রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে কিভাবে জ্বালানি ও খাদ্যশস্য আমদানি করা যায়, এ নিয়ে বিকল্প পরিকল্পনা করছে সরকার। গত বৃহস্পতিবার মন্ত্রীপরিষদ বিভাগে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে আলোচনা করা হয়। বাণিজ্যমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা এবং বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। বৈঠক শেষে মন্ত্রী ও উপদেষ্টা জানান, রাশিয়া ও ইউক্রেনের সঙ্গে লেনদেন করতে পারছে এমন ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ পরিশোধ করে জ্বালানি তেলসহ প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য আমদানির পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করা হয়। পাশাপাশি রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় দেশটিতে ওষুধ সংকট দেখা দেয়ায় ওষুধ কিভাবে রফতানি করা যায়, সে ব্যাপারেও চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় দেশটির সঙ্গে লেনদেনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মুদ্রা ডলার ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে রাশিয়ার মুদ্রা রুবল ছাড়া আমদানির সুযোগ কম। রুবল আন্তর্জাতিক মুদ্রা না হওয়ায় আমদানির ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিয়েছে। ডলার ব্যবহার করে কিভাবে রাশিয়া থেকে পণ্যসামগ্রী আমদানি করা যায়, এ পন্থাও সরকার খুঁজছে। দেশে ক্রমবর্ধমান জ্বালানি ও খাদ্যসংকট নিরসনে সরকারের এ চিন্তাভাবনা ইতিবাচক।
ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুর দিকেই দেশে জ্বালানি সংকট দেখা দেয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। সে সময় রাশিয়া কমদামে বাংলাদেশকে জ্বালানি তেল কেনার প্রস্তাব দিয়েছিল। সরকার তা গ্রহণ করেনি। এ সিদ্ধান্ত অবিবেচনাপ্রসূত ছিল বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। প্রস্তাবটি গ্রহণ করলে জ্বালানির সংকট এত তীব্র হয়ে উঠত না। দেরিতে হলেও এখন রাশিয়া থেকে জ্বালানি ও পণ্যসামগ্রী আমদানির কথা ভাবা হচ্ছে। এক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা। দ্বিতীয় সংকট আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবহার। রাশিয়ার মুদ্রা রুবল আন্তর্জাতিক মুদ্রার স্বীকৃতি না পাওয়ায় পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষেও রুবল জোগান দেয়া কঠিন। দেশে জ্বালানি ও প্রয়োজনীয় পণ্যের সংকট তীব্র হয়ে ওঠায় এখন রাশিয়া থেকে কমদামে আমদানি অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল কিনতে গেলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোর অসন্তুষ্ট হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এমন জটিল পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেল আমদানিতে তৃতীয় পক্ষের কাছ থেকে তেল আমদানির পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, ভারত, চীন ও তুরস্কÑএই তিন দেশের যেকোনো একটি থেকে সরকার চাইলে আমদানি করতে পারে। এদিকে রাশিয়াও বাংলাদেশে তেল বিক্রি করতে আগ্রহী। গত বৃহস্পতিবার রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার মান্টিটস্কি সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, রাশিয়া বাংলাদেশের কাছে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত জ্বালানি তেল বিক্রি করতে চায়। খাদ্যশস্য বিশেষ করে গমও বিক্রি করতে আগ্রহী। প্রাথমিকভাবে চার লাখ মেট্রিক টন গম বিক্রি নিয়ে আলোচনা চলছে। জ্বালানি তেল বিক্রির জন্য ইতোমধ্যে রাশিয়া থেকে প্রায় ৫০ লিটার পরিশোধিত তেলের নমুনা গত বুধবার বাংলাদেশে এসেছে। রাশিয়া থেকে জ্বালানি ও খাদ্যশস্য আমদানির প্রক্রিয়া শুরুর বিষয়টি অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে খাদ্যশস্য আমদানিতে ২৪টি বৈশ্বিক ব্যাংক আমদানিপত্র বা এলসি খুলতে রাজি হয়েছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে খাদ্য আমদানি করতে পারবে। তিনি জানান, রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে পণ্য আমদানিতে কোনো বাধা নেই। বলা বাহুল্য, এ ধরনের উদ্যোগ যত দ্রুত নেয়া যাবে, ততই সংকট নিরসনে সহায়ক হবে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, শুরু থেকেই এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া জরুরি ছিল। সে সময় উদ্যোগ নিলে সংকট এত তীব্র হতো না। এক্ষেত্রে পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। মন্ত্রীপরিষদের এ ধরনের বৈঠক অনেক আগে করা উচিৎ ছিল। আলোচনা করলে যে পথ বের হয়, তা আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠক থেকে বোঝা যায়। এই বৈঠক থেকে এটাও জানা গেছে, রাশিয়ায় ওষুধ রফতানির সুযোগ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান তথ্য দিয়ে জানিয়েছেন, নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ায় ওষুধ সংকট বেড়েছে। দেশটিতে আমাদের ওষুধ রফতানির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বলা বাহুল্য, সংকটের মধ্যে সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে। আমাদের দেশের ওষুধ বিশ্বের প্রায় শতাধিক দেশে রফতানি হচ্ছে। রাশিয়ার মতো বিশাল দেশের বাজারে ওষুধ রফতানি করা গেলে যেমন নতুন বাজার সৃষ্টি হবে, তেমনি রফতানি খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হবে।
আগে রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে ‘পণ্য দিয়ে পণ্য আনা’র প্রক্রিয়া ছিল। এখন নিষেধাজ্ঞার কারণে ডলার ব্যবহার বা রুবলের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না থাকার সংকটের ফলে রাশিয়ার সাথে ‘পণ্য দিয়ে পণ্য’ বিনিময় করার বিষয়টি নিয়ে ভাবা যেতে পারে। রাশিয়া থেকে আমদানির ক্ষেত্রে জাতিসংঘ অনুমোদিত খাদ্যশস্যসহ যেসব পণ্য রয়েছে, সেগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। ইতোমধ্যে রাশিয়া থেকে অতি জরুরি পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হয়েছে। এসব পণ্য কিভাবে আমদানি করা যায়, তার পথ খুঁজতে হবে। রাশিয়া থেকে জ্বালানি ও খাদ্যশস্য আমদানির সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে এবং তা দ্রুতায়িত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন