বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

নিজে বদলালে সমাজ বদলাবে

মুহাম্মদ আনোয়ার শাহাদাত | প্রকাশের সময় : ২৭ আগস্ট, ২০২২, ১২:০০ এএম

চলার পথে, চায়ের আড্ডায় কিংবা আলাপচারিতায় একটু মনযোগ দিয়ে কান খাড়া করলেই শোনা যায় চলমান সময় আর সমাজের বিরুদ্ধে মানুষের কত শত অভিযোগ। সময় বদলে গেছে, মানুষ এখন আর মানুষ নাই। আন্তরিকতা, সহমর্মিতা, পরস্পর শ্রদ্ধাবোধ এসব বিদায় নিয়েছে। শালীনতা ও নৈতিকতার মৃত্যু হয়েছে, এরকম হাজারো অভিযোগ। এসব অভিযোগ যে একেবারে অমূলক তা কিন্তু নয়। আজকের সমাজের যেদিকেই তাকানো যাবে দেখা যাবে, নৈতিক অধঃপতনের মহামারি চলছে। মানুষ কিন্তু এসব থেকে মুক্তি চায়, কেউ এসব গর্হিত কাজ তেমন পছন্দ করে না। মানুষ পরিবর্তন চায় এই ঘুনে ধরা চলমান সমাজের। ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে এই বিষয়ে কাজ হচ্ছে বটে, তবে সামগ্রিকভাবে সমাজে এর প্রভাব সেভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এত চেষ্টার পরও চারিদিকে অবক্ষয় আর নিরাশার পদধ্বনি। কেন? নিশ্চয় আমাদের প্রচেষ্টায় ত্রুটি আছে, পদ্ধতিগত ও প্রয়োগগত সমস্যা আছে। ঘাটতি রয়েছে আমাদের সঠিক ও কার্যকর দৃষ্টিভঙ্গিরও। আমরা প্রায়শ অপরকে বদলানোর চেষ্টা করি, বিভিন্ন উপদেশ দেই, অপরের গর্হিত কাজের জন্য তিরস্কার করি। সমাজকে ঢেলে সাজাতে চাই, আদর্শ সমাজ বিনির্মাণের কথা বলি। কিন্তু সমাজ পরিবর্তনের জন্য প্রথমেই যে নিজের পরিবর্তন দরকার তা মোটেও ভাবি না।

খ্যাতিমান রুশ লেখক লিও টলস্টয় বলেছেন, ঊাবৎুড়হব ঃযরহশং ড়ভ পযধহমরহম ঃযব ড়িৎষফ, নঁঃ হড় ড়হব ঃযরহশং ড়ভ পযধহমরহম যরসংবষভ. আসলেই আমরা পৃথিবী বদলাতে চাই, কিন্তু নিজেকে বদলাতে চাই না। তাই পৃথিবী বদলাতে হলে সবার আগে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি এবং ব্যক্তিজীবনে পরিবর্তন আনতে হবে। তবেই সমাজ বা পৃথিবী বদলানোর প্রচেষ্টা ফলপ্রসু হবে। নিজেকে বদলাতে হলে প্রথমে নিজেকে ভালোভাবে চিনতে হবে। নিজের ব্যাপারে জানাশোনা যত বাড়বে, চিন্তা ও কাজের সাফল্যও তত বাড়বে। নিজের সামর্থ্য ও দুর্বলতা, ইতিবাচক ও নেতিবাচক স্বভাবের ব্যাপারে ভাবতে হবে। বিষয়গুলোর ব্যাপারে স্বচ্ছ ধারণা থাকলে নিজেকে বদলানো সহজ হবে। নিজেকে জানা বা চেনা এত সহজ নয়। নিজেকে যদি ভালো করে না জানে কেউ, তাহলে নিজেকে বদলাতে পারবে না। আর নিজেকে বদলাতে না পারলে সমাজকে বদলানো সম্ভব না। দৃঢ় সংকল্প থাকতে হবে নিজেকে পরিবর্তনের। তাহলে নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠবে এবং যে কোনো ধরনের সংশয়ের মোকাবিলা করার শক্তি সঞ্চয় হবে। গ্রিসের বিজ্ঞানী থেলিস বলেছেন, ‘সবচেয়ে কঠিন কাজ হচ্ছে নিজেকে চেনা এবং সবচেয়ে সহজ কাজ হচ্ছে অন্যদেরকে উপদেশ দেয়া।’ নিজেকে না বদলিয়ে সমাজ বদলানোর প্রচেষ্টা শুধু প্রচেষ্টা হয়েই থাকবে। আমরা প্রত্যেকে যদি নিজের অবস্থান থেকে নিজেদের উপর অর্পিত দায়িত্ব-কর্তব্য ঠিকমতো পালন করি এবং অসত্য ও অসুন্দরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করি, তাহলে ব্যক্তিজীবনের সাথে সাথে সামাজিক জীবনের পরিবর্তন আসতে বাধ্য। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনুল করীমে ঘোষণা দেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ কোনো সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিেেজদের অবস্থার নিজেরা পরিবর্তন করে।’ (সূরা রা’দ-১১)।

সমাজে কী ভুল আছে সে সম্পর্কে প্রত্যেক মানুষ নিজস্ব মতামত উপস্থাপন করে এবং এটি খুব সহজও। কিন্তু নিজের কাছে কী ভুল আছে তা খুঁজে বের করার চেষ্টা আমরা করি না। আমরা প্রতিনিয়ত নানান অভাব অভিযোগ, অসঙ্গতির কথা বলে বেড়াই, এই সমাজ বা পৃথিবী বাসের অযোগ্য হয়ে গেছে, এখানে ভালো মানুষ থাকার মতো অবস্থা আর নেই আরো কত কী! অথচ, ভেবে দেখার বিষয়, এই পৃথিবীর বয়স কত। প্রায় ৪.৫৪ বিলিয়ন বছর ধরে পৃথিবী বেঁচে আছে এবং অনেক সুন্দরভাবে বেঁচে আছে। এই সমাজ- সংসারে অস্থিরতা, অপূর্ণতা থাকবে। তার ভেতরেও কেউ চাইলে সুন্দর জীবনযাপন করতে পারে। তার জন্য দরকার হলো নিজেকে পরিবর্তন করা এবং নিজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করা। সত্যিকার অর্থে বাইরের পরিস্থিতি ততটা খারাপ না, যতটা আমি-আপনি ভাবি বা মনে করি। চলমান বাস্তবতার পরিবর্তন করতে চাইলে আজ থেকেই পরিবর্তনের শুরু করা উচিত এবং নিজেকে দিয়েই শুরু করা উচিত। কেউ যদি হতাশ, রাগান্বিত বা বিব্রতকর অবস্থা বোধ করে তাহলে কৌতূহলী হয়ে উঠতে হবে এবং কাজ করতে হবে। মানসিকতা, অভ্যাস এবং কর্ম পরিবর্তন করতে হবে। বেশির ভাগ মানুষ নিজেকে অন্যের সাথে তুলনা করে। এটি পরিহার করতে হবে। মিথ্যা বা ভনিতার আশ্রয় নেয়া বন্ধ করতে হবে। নিজের বিশ্বাসের প্রতি দৃঢ় ও মজবুত হতে হবে। কারো কাছে অধিক ভালো দেখানোর জন্য মিথ্যার আশ্রয় নেয়া কখনও উচিত হবে না।

প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘যখন দেখবে মানুষ কৃপণতা করছে, প্রবৃত্তির পেছনে ছুটছে, পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে, প্রত্যেকে নিজের মতামতে মুগ্ধ, এমন পরিস্থিতিতে নিজের সংশোধনে বিশেষ মনযোগ দাও। সাধারণ মানুষের পথ পরিহার কর।’ (সুনানে আবু দাউদ)। কতই না সুন্দর, সুশীল ও বাস্তবধর্মী দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন মানবতার মুক্তির কাণ্ডারী প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম। এই সমাজের বেশির ভাগ মানুষ তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরের পরিস্থিতিতে হতাশ বা ক্ষুদ্ধ। আসলে কিছু বিষয় আছে, যা আমাদের কারো হাতে নেই। এমন বিষয় নিয়ে ভেবে নিজের সাবলীল জীবনধারায় হতাশা ডেকে আনা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। নিজেকে কীভাবে বদলানো যায় সেটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। কেউ একা হয়তো সমাজ পরিবর্তন করতে পারবে না, কিন্তু সমাজ পরিবর্তনের ধারায় একটি মাত্রা যোগ করতে পারে। মাদার তেরেসা বলেছেন, ও ধষড়হব ঈধহহড়ঃ পযধহমব ঃযব ড়িৎষফ, নঁঃ ও পধহ পধংঃ ধ ংঃড়হব ধপৎড়ংং ঃযব ধিঃবৎং ঃড় পৎবধঃব সধহু ৎরঢ়ঢ়ষবং. অর্থাৎ ‘আমি একা পৃথিবীকে বদলাতে পারি না, তবে আমি অনেক ঢেউ তৈরি করতে জলের উপর একটি পাথর নিক্ষেপ করতে পারি।’

আমরা আসলে এই সমাজ বা পৃথিবীর পরিবর্তন চাই। কিন্তু নিজেকে বদলানোর ক্ষেত্রে বড়ই কৃপণতা করি বা মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে সমাজ পাল্টানোর চেষ্টা করে থাকি। যেমন পৃথিবীর শত অন্যায় ও অনৈতিক কাজ আছে, যা কেউ পছন্দ করে না। সবাই চায় এসব গর্হিত কাজ বন্ধ হোক। কিন্তু যখন নিজের বেলায় আসে তখন সময়ের দোহাই দিয়ে তা ভালো করে ভোগ করি। দুঃখজনক হলেও এটিই হলো বর্তমান সমাজের বেশির ভাগ মানুষের দ্বৈতনীতি। আমরা মাদকের বিরুদ্ধে কনসার্ট করি, আর ঐ কনসার্টে মাদক সেবন করে গান করি, আমরা সুদ-ঘুষের বিরুদ্ধে কথা বলি, আবার সবার অলক্ষ্যে তা গ্রহণ করি। ন্যায়বিচারের কথা বলি, আবার বিচারকের আসনে বসে অনৈতিক রায় ঘোষণা করি। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার কথা বলি, সভা-সেমিনার করি, আবার ঐসব সভা-সেমিনারে চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা অতিথি হয়। অশ্লীলতার বিরুদ্ধে কথা বলি, আবার অশ্লীলতার সমস্ত আয়োজনে পৃষ্ঠপোষকতা দিই। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলি, আবার বাসায় গিয়ে নারী নির্যাতন করি। নাগরিক অধিকারের কথা বলি, আবার জোর জবরদস্তি ভোট নিয়ে জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করি। বিশ্বব্যাপী শান্তির কথা বলি, আবার দু’ দেশের মধ্যে যুদ্ধ লাগিয়ে এক পক্ষকে অস্ত্রের যোগান দিই। এরকম শত শঠতা আমাদের মাঝে বিরাজমান। এই দ্বিমুখী আচরণ আর চিন্তাধারা দিয়ে তো সমাজ পরিবর্তন করা দূরহ ব্যাপার।

সমকালীন সকল পাপাচারের বর্ণনা আমরা এমনভাবে উপস্থাপন করি, যেন নিজে এসব থেকে পরিপূর্ণ মুক্ত বা নির্দোষ। বিষয়টা এমন হয়ে উঠেছে যে, নিজের পাশে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড যা হয়তো সবকিছু পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে, তা দেখেও আমরা নিশ্চিন্তে বসে আগুনের বর্ণনা দিচ্ছি। অথচ, আমাদের উচিত ছিল আগুনের বর্ণনা দেয়ার আগে অগ্নি নির্বাপণের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা বা সর্বাত্মক চেষ্টা করা। তা না করে আমরা ছড়িয়ে পড়া আগুনে জ্বালানি দেয়ার মতো কাজ করি। আর হতাশার সুরে বলে ওঠি, আমি পরিস্থিতির শিকার। আসলে আমরা পরিস্থিতির শিকার না, আমরা আমাদের কর্মের এবং সিদ্ধান্তের ফলাফল ভোগ করে থাকি। এই বিষয়ে আমেরিকান লেখক ও শিক্ষাবিদ স্টিফেন রিচার্ড কোভি সুন্দর একটি কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ও ধস হড়ঃ ধ ঢ়ৎড়ফঁপঃ ড়ভ সু পরৎপঁসংঃধহপবং, ও ধস ঢ়ৎড়ফঁপঃ ড়ভ সু ফবপরংরড়হ. তাই ভাগ্যের বা পরিস্থিতির দোষ না দিয়ে যদি প্রথমে নিজেকে সংশোধন করি এবং অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস রাখি যে, নিজে বদলে গেলে সমাজ বদলে যাবে, তবেই আমাদের ভেতরকার পরিবর্তন আসবে। যার যেই অবস্থান সে সেই অবস্থান থেকে যদি নিজের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করি এবং নিজের ভেতরের দোষ ত্রুটি শোধরানোর চেষ্টা করি, তাহলে কিন্তু আমাদের চারপাশ এমনিতেই বদলে যাবে এবং সমাজ হয়ে উঠবে ন্যায়ভিত্তিক, সুন্দর ও সাবলীল। মাওলানা জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমি বলেছেন, ‘গতকাল চালাক ছিলাম, তাই পৃথিবীকে বদলাতে চেয়েছিলাম, আজ আমি বিজ্ঞ, তাই নিজেকে বদলাতে চাই।’

লেখক: প্রাবন্ধিক, সৌদি আরব থেকে
Shadat_hussein@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন