বিচিত্র সৃষ্টির স্রষ্টা নজরুল। তাঁর প্রতিভার অন্ত পাওয়া ভার। তিনি শুধু কবি নন, তিনি গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, অভিনয় শিল্পী, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, সম্পাদক এবং অনুবাদক। সবচেয়ে বড় কথা, নজরুল একজন পূর্ণ সংগীত ব্যক্তিত্ব। তিনি গীতিকার, গীতিনাট্য রচয়িতা, গায়ক, সুরকার, সুরস্রষ্টা, সংগীত শিক্ষক, সংগীত পরিচালক। তাঁর জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় কেটেছেও সংগীত জগতে। জন্ম ১৮৯৯ সালের ২৪ মে। বাংলা ১৩০৬ সনের ১১ জৈষ্ঠ্য। দেখা যায়, তার সৃষ্টিশীল জীবন ১৯২০ সালের মার্চ মাস হতে ১৯৪২ সালের ৯ জুলাই পর্যন্ত, মোট ২২ বছর ৩ মাস তাঁর কেটেছে সংগীত নিয়ে। ১৯৪২ সালের কথা যখন বলছি, তখন বলতে হচ্ছে, ওই সালের ১০ জুলাই বেতারে শিশুদের আসরে দশ মিনিটের একটি কথিকা প্রচারের সময় নজরুল রোগাক্রান্ত ও বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। ১৯৪১ সালের আগস্টে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু সংবাদ শুনে মধ্যাহ্নেই লিখেন ‘রবিহারা’ কবিতা এবং সঙ্গে সঙ্গে শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে সেটি তিনি বেতারে প্রচার করেন। কবিতাটি ছিল, ‘ঘুমাইতে দাও শান্ত কবিরে।’ দেখা গেছে, ১৯৪২ সাল কবির পক্ষে খুবই খারাপ সময় ছিল। কবি ও কবিপত্নী দু’জনই শয্যাশায়ী ছিলেন। আয়ের উৎস ছিল না। চরম আর্থিক অনটন চলছিল। বাড়ি ভাড়া প্রদান, চিকিৎসা চালানো ছিল অসম্ভব। এমতাবস্থায়, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি পাঁচশো টাকা কবির হাতে তুলে দিয়েছিলেন। কবি ওই সালেই মানসিক ভারসাম্য হারালে অক্টোবরে মানসিক চিকিৎসালয়ে ডা. নগেন্দ্রনাথ দে ও ডা. গিরীন্দ্রশেখর বসু কবির চিকিৎসা করেন। কবির আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে ১৯৪৩ সালে ‘নজরুল সাহায্য কমিটি’ গঠন করা হয়। ওই কমিটির সভাপতি ও কোষাধ্যক্ষ হয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি, যুগ্ম সম্পাদক সুফি জুলফিকার হায়দার ও সজনীকান্ত দাস।
যাক, এখন আবার ফিরে যাচ্ছি কবি নজরুল ও গীতিকার নজরুলের আলোচনায়। অবশ্য বলতে হয়, কবিতা ও গানের মধ্যে আদৌ কোনো বিরোধ নেই। উভয়ের জন্ম একই ভাবাবেগ থেকে। অন্তরস্থ সৃষ্টিশীল আবেগের বাণীমূর্তি প্রকাশ পায় কাব্যে আর সুরমূর্তি জাগে সংগীতে। আবার কাব্য ও সংগীতের মৌলিক উপাদান হলো ধ্বনি। দেখা যায়, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল এই দু’জনের মধ্যেই উৎকৃষ্ট কবিতা ও শ্রেষ্ঠ সংগীতের আশ্চর্য সমন্বয় ঘটেছিল। নিশ্চয় তা বাংলা সাহিত্যের এক দুর্লভ সৌভাগ্য। আরো বড় কথা হলো, বাংলা সংগীতের ক্ষেত্রে দু’জনই ছিলেন দু’ দিকপাল। নজরুলের বেলায় বলা চলে, নজরুল কখনো কোনো ঘাটে তাঁর সৃষ্টির তরি নিয়ে দীর্ঘকাল অবস্থান করেননি। প্রথমে লেখা শুরু করলেন গল্প, সেটি ত্যাগ করে শুরু করলেন কবিতা, প্রবন্ধ। চলল কিছুদিন। তারপর উপন্যাস। নাটক নিয়েও সময় ব্যয় করলেন। কিন্তু এসবের মধ্যে সংগীত চর্চা চলল সমানে। সজ্ঞান অবস্থার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সংগীতের সোনার ফসলে তাঁর তরি পূর্ণ হয়ে উঠল।
নজরুলের জীবন ধারায় দেখি, ১৯০৩ থেকে ৮ সাল পর্যন্ত গ্রামের মক্তবে পাঠ শুরু। কিন্তু পাঠ শুরু করলে কী হবে, পিতা কাজী ফকির আহমেদের মৃত্যু হলো কবির মাত্র ৯ বছর বয়সে, ১৯০৮ সালে। বাধ্য হয়ে কবি ১৯১০ সালে লেটো দলের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করলেন। আবার ১৯১১ সালে মাথরুন গ্রামে নবীনচন্দ্র ইন্সটিটিউটে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হলেন। আবার স্কুল ত্যাগ। লেটো দলে যোগদান। লেখেন দাতা কর্ণ, মেঘনাদ বধ, শকুনি বধ, কবি কালিদাস, আকবর বাদশা প্রভৃতি পালাগান। গান শুনে মুগ্ধ গার্ড সাহেব কবিকে খানসামার চাকরি দেন। বেশিদিন সে চাকরি করলেন না। চাকরি ত্যাগ করে আসানসোলে এম বখশের রুটির দোকানে এক টাকা বেতনে বয়ের চাকরি নিলেন। পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর কাজী রফিজ উল্লাহ ও তাঁর স্ত্রী শামসুন্নেসা খানমের দৃষ্টি পড়ায় তাঁদের বাড়িতে পাঁচ টাকা বেতনে চাকরি নিলেন এবং সাব-ইন্সপেক্টরের সহায়তায় আবার সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হলেন। ১৯১৭ সালে দশম শ্রেণীর প্রি-টেস্ট পরীক্ষা না দিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দিলেন।
দেখা যায়, ১৯১৮-১৯ সালে ব্যাটালিয়ন কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পদে পদোন্নতি পাওয়ার পর সাহিত্য চর্চা শুরু। গল্প-কবিতার প্রকাশ। তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘মুক্তি’। সেটি ত্রৈমাসিক বঙ্গীয় সাহিত্য পত্রিকায় ওই সময়েই প্রকাশিত হয়। ১৯২০ সালের মার্চে ৪৯নং বাঙালি পল্টন ভেঙে দেওয়া হলে কবি এসে উঠেন শৈলজানন্দের বাসায়। পরে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে। ১৯২২ সালের অক্টোবরে প্রথম কবিতার বই ‘যুগবাণী’ প্রকাশিত হবার পর সরকার বইগুলো বাজেয়াপ্ত করে। অবশ্য সেপ্টেম্বরে ‘অর্ধ সাপ্তাহিক ধুমকেতু’ প্রকাশের পরই তাঁর নামে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি হয়। অবশেষে ওই সালের নভেম্বরে কবিকে গ্রেফতার করা হয় কুমিল্লা থেকে। ১৯২৩ সালের জানুয়ারিতে হয় বিচার। বিচারে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। জেলে বসেই কবি রচনা করলেন ঐতিহাসিক ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’।
এভাবে ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে চলে কবির সাহিত্য সাধনা। এল ১৯৩০ সাল। বড় করুণ ওই সাল। বড় মর্মান্তিক। কবির আধ্যাত্মিকতার দিকে পদচারণা শুরু হলো ওই সালে। মে মাসে কবির অতি প্রিয় পুত্র বুলবুলের মৃত্যু হয়। বসন্তরোগে। মাত্র চার বছর বয়সে। ওই সালের রুবাাইয়াত-ই-হাফিজ গ্রন্থটির অনুবাদ পত্রে পিতার আর্জি ছিল, ‘বাবা বুলবুল। তোমার মৃত্যুশিয়রে বসে ‘বুলবুল-ই-সিরাজ’ হাফিজের রুবাইয়াতের অনুবাদ আরম্ভ করি, যেদিন অনুবাদ শেষ করে উঠলাম, সেদিন তুমি আমার কাননের বুলবুলি উড়ে গেছ, যে দেশে গেছ তুমি, সে কি বুলবুলিস্থান ইরানের চেয়েও সুন্দর?’
কবির জীবনধারা দেখে বিস্মিত হতে হয়। অফুরন্ত দুঃখ-কষ্টের মধ্যে অফুরন্ত সৃষ্টি কীভাবে সম্ভব হলো ভাবলে অবাক লাগে। যা হোক, ১৯৬৯ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধি প্রদান করে। আবার ১৯৭২ সালের ২৪ মে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রচেষ্টায় কবিকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয় এবং ২৫ মে সারাদেশে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় কবির ৭৩তম জন্মজয়ন্তী পালন করা হয়। বাংলাদেশ সরকার কবিকে ঢাকায় এনে শুধু জন্মজয়ন্তী পালন করেনি, কবিকে রাজকীয় সম্মান দেয়। কবির সুখ-শান্তির জন্য বাড়ি-গাড়ি-ডাক্তার-নার্স সবকিছুর ব্যবস্থা করে। ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কবিকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধি প্রদান করে। ১৯৭৫ সালের ২২ জুলাই কবির স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। ঢাকার পিজি হাসপাতালের ১১৭নং কেবিনে কবিকে স্থানান্তর করা হয়।
এল মহাকবির মহাপ্রস্থানের ১৯৭৬ সাল। ওই বছরের জানুয়ারিতে কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার ‘২১ শে পদক’ প্রদান করে সম্মান জানানো হয়। এগিয়ে এল ২৪ মে নজরুল জন্মোৎসব। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়তো শেষ সম্মান জানানোর সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি বলেই হাসপাতালে গিয়ে কবিকে সেনাবাহিনীর ‘আর্মি ক্রেস্ট’ প্রদান করলেন।
২৪ মে-র পরই কিন্তু সময় কড়া নাড়তে শুরু করে। শয্যাশায়ী কবি চলেই যাবেন পরপারের দিকে। এলো ২৭ আগস্ট শুক্রবার বিকাল। দেহের উত্তাপ বৃদ্ধি পেতে লাগল। ২৮ আগস্ট শনিবার উত্তাপ ক্রমশ বেড়ে গেল। ডাক্তাররা জানালেন, ব্রঙ্কো-নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত কবি। কোনো রকমে পার হলো ওই দিন-রাত। ২৯ আগস্ট রবিবার দেহের উত্তাপ বেড়ে ১০৫ ডিগ্রিতে পৌঁছাল। শুরু হলো শেষ চেষ্টা। অক্সিজেন দেওয়া। সাকশন প্রথায় ফুসফুস থেকে কফ বের করার চেষ্টা করলেন চিকিৎসক ডা. নুরুল ইসলাম, ডা. নাজিমুদ্দৌলা চৌধুরী ও নার্স সামসুন্নাহার। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে সকাল ১০টা ১০ মিনিটে কবির যাত্রা শুরু হয়ে গেল মহাপ্রস্থানের পথে। চিরস্তব্ধ দেহ পড়ে থাকল বিছানায়। প্রচারিত হলো কবির মৃত্যু সংবাদ। সাড়ে চারটায় লাখো মানুষের ঢল নামল রমনার সবুজ প্রান্তরে। এ যেন জনসমুদ্র। রাষ্ট্রপতি, সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা, কবি-সাহিত্যিকরা এবং লাখো লোকের উপস্থিতিতে রমনার সবুজ প্রান্তরে নামাজে জানাজা সম্পন্ন হলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের প্রান্তরে সমাহিত করা হলো কবিকে। মরদেহ কবরে নামানোর সঙ্গে সঙ্গে লাখো কণ্ঠে উচ্চারিত হলো কালেমা শাহাদাৎ। পতাকা অর্ধনমিত হলো। জাতীয় সংসদে এক মিনিট নীরবতা পালনের মাধ্যমে কবির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হলো।
নজরুল এক বিস্ময়। যখনই তাঁকে নিয়ে ভাবি তখনই মনে হয়, এই বিস্ময় পুরুষ বাংলা সাহিত্য ও বাংলা সংগীতকে যেভাবে জাগরিত করেছেন তা শুধুু বাঙালির গর্ব নয়, উপমহাদেশের সকল মানুষের গর্ব। কিন্তু দুঃখ হয়, মুষ্টিমেয় কিছু কায়েমী স্বার্থান্বেষীর কাছে নজরুলগীতি নাকি একদিন প্রবল বাধার সম্মুখীন হয়েছিল দেখে। তথাকথিত অভিজাত মহল নজরুলগীতির অপপ্রচার করেছিল জেনে কষ্ট হয়। মাত্র তেরো বছরে যিনি রচনা করেছেন প্রায় পাঁচ হাজার গান, যা পৃথিবীর অন্য কোনো সংগীত রচয়িতার পক্ষে অসম্ভব এবং অকল্পনীয়, সে পরম সংগীত বিস্ময় পুরুষকে পিছনে ফেলব বলেও পিছনে ঠেলে দেওয়া যায়নি। যুগে যুগে প্রবল প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেও নজরুল-সংগীত আপন মহিমায় ভাস্বর। রবীন্দ্রনাথ ২২০০ গান রচনা করেছেন প্রায় ষাট বছর ধরে, কিন্তু নজরুলে মাত্র তেরো বছরে তাঁর দ্বিগুণের অধিক। তা-ও গান রচনা করেছেন, সুরও দিয়েছেন। নিজেও গেয়েছেন। নতুন রাগ ও সুর সৃষ্টি তাঁর শ্রেষ্ঠতম অবদান। এক সময় নাকি রবীন্দ্রনাথের গান চাপা পড়ে গিয়েছিল সুরের একঘেঁয়েমির জন্য।
জানতে পারি, নতুন সুর সৃষ্টির সময় নজরুল জগত সংসার থেকে পৃথক হয়ে যেতেন। দরজা বন্ধ থাকত। ধ্যানমগ্ন হতেন। গভীর রাতেই চলত সুর সৃষ্টি। অনেক সময় তাঁর চেতনা থাকত না। নজরুলের রাগগুলো নাকি স্বপ্নে ও ধ্যানে পাওয়া। সংগীতের প্রতি অনুরাগ নজরুলের আবাল্য। শুরু থেকেই একদিকে সংগীত রচনা অন্যদিকে করেছেন সুর সংযোগ।
যা হোক, পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বাধিক সংগীত রচয়িতার শিরোপাসহ সুর যোজনায় এবং নতুন সুর সৃষ্টিতে নজরুল যে অসামান্য অবদান রেখেছেন বাংলা সংগীতে তার দ্বিতীয় নজির নেই। আগামীতেও তাঁর এ রেকর্ড ভাঙবে কিনা সন্দেহ।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন