শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

বিরোধীদলের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করতে দেয়া উচিত

| প্রকাশের সময় : ২৮ আগস্ট, ২০২২, ১২:০০ এএম

জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও ভোলায় পুলিশের গুলিতে দুই নেতার নিহত হওয়ার ঘটনার প্রতিবাদে বৃহত্তম বিরোধীদল বিএনপি একটানা ৫ দিনের বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা করে। এই কর্মসূচি পালনকালে দলটি দেশের বিভিন্ন স্থানে সভা-সমাবেশ ও মিছিল করার সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের হামলা এবং পুলিশের বাধার শিকার হচ্ছে। গত শুক্রবার কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১০ জেলায় হামলা, সংঘর্ষ ও বাধার শিকার হয়েছে দলটি। ৭টি স্থানে এসব হামলার ঘটনায় বিএনপির কমপক্ষে ১৬৯ জন নেতা-কর্মী আহত হয়েছে বলে পত্রিকান্তরে জানা যায়। কোথাও কোথাও পুলিশ গুলিও ছুড়েছে। শুক্রবার মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলায় বিএনপির মিছিলে হামলা চালায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। উপজেলা বিএনপির সদস্যসচিবকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা যেভাবে পেটায়, তার ছবি জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলো গুরুত্বসহকারে প্রকাশ করে। এছাড়া নোয়াখালি, বাঁশখালি, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপির বিক্ষোভ কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনসহ পুলিশের ব্যাপক হামলার ঘটনা ঘটেছে।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দেড় বছরেরও কম সময় বাকি। নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে বিরোধীদলগুলো সরকারবিরোধী কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিয়েছে এবং তা পালন করছে। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে বিরোধীদলের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনে বাধা দেয়া হবে না বলা হলেও মাঠপর্যায়ে সেটার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। বিভিন্ন জেলায় বিএনপির সভা-মাবেশে বাধা ও হামলার ঘটনা ঘটছে। কোথাও কোথাও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পাল্টা কর্মসূচি দেয়ায় ১৪৪ ধারা জারি করে কর্মসূচি ঠেকানো হয়েছে। অথচ ক্ষমতাসীন দল আগামী নির্বাচনে সব দলকে অংশগ্রহণ করানোর জন্য এবং দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিরাজমানÑএটা দেখাতে বিরোধীদলের কর্মসূচি পালনের ক্ষেত্রে কিছুটা নমনীয় হওয়ার অবস্থান নিয়েছিল। বৃহত্তম বিরোধীদল বিএনপি গত ১১ আগস্ট নয়াপল্টনস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বড় সমাবেশ করে। এ সমাবেশের কারণে আওয়ামী লীগের টনক নড়ে। সে-ও পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে ১৭ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকাসহ সারাদেশে বড় সমাবেশ করে। এটা সুষ্ঠু রাজনীতির নিদর্শন। তবে এর ব্যত্যয় ঘটতে থাকে ২২ আগস্ট থেকে। ক্ষমতাসীন দল যেন অসহিষ্ণু হয়ে উঠে। ঐ দিন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বিএনপি জেলা পর্যায়ে লাগাতার বিক্ষোভ সমাবেশ শুরু করে। এই বিক্ষোভ সমাবেশ পালনের দিন থেকেই দেশের কোনো না কোনো স্থানে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে হামলা হয়েছে এবং হচ্ছে। পুলিশও মারমুখী আচরণ করছে। এ ঘটনা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ, মিছিল ও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনে বাধা না দেয়ার ঘোষণা থেকে সরে এসেছে। তার কথার সাথে কাজের মিল পাওয়া যাচ্ছে না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, বিরোধীদল সরকারের কর্মকাণ্ড ও নীতির সমালোচনা কিংবা জনসাধারণের সমস্যা এবং সরকারের নেয়া যথাযথ পদক্ষেপের অভাব নিয়ে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করবে। এক্ষেত্রে সরকারও তার অবস্থান স্পষ্ট করে কর্মসূচি পালন করতে পারে। এমনকি বিরোধীদলের কর্মসূচি ও দাবি তার পছন্দ না হলেও তা পালনে সহায়তা করা সরকারের দায়িত্ব। এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে বিরোধীদলের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা ও হামলা করা কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক আচরণের পরিচায়ক নয়। তার চেয়েও গর্হিত কাজ, বিরোধীদলের কর্মসূচি ব্যর্থ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করা। আমাদের দেশে গণতন্ত্র ক্রমেই সংকুচিত হয়ে হাইব্রিড গণতন্ত্রের দিকে ধাবিত, এ তথ্য বিশ্ব গণতন্ত্র সূচকে বেশ কয়েক বছর ধরেই উঠে আসছে। ডেমোক্রেসি ম্যাট্রিক্স-এর সূচকে বাংলাদেশ চিহ্নিত হয়েছে ‘মডারেট অটোক্রেসি’র দেশ হিসেবে। ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)-এর ২০২১ সালের সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশ রয়েছে ‘হাইব্রিড রেজিমে’। উন্নত দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্বীকৃত সংস্থার প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ‘কর্তৃত্ববাদে’র উদ্ভব হয়েছে বলে বলা হয়েছে। এ ধরনের তথ্য ও প্রতিবেদন দেশের ভাব মর্যাদার জন্য মোটেই কোনোভাবেই ইতিবাচক নয়। সরকার এ বিষয়গুলো খুব একটা আমলে নিয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। বরং বিরোধীদলের রাজনৈতিক কর্মসূচি সংকুচিত ও সীমাবদ্ধ করার দিকেই বেশি নজর দিয়েছে। সভা-সমাবেশে বাধা তো আছেই, এমনকি অতি সাধারণ ও নিরীহ মানববন্ধনের মতো কর্মসূচিতেও বাধা দেয়া হচ্ছে। আগামী জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করার ক্ষেত্রে সরকারের এমন আচরণ প্রতিবন্ধক হয়ে উঠবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

বিরোধীদলের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধা ও হামলার মাধ্যমে পণ্ড করে দেয়ার ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের একশ্রেণীর অতি উৎসাহী নেতা-কর্মী যে জড়িত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণীর অতি উৎসাহী সদস্যও জড়িত। তারা সরকারি দলের কর্মীর মতোই আচরণ করছে। এ ধরনের প্রবণতা দীর্ঘদিন ধরে পরিলক্ষিত হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা বিরোধীদলের কর্মসূচিতে বাধা ও হামলা করলে ঐ শ্রেণীর পুলিশ হয় তাদের সাথে যোগ দেয়, না হয় দাঁড়িয়ে থেকে প্রশ্রয় দেয়। এছাড়া বিরোধীদলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে হয়রানি ও গ্রেফতারের প্রক্রিয়া অবলম্বন করে। এ ধরনের আচরণ গণতান্ত্রিক পরিবেশকে কলুষিত ও উত্তপ্ত করে তোলে। এমন আচরণ থেকে বিরত থাকতে হবে। জাতীয় নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে রাজনীতিতে এক ধরনের অসহিষ্ণুতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশেষ করে বিরোধীদলের প্রতি ক্ষমতাসীন দলের অসহিষ্ণু হওয়া থেকে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। সামনের দিনগুলো আরও অসহিষ্ণু ও সংঘাতপূর্ণ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এটা ভালো লক্ষণ নয়। এতে দেশের সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ যেমন বিঘ্নিত হবে, তেমনি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এখন খুবই সংকটজনক এবং নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষ ত্রাহি অবস্থার মধ্যে রয়েছে। এ প্রেক্ষিতে, নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংঘাতপূর্ণ হয়ে উঠলে দেশের কি অপরিমেয় ক্ষতি হবে, তা ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই। ক্ষমতাসীন দলের যেমন এ বিষয়টি অনুধাবন করে বিরোধীদলের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনে কোনো ধরনের বাধা দেয়া উচিৎ নয়, তেমনি জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে এমন কর্মসূচি দেয়া থেকেও বিরোধীদলকে সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে। উভয় পক্ষই শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে সহিষ্ণু ও গণতান্ত্রিক আচরণ করবে, সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন