেছে তাঁর শরীরের গোটাগুলো নিতান্তই খোসপাঁচড়া। তবে কলকাতা বিমানবন্দর মাঙ্কিপক্সের ওপর নজরদারি শুরু করেছে। দুবাই, দোহা, সিঙ্গাপুর আর ব্যাংকক থেকে সরাসরি যাঁরা দমদমে নামছেন, তাঁদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য পরীক্ষার পাশাপাশি তারা যাত্রীদেরও সচেতন করছে।
ইউরোপ আর উত্তর আমেরিকার যেসব দেশে এখন মাঙ্কি পক্সের আতঙ্ক বিরাজ করছে, সেসব দেশেও আমাদের অনেক দেশি ভাই-বোন থাকেন। তাঁদের আসা-যাওয়া আছে। উত্তর আমেরিকার দেশ কানাডা মাঙ্কিপক্স নিয়ে বেশ পেরেশানির মধ্যে আছে। সে দেশের প্রায় সব বড় শহরে মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। দ্য পাবলিক হেলথ এজেন্সি অব কানাডা জানাচ্ছে, ২৯ জুলাই পর্যন্ত মোট ৮০৩ জনের শরীরে মাঙ্কিপক্স শনাক্ত হয়েছে।
এর মধ্যে অন্টারিওতে ৩৬৭ জন আর কুইবেকে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৫৯ জন। কানাডার এই দুই প্রদেশে প্রবাসী বাংলাদেশি আর শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। শীতে-গরমে তাঁরা দেশে আসেন। দেশ থেকে আত্মীয়স্বজন তাঁদের দেখতে যান। ফলে আক্রান্ত দেশের দূরত্ব যা-ই হোক তারা আমাদের কাছেই আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তাদের মতে পৃথিবীর অন্য শহরগুলোতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে মাঙ্কিপক্স।
> ছড়াচ্ছে কীভাবে
মাঙ্কিপক্সের প্রাথমিক লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে জ্বর, মাথাব্যথা, ঘেমে যাওয়া, পিঠে ব্যথা, মাংসপেশির টান ও অবসাদ। জ্বর কমলে শরীরে দেখা দেয় ফুসকুড়ি। অধিকাংশ ঘটনায় শুরুতে মুখে ফুসকুড়ি দেখা দেয়। পরে অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে; বিশেষ করে হাতের তালু ও পায়ের তলায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাঙ্কিপক্স বিশেষজ্ঞ লুইস বলেছেন, আফ্রিকা মহাদেশের বাইরে যাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের শতকরা ৯৯ জন পুরুষ। তাঁদের মধ্যে শতকরা ৯৫ জন শুধু পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সমকামী ও উভকামী পুরুষদের সতর্ক হতে বলেছে।
লুইসের কথাই শেষ কথা নয়। সমকামী ও উভকামী কম বয়স্ক পুরুষদের মধ্যে মাঙ্কিপক্স কেন বেশি পাওয়া যাচ্ছে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। কার মাধ্যমে কীভাবে ছড়াচ্ছে, এ বিষয়ে চিত্র এখনো পরিষ্কার নয়। বরং সংক্রমণের ঘটনাগুলো সম্পর্কিত নয় মনে হচ্ছে। হতে পারে সমকামীরা নিজেদের যৌন স্বাস্থ্য সম্পর্কে অন্যদের থেকে বেশি সচেতন, তাই তাঁরাই চিকিৎসকের কাছে আসছেন।
এই রোগ অন্য আরও অনেকভাবে ছড়াতে পারে, ছড়াচ্ছে। মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত মানুষের তোয়ালে ব্যবহার করে দুটি শিশু এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে। যুক্তরাজ্যে সম্প্রতি সংক্রমণের যেসব ঘটনা শনাক্ত হয়েছে, সেগুলোর একটির সঙ্গে অপরটির কোনো যোগসূত্র এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেখানে একজন স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি মাঙ্কিপক্স রোগীকে সেবা দিয়েছিলেন।
প্রমাণসহ পরিষ্কার যোগসূত্র নিশ্চিত না হয়ে এটা শুধুই সমকামীদের সমস্যা বলে প্রচার চালালে মাঙ্কিপক্সের বিরুদ্ধে অভিযান সফল না-ও হতে পারে। সমকামী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ভয়ে মানুষ রোগটি লুকাবে।
> মাঙ্কিপক্স সংক্রমনের লক্ষণ কী?
একবার কোন ব্যাক্তি এ রোগে সংক্রমিত হলে তার ৪ দিন পরে লক্ষণগুলি বিকাশ শুরু করে।
১. কাঁপুনি দিয়ে জ্বর। ২. বমি বমি ভাব বমি। ৩. নিঃশ্বাসের দুর্বলতা। ৪. মাথা যন্ত্রণা। ৫. শরীরের মাংশ পেশিতে ব্যথা। ৬. শরীরের বিভিন্ন লসিকা গ্রন্থি (লিম্ফনোড) ফুলে ওঠে। ৭. ফুসকুড়ি, প্রধানত মুখ, হাত-পায়ের তালু, বুকে শরীরের অন্যান্য অংশে। ৮. স্কিন বাম্প হওয়া বা ফোলা। ৯. তরল ভরা পাস্টুলস। ১০. স্কিনে প্যাপিউলস বা ফোস্কা হওয়া। ১১. ভূত্বক গঠন।
ধীরে ধীরে সেই ক্ষত আরও গভীর হয়ে পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। গুটি বা জলবসন্তের সঙ্গে মাঙ্কিপক্সের উপসর্গে মিল আছে বলে অনেকেই প্রাথমিক পর্যায়ে এই রোগকে বসন্ত বা চিকেন পক্স বলে ভুল করছেন।
> চিকেনপক্স ও মাঙ্কিপক্সের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?
মাঙ্কিপক্সকে অনেকেই চিকেনপক্স বলে ভুল করছেন। চিকেনপক্সের মতো মাঙ্কিপক্সের ক্ষেত্রেও শরীরে ছোট ছোট ফুসকুড়ি দেখা দিচ্ছে।
চিকেনপক্সের ক্ষেত্রে শরীরে লালচে রঙের ঘামাচি বা র্যাশের মতো গুটি গুটি বের হবে। মাঙ্কিপক্সের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটে। শরীরে ব্যথা, কাপুনি দিয়ে জ্বর ইত্যাদি লক্ষণে চিকেনপক্সের সঙ্গে মাঙ্কিপক্সের মিল আছে।
চিকেন পক্সের ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করার ৫-৭ দিনের মধ্যে শরীরে ফুসকুঁড়ির সৃষ্টি করে। সেটা ধীরে ধীরে পানিভরা ফোস্কার মতো আকার নেয়। পরে ফোস্কার ভিতরের রস ঘন হয়ে পুঁজের মতো হয়। ৭-১০ দিন পর থেকে তা শুকোতে থাকে।
অন্যদিকে মাঙ্কিপক্সের ইনকিউবেশন পিরিয়ড ৫-২১ দিন পর্যন্ত হতে পারে। জ্বর দেখা দেওয়ার ১-৪ দিনের মধ্যে (কখনো কখনো আরও বেশি) রোগীর একটি ফুসকুড়ি তৈরি হয়। যা প্রায়শই হাত-পায়ের তালু ও চোখে মুখে শুরু হয়, তারপর শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হলে তা সারতে ২-৪ সপ্তাহ লাগতে পারে।
তরলযুক্ত এই ফুসকুড়িগুলো পরে ত্বকের দাগেরও সৃষ্টি করছে। উপসর্গগত সাদৃশ্য থাকলেও চিকেনপক্স ও মাঙ্কিপক্সের লক্ষণগুলোর মধ্যে প্রধান পার্থক্য হলো, মাঙ্কিপক্সের কারণে লসিকাগ্রন্তি বা লিম্ফ নোডগুলো ফুলে যায়, মাঙ্কিপক্সের ফুসকুড়িগুলি আকারে বড় ও এতে চিকেনপক্সের মত চুলকানি থাকে না।
চিকিৎসা ও প্রতিরোধ: অন্য অনেক ভাইরাল অসুখের মত মাঙ্কি পক্সের সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। লক্ষনের উপর জ্বর, ব্যথা, বমির ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। তবে যেকোনো ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মতই সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিয়ে এর প্রকোপ রোধ করা যায়।
এর জন্য নির্দিষ্ট কোনো টিকাও নেই। তবে স্মলপক্স বা গুটিবসন্ত ও মাঙ্কিপক্সের ভাইরাস একই পরিবারভুক্ত। ফলে গুটিবসন্তের টিকা নেওয়া থাকলে তা মাঙ্কি পক্সের বিরুদ্ধেও ৮৫ শতাংশ সুরক্ষা দিতে পারে। যেহেতু এ রোগ সাধারণভাবে প্রাণঘাতী নয়, তাই এটি নিয়ে উদ্বেগের তেমন কারণ নেই বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। আফ্রিকায় মাঙ্কি পক্সে আক্রান্ত ১০ জনের মধ্যে ১ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে।
> হোমিও মেডিসিনঃ লক্ষণ সাদৃশ্যে প্রাথমিক ভাবে যেসব মেডিসিন মাঙ্কিপক্সের জন্য আসতে পারে- রাসটক্স, বাইয়োনিয়া ভ্যাকসিনাম, ম্যাল্যান্ডরিনাম, পালসেটিলা, এন্টিম ক্রুড, সালফার, থুজা, ভেরিওলিনাম, মারকুরিয়াস সল, সাইলিসিয়া সহ আরো অনেক ঔষধ। তাই নিজে নিজে ব্যবহার না করে সঠিক চিকিৎসা পেতে হলে অভিজ্ঞ চিকিৎকের পরামর্শ নিন।
মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক স্বাস্থ্য তথ্য
প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
ইমেইল: drmazed96@gmail.com
মোবাইল: ০১৮২২৮৬৯৩৮৯
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন