শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আন্তর্জাতিক সংবাদ

ভারতে হুমকির মুখে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা

দ্য ইকোনোমিস্ট | প্রকাশের সময় : ৩১ আগস্ট, ২০২২, ১২:০০ এএম

আগস্টের শেষের দিকে এশিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ভারতের গৌতম আদানি এনডিটিভি কেনার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন, যা ভারতের গণমাধ্যমে বিপদের ঘণ্টা বাজিয়ে চলেছে। এর কারণ তিনি দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ। ভারতের রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের মালিকানাধীন বেশিরভাগ চ্যানেল মুকেশ আম্বানির নিয়ন্ত্রিত। তিনিও মোদির বন্ধু। ফলে, যেসব সাংবাদিক এখন পর্যন্ত সরকারের সমালোচনা করতে ইচ্ছুক, বা শুধুমাত্র নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে সংবাদ পরিবেশনে ইচ্ছুক, তারা ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে ক্রমবর্ধমানভাবে সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হচ্ছেন।

মোদির সরকারের অধীনে অন্যান্য চ্যানেলেও নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা অবশ্যই সঙ্কুচিত হবে এবং তার ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি), এধরনের পুরনো কৌশলের ব্যবহার ব্যাপক হারে বাড়িয়েছে। স্বতন্ত্র সাংবাদিকরা বলছেন যে, বিজেপির গণমাধ্যমে নজরদারির বাণিজ্যিক অস্ত্র সংবাদ বিভাগের ওপর ক্রমাগতভাবে আরো চাপ সৃষ্টি করছে। কখনও কখনও মালিকদের পক্ষ থেকেও শান্ত শাসানি নেমে আসছে, যা ভারতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।

তবে, গণমাধ্যমকে আয়ত্তে রাখতে মোদির সরকার আরো সৃজনশীল হয়েছে। সাংবাদিকরা বলছেন যে, কেবল মানহানির আইন নয়, তারা ক্রমবর্ধমানভাবে সরাসরি আইনি হুমকির মুখে পড়ছেন। ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি স্বাধীন নিউজ ওয়েবসাইট দ্য ওয়্যারের সহ-প্রতিষ্ঠাতা সিদ্ধার্থ ভারদারাজন বলেছেন যে, তাদের পছন্দের একটি অস্ত্র হল মানহানির মামলা। মামলা সাংবাদিকদের কাজকে ব্যাহত করে এবং তাদের দীর্ঘ, প্রায়শই বছরের পর বছর ধরে আইনি প্রক্রিয়ায় আবদ্ধ করে। সৌভাগ্যবশত, সাংবিধানিক সুরক্ষা তাদের অনেককে কারাগারে নিক্ষিপ্ত করতে বাধা দেয়।

সমালোচকদের আরও কার্যকরভাবে ভয় দেখানোর জন্য রাষ্ট্রদ্রোহ বা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার নামে শাসক দল বিজেপি ফৌজদারি আইন ব্যবহার করার স্বপ্ন প্রথম দেখেছিল। এগুলি প্রাক-বিচারিক সময়ে দীর্ঘদিন আটকের অনুমতি দেয়। ভারদারাজন মনে করেন যে, সরকার মহামারী চলাকালীন সমালোচনা দমন করার জন্য এই জাতীয় আইনগুলিকে আরও নিবিড়ভাবে ব্যবহার করতে শুরু করেছিল, যখন এটি জনস্বাস্থ্যের কারণে বিস্তৃত ক্ষমতা পেয়েছিল। তিনি বলেন, ‘সরকারকে বিদ্যমান স্বৈরাচারী প্ররোচনা দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছিল।’
ছোট প্রতিষ্ঠানগুলির স্বতন্ত্র সাংবাদিকরা এর কুফল খুব বেশি অনুভব করে। কারণ তাদের বড় প্রতিষ্ঠানগুলির মতো আইনি সংস্থান নেই। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন মূলত, হিন্দু-জাতীয়তাবাদী বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির মুসলিম সাংবাদিকরা। ২০২০ সালের অক্টোবরে কেরালার সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পান একজন দলিত তরুণীর ধর্ষণ ও হত্যার বিষয়ে প্রতিবেদন করার সময় গ্রেপ্তার হন। এর জেরে তিনি দুই বছর উত্তর প্রদেশের কারাগারে কাটান। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছিল।

একটি ফ্যাক্ট-চেকিং পরিষেবার সহ-প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ জুবায়ের সম্প্রতি একটি বেনামী অভিযোগের ভিত্তিতে তিন সপ্তাহের বেশি প্রাক-বিচারিক আটকাবস্থায় কাটিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ যে, তার একটি চার বছর বয়সী টুইট হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে। কাশ্মীরি সাংবাদিক ফাহাদ শাহ, সাজাদ গুল এবং আসিফ সুলতানকে জননিরাপত্তা আইনের অধীনে সন্ত্রাসী অপরাধের অভিযোগে জম্মুতে কারাবন্দী রাখা হয়েছে।

রাজ্য সরকারগুলি সংবাদ মাধ্যমের সদস্যদের ভয় দেখানোর জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের মতোই প্রস্তুত। বিজেপি-পরিচালিত গুজরাট কর্তৃপক্ষ গত সপ্তাহে মুখ্যমন্ত্রীর সম্ভাব্য বরখাস্তের বিষয়ে অনুমান করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর ঘৃণা ছড়ানোর দায়ে দুই সাংবাদিককে অভিযুক্ত করেছে (বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর পূর্বসূরি সম্পর্কে একই ধরনের প্রতিবেদনের জেরে ২০২০ সালের মে’তে আরেকজন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয় এবং রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়।) পশ্চিমবঙ্গে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোে প্রতিবেদন প্রকাশের পর ২০২০ সালে দুই সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়। মে মাসে ভারতের প্রেস ক্লাব দিল্লির শাসক দল আম আদমি পার্টির কাছে অভিযোগ করে যে, একজন সাংবাদিক মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের একটি সংবাদ সম্মেলনের বাইরে পুলিশ দ্বারা নিগৃহিত হয়েছেন।

পরামর্শক প্রতিষ্ঠান রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স এবছর তার সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বার্ষিক সূচকে ভারতকে ১শ’ ৫০ তম স্থানে (১শ’ ৮০টি দেশের মধ্যে) স্থান দিয়েছে। এটি এপর্যন্ত ভারতের সর্বনিম্ন অবস্থান। কিছু সাংবাদিক এই সত্যে সান্ত্বনা খোঁজার চেষ্টা করেন যে, আরও প্রতিকূল পরিবেশ তাদের আরও ভাল কাজ করতে বাধ্য করতে পারে। অনেক সাহসী ব্যাক্তি সাংবাদিক হয়রানি, ভয়ভীতি বা জেলের হুমকিকে অস্বীকার করে। কিন্তু,আদানি যদি এনডিটিভি দখল করতে সফল হন, তাহলে আশঙ্কা হল যে, ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী সংবাদ মাধ্যমের মুক্ত কন্ঠ বা সত্য বলার জায়গা আরও সঙ্কুচিত হয়ে যাবে। আর, ভারতীয় সাংবাদিকরা যখন মুখ থুবড়ে পড়বেন, তখন ভারতের অগ্রযাত্রা থেমে যাবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন