জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের অন্যতম মেগাসিটি ঢাকা। এই শহরে রাস্তায় গাড়ির গড় গতিবেগ ঘন্টায় ৭ কিলোমিটার, যা মানুষের পায়ে হাটার গতিবেগের চেয়েও কম। যানজটের কারণে নাগরিকদের যতই দুর্ভোগ হোক, ঢাকার প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র ও ব্যস্ত এলাকাসমুহে রাস্তার বেশিরভাগ অংশই হকারদের দখলে। একটি আধুনিক নগরীতে জনসংখ্যা অনুপাতে গাড়ি চলাচলে যে পরিমানে রাস্তা থাকার কথা ঢাকায় তার অর্ধেকও নেই। এর উপর রয়েছে রাস্তার বেহাল দশা, খানাখন্দ এবং ট্রাফিক ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা। সেই সাথে যান্ত্রিক-অযান্ত্রিক যানবাহন, অযোগ্য-লাইসেন্সবিহিন চালকদের ফিটনেস বিহিন গাড়ি চালনায় রাস্তায় যত্রতত্র যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। ঢাকার যানজট কমিয়ে আনতে গত দুই দশকে নানাবিধ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বেশ কয়েকটি ফ্লাইওভার নির্মান করা হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় গত একদশক ধরে মেট্টোরেল ও বিআরটি প্রকল্প বাস্তবায়ন চলছে। চার বছরের কাজ ১০ বছরেও শেষ হয়নি। এসব প্রকল্পে ঢাকার জনদুর্ভোগ আরো বেড়েছে। কিন্তু মানুষের স্বাচ্ছন্দ চলাচলের জন্য শহরের ট্রাফিক শৃঙ্খলা, ফুটপাতের হকার উচ্ছেদের মত অতি জরুরি উদ্যোগগুলো কখনোই বাস্তব রূপ পায়নি। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে মাঝে মধ্যেই হকার উচ্ছেদের অভিযান দেখা গেলেও এসব অভিযান মূলত ফুটপাতের পজেশন বিক্রি ও চাঁদাবাজির হাত বদলের খেলা ছাড়া আর কিছু নয়। কেউ কেউ এই খেলার নাম দিয়েছেন ইঁদুর-বেড়াল খেলা।
দেশ এগিয়ে যাচ্ছে বলে একটা রাজনৈতিক শ্লোগান জারি রয়েছে। কিন্তু এগিয়ে যাওয়া মানে শুধু পরিসংখ্যানের হিসেবে মানুষের গড় আয়বৃদ্ধির খতিয়ানই যথেষ্ট নয়। বাস্তবিক অর্থে মানুষের স্বাচ্ছন্দ চলাচল, নাগরিকদের মর্যাদা, নিরাপত্তা ও সুযোগসুবিধা নিশ্চিত করতে না পারলে কথিত উন্নয়ন-অগ্রগতির কোনো মূল্য নেই। ফুটপাথ দখল করে সেখানে মাসিক ভাড়ায় দোকান বসানো ও দৈনিক চাঁদাবাজির পেছনে বড় একটি সিন্ডিকেট জড়িত। সরকারি দল ও সহযোগী সংগঠনের একশ্রেণীর স্থানীয় নেতা-কর্মী এবং পুলিশ ও ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা এর সঙ্গে জড়িত। প্রতিদিনের চাঁদাবাজির কোটি কোটি টাকার অংশ এই সিন্ডিকেটের নিচ থেকে উপর পর্যন্ত ভাগ হয়। ঢাকা শহরে যানজটের দুর্ভোগ ও ফুটপাথে পথচারি চলাচলে বিড়ম্বনার জন্য দায়ী সরকারি দলের চাঁদাবাজ লাইনম্যান ও তাদের পৃষ্ঠপোষক, পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও প্রশাসন এই ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারেনা। সম্ভবত দলীয় সমর্থন ও গোষ্ঠিতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও চাঁবাজির ভাগ-বাটোয়ারার কারণেই দলীয় ম্যান্ডেটে পাস করা সিটি মেয়ররা ফুটপাথের দখলবাজি বন্ধ করতে পারছেন না।
বিশ্বের দূষিত ও বসবাসের অযোগ্য নগরীগুলোর র্যাংকিংয়ে প্রথম দু’তিন নাম্বারে স্থান পাচ্ছে ঢাকা। বিমানবন্দর থেকে মতিঝিলের বাণিজ্যিক এলাকার দূরত্ব অনুসারে পৌঁছতে ২০ মিনিটের বেশি লাগার কথা নয়। সেখানে কমপক্ষে দুই-তিন ঘন্টা লেগে যাচ্ছে। এ ধরণের বাস্তবতায় এ দেশে বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে বিদেশিরা। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গর্ভন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের একটি গবেষণা জরিপ অনুসারে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের ফুটপাতের হকারদের কাছ থেকে বছরে ২ হাজার ১৬০ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। চাঁদাবাজির এই বিপুল অর্থ ও কর্মযজ্ঞ সম্পর্কে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা বা সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাছে কোনো তথ্য নেই, নাকি সৈয়দ মুজতবা আলী রসগোল্লা গল্পের চরিত্রদের মত অবৈধ চাঁদাবাজির মাধ্যমে অর্জিত হাজার কোটি টাকার ভাগাভাগির অংশ পেয়ে সকলেই চুপ মেরে থাকছে, এই প্রশ্ন থেকেই যায়। বিশ্বের আর কোনো রাজধানী শহরে এমন বাস্তবতা আছে কিনা আমাদের জানা নেই। ফুটপাথ শুধু পথচারিদের। স্কুলগামী শিক্ষার্থী, শিশু ও মায়েরা ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে প্রতিদিন সকালে স্কুল কলেজে যাবে, কর্মজীবী মানুষ বাসা থেকে এক-আধ কিলোমিটার হেঁটে কর্মস্থলে যাওয়ার বাস্তবতা বিশ্বের সব নগরীতেই দেখা যায়। ফুটপাথ দখলের কারণে ঢাকার বেশিরভাগ এলাকায় এই সুযোগ নেই। ফুটপাথে পজেশন বিক্রি ও দখলবাজির চিত্র গণমাধ্যমে প্রায়শ উঠে আসলেও শত শত কোটি টাকা চাঁদাবাজির সাথে যুক্ত কাউকে গ্রেফতার বা বা আইনের আওতায় আনার কোনো দৃষ্টান্ত দেখা যায়নি। এ কারণেই নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও ঢাকার যানজটসহ নগর চিত্রের ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। সবার্গ্রে ফুটপাথগুলো দখলমুক্ত করে তা পথচারিদের জন্য নির্বিঘ্ন রাখতে হবে। রাস্তায় পথচারি চলাচল বা অবৈধ পার্কিং বন্ধ করতে পারলে যানজট অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব। ফুটপাথে দখলবাজি, পজেশন বিক্রি, মাসোহারা ও দৈনিক চাঁবাজির সাথে জড়িত সকলকে আইনের আওতায় আনতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন