কোভিড সঙ্কট মোকাবিলা করে যখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল বাংলাদেশ, ঠিক তখনই অর্থনীতিতে যমদূতের মতো আবির্ভূত হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন সঙ্কট। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, মাঙ্কিপক্স বিশ্বে যেভাবে দ্রুত হারে ছড়াচ্ছে, তা বাংলাদেশের দুয়ারেও কড়া নাড়ছে বলে। এ সংকট যে অতি শীঘ্র কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়, তা ধীরে ধীরে স্পষ্ট। ফলে বৈশ্বিক উৎপাদন, খাদ্য উৎপাদন, দারিদ্র্য ও বেকারত্ব নিয়ে আশঙ্কা করছেন আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা থেকে শুরু করে অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত বিজ্ঞজনরা। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি নিয়েই জেরবার বিশ্ববাসী, যা প্রতিটি দেশেই ডলারের সংকট তৈরি করছে। সংকুচিত হচ্ছে প্রতিটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ। উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে অর্থনীতির অন্যান্য সূচকও ঠিকঠাকভাবে কাজ করে না, বরং কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রা সংকোচনের যে নীতি গ্রহণ করে তাতে সফল না হলে, অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দেয়ারও সমূহ আশঙ্কা থাকে। অর্থনীতির পরিভাষায় একে স্ট্যাগফ্লেশন বলা হয়। এমনই এক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে- বিশ্ব অর্থনীতির মোড়লখ্যাত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। চীন কোভিডের প্রতি জিরো টলারেন্স ঘোষণা করায় তার অর্থনীতি সঙ্কুচিত হচ্ছে। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার উৎপাদনও কমেছে। আর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে ইউরোপের অর্থনীতিতে মন্দার মন্দবাতাস ঘনীভূত হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস গত মাসে বলেছেন, বেশিরভাগ দেশই মন্দার দিকে। আইএমফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিভা বলেছেন, বিশ্ব অর্থনীতির ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন ও অনিশ্চিত। বৈশ্বিক এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মতো আমদানিনির্ভর একটি দেশের পক্ষে এককভাবে কতটুকু ভালো থাকা যায়, যেখানে রপ্তানি বাণিজ্য সিংহভাগই ইউরোপ-আমেরিকার সঙ্গে হয়। ডলার নিয়ে এখন পুরো বিশ্বে চলছে মাতম। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ধরে রাখতে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও মরিয়া। ডলারের বাজারে অস্থিরতা, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সঙ্কট- সব মিলিয়ে অর্থনীতির আবহাওয়া চরমভাবাপন্ন। এই সঙ্কট মোকাবিলায় সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে ব্যয় কাটছাঁট করা হচ্ছে। বিলাসপণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণ, বিদ্যুৎ খাতে লোডশেডিং জ্বালানি সাশ্রয় ইত্যাদি সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। এছাড়া রাষ্ট্রপক্ষ থেকে জনগণকে মিতব্যয়ী হওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। লক্ষ্য এই দুর্মূল্যের বাজারে খরচ কমিয়ে যতটা আমদানি ব্যয় কমানো যায়। তাই ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে সামাজিক এমনকি রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত সবাইকে দায়িত্বশীল হতে হবে।
মনে রাখতে হবে, বৈশ্বিক এই সঙ্কটের অভিঘাত প্রতিরোধ বা এড়িয়ে যেতে না পারলেও, অভ্যন্তরীণ বিষয়াদিতে নজর দিয়ে যতটা ভালো থাকা যায়। এই ডলার অস্থিরতার পেছনে পাচারকারী বা কারসাজিচক্রের কোনো হাত আছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে। আর বৈশ্বিক বাজারে দ্রব্যমূল্য কমলেও আমদের দেশীয় বাজারে দাম সহসা কমে না, এটি-তো চিরায়ত। খাদ্যদ্রব্যের বাজারে অসাধু, লোভী সিন্ডিকেটের কথা তো সবারই জানা। সরকারকে কঠোরভাবে বাজারের এই সিন্ডিকেট ভেঙে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে হবে। না হয়, দেশের জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ যে অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে, তা রাজনৈতিক মাঠেও উত্তাপ ছড়াবে। সেটি কিন্তু নিশ্চিত। জনসাধারণ এত বুঝতে চায় না- ব্যাংকের যে রিজার্ভ আছে তা দিয়ে কতদিনের দেশের আমদানি ব্যয় (তিন মাসের, না পাঁচ মাসের) মিটানো সম্ভব? তারা বুঝতে চায় না, দেশে বর্তমানে যা রিজার্ভ আছে তা দিয়ে- নয় মাসের খাদ্যশস্য কেনার সক্ষমতা আছে সরকারের। তারা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে- এখন আগের মতো ব্যাগ ভরে বাজার করা যায় না, কম খেয়েপরে বেঁচে থেকে কৃচ্ছ্রসাধনের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে অথবা সঞ্চয় ভেঙে খেতে হচ্ছে। দেশের জনগণ প্রায় এক যুগ ধরে লোডশেডিংয়ে অভ্যস্থ নয়। আবার হঠাৎ করে জ্বালানি তেলের রের্কড মূল্যবৃদ্ধি তাদের হতাশা বড়িয়ে দিয়েছে। জনগণের পক্ষে বোঝা সহজ নয়, এটা মূল্যবৃদ্ধি না আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মূল্য সমন্বয়। দিন দিন সরকারের ভর্তুকি ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে, শেষ বিচারে জনগণেরই দায়ের বোঝা ভারী হবে।
জনসাধারণের ভাবনা, দ্রুত কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া এই দেশে সঠিকভাবে বিত্তবান করযোগ্য লোক চিহ্নিত করে, করের আওতা বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের এই বোঝা কিছুটা হালকা করা যেত কি না। আবার এর ফলে কর-জিডিপি অনুপাতের বৈশ্বিক তালিকায় নিচের দিকে অবস্থানের লজ্জা থেকেও রেহাই পেত বাংলাদেশ। কর-জিডিপি অনুপাতে এই তলানিতে থেকেও যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিইবিআরের পূর্বাভাস অনুযায়ী, বাংলাদেশ নাকি ২০৩৫ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৫তম অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার পথে। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্ট ইউনিট, মুডিসসহ বিশ্বখ্যাত সংস্থা বাংলাদেশের অর্থনীতি যে সহজে গতি হারাবে না- এমন আশার বাণী শোনালেও, ওসব বুঝে জনগণের কাজ নেই। শ্রীলঙ্কার এই শ্রী যে একদিনে হয়নি- তা জনগণ ভালো করে জানে।
জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, দেশে ৩৬ দিনের জ্বালানি মজুত ও পাইপলাইনে আছে আরও ছয় মাসের। তাহলে লোডশেডিং বা কৃচ্ছ্রসাধনের চেষ্টা কেন? এটি কি সরকারের আগাম সতর্কতা? তা জনগণের পক্ষে বোঝা কঠিন। তারা শঙ্কিত, কারণ প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কায় বিদ্যুৎ, গ্যাস, জ্বালানি সঙ্কট নিয়ে যে লঙ্কানদের আহাজারি, সেটিই তাদের মাথায় বারবার ঘুরেফিরে আসছে। বৈদেশিক ঋণ নিয়ে শ্রীলঙ্কা যে, তা সম্পদে রূপান্তর করতে পারেনি, ঋণীই রয়ে গেছে, অবশেষে দেউলিয়া হয়েছে। তাই বাংলাদেশের মেগা প্রজেক্টগুলো, যা বৈদেশিক ঋণের টাকায় করা হয়েছে, তা নিয়ে জনগণ চিন্তিত। আবার শুনতে পাচ্ছে, সরকার সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ করার পাঁয়তারা করছে। তাই-তো সব চিন্তা এখন তাদের দুশ্চিন্তায় পর্যবসিত হয়েছে। ভাবনাটা এরকম- বাংলাদেশ কি তাহলে শ্রীলঙ্কার মতো ঋণের জালে আটকে যাচ্ছে। এই প্রশ্নই তাদের মনের গহিনে উঁকি দিচ্ছে। অথচ, বাংলাদেশে এখনো ‘বৈদেশিক ঋণ’ জিডিপির মাত্র ১৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ, যা যথেষ্ট স্বস্তিদায়ক অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির স্থায়ীত্ব বা সম্ভাবনা নিয়ে দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমস পত্রিকা বা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ^খ্যাত সাময়িকী নিউজউইকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে নিবন্ধ লেখা হচ্ছে। ধরে নিলাম, এগুলো সবই খুশির সংবাদ। এতে কি চিন্তামুক্ত থাকা যায়?
বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশে যে আর্থিক অনাচার সংঘটিত হয়েছে এবং হচ্ছে তার তালিকাও কম বড় নয়। ব্যাংকের খেলাপি ঋণ, উচ্চ সুদের ঋণে প্রকল্প বাস্তবায়ন ও মাত্রাতিরিক্ত সময় বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ ও স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি, আর্থিক অব্যবস্থাপনা, শেয়ারবাজারে হরিলুট ও মুদ্রা পাচার- এই অপকর্মগুলো অস্বীকারের উপায় কোথায়? এবার আমাদের এই অর্থনীতির সঙ্কট যুগপৎভাবে বৈশ্বিক ও দেশীয় এ-দু কারণেই। রাশিয়া-ইউক্রেন সঙ্কট আমাদের অর্থনীতিতে বিদ্যমান দুর্বলতাকে ত্বরান্বিত করেছে মাত্র। তাই টেকসই উন্নয়ন ও এর ধারাবাহিকতার স্বার্থেই আমাদের অর্থনীতিসহ সব খাতের সংস্কার করতে হবে। এই অপকর্মের হোতাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। টাকা পাচার বন্ধ করতে হবে। কর-জিডিপির অনুপাত বাড়াতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তা না করা গেলে আজ হোক কাল হোক অর্থনীতিতে সঙ্কট অবধারিত।
লেখক: পুঁজিবাজার বিশ্লেষক
monirulislammi888@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন