শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

জেনারেল ওসমানীর কাছে আমাদের অশেষ ঋণ

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ১ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

পৃথিবীর প্রায় সব মানুষই তাঁর জীবনকালে নিজের বা ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য কিছু করে রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু কিছু ব্যতিক্রমী মানুষও আছেন, যারা আজীবন দেশ ও জাতির জন্য কাজ করে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে গেছেন। নিজের সুখ, শান্তি, আরাম, আয়েসের জন্য সামান্য চিন্তাও করেননি। বঙ্গবীর আতাউল গণি ওসমানী এমন এক ব্যক্তিত্ব, যিনি তাঁর জীবনকর্ম দেশ ও জাতির জন্য উৎসর্গ করে গেছেন, অমর হয়ে রয়েছেন দেশবাসীর হৃদয়ে।

আতাউল গণি ওসমানী ১৯১৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তাঁর পিতার কর্মস্থল সুনামগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈত্রিক স্থায়ী নিবাস সিলেট হতে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে বালাগঞ্জ থানার দয়ামীর নামক স্থানে। ওসমানীর মাতা ও পিতার নাম যথাক্রমে জুবেদা খাতুন ও খান বাহাদুর মফিজুর রহমান।

ওসমানী বালক কালের লেখাপড়া শেষ করে সিলেট গভর্নমেন্ট হাইস্কুল থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে ম্যাট্রিক পাশ করেন। তিনি ১৯৩৪ সালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। দীর্ঘ ৪ বছর এ প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নকালে অসাধারণ মেধাবী ও বহু গুণের অধিকারী ছাত্র ওসমানী অনেক সুখ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৩৮ সালে তিনি ডিগ্রি প্রাপ্ত হয়ে মাস্টার্স প্রাথমিক পর্যায়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি নিজ মেধাবলে ১৯৩৯ সালে ক্যাডেট হিসাবে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। তারপর ১৯৪০ সালে ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমি দেরাদুন থেকে সামরিক শিক্ষা শেষ করে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিতে কমিশন অফিসার হিসেবে নিয়োজিত হন। নিজ কীর্তি ও কার্যকলাপের মাধ্যমে যোগ্যতা প্রদর্শন করে ১৯৪১ সালেই দ্রুত পদোন্নতি লাভ করে ক্যাপ্টেন ও ১৯৪২ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে মেজর পদে উন্নীত হন। এত অল্প বয়সে এ পদের মর্যাদা এর পূর্ব আর কোনো সেনা অফিসারের ভাগ্যে জুটেনি। এটা এক বিরল সম্মান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ওসমানী বিভিন্ন রণাঙ্গনে অত্যন্ত বীরত্ব, ত্যাগ, সাহস ও রণ নৈপুণ্যের পরিচয় দেন। ইতোমধ্যে তিনি ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে আইসিএস ক্যাডারে নিযুক্তি লাভ করেন। কিন্তু জওহরলাল নেহরু কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়েও তিনি কূটনৈতিক পদ গ্রহণের প্রস্তাব বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করেন। ওসমানী সৈনিক জীবনে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে চেয়েছেন সব সময়ই।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর তিনি পাকিস্তানে আগমন করেন এবং পাক সেনাবাহিনীর গঠন কাজে শরীক হন। এ সময় তিনি দক্ষতা, সাহসিকতা ও ধৈর্য্যের সঙ্গে কর্তব্য পালন করে ল্যাফটেনেন্ট কর্নেল পদে উন্নীত হন। তিনি বিভিন্ন বিভাগে সমন্বয়, কার্যনীতি, অধীনস্থ বিভাগের অফিসার আমলাদের নিয়োগ, পরিকল্পনা ইত্যাদি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি পিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। ওসমানী এ সময় হতে বিভিন্ন ব্রিগেডের ট্রেনিং টিমের ভারপ্রাপ্ত অফিসার নিযুক্ত হন এবং বিভিন্ন সেনাদলকে যুদ্ধক্ষেত্রের কৌশল শিক্ষাদানে তৎসংশ্লিষ্ট ব্যবস্থা, যুদ্ধ প্রস্তুতি, পরিচালনা সম্পর্কে উন্নত প্রণালী অবহিত করান।

চট্টগ্রাম সেনানিবাসের প্রতিষ্ঠাতা ওসমানী ১৯৫১-৫৫ এর ভিতর বিভিন্ন সময়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোরসহ এ অঞ্চলের সেনানিবাসসমূহের স্টেশন কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৫ সালের শেষ দিকে তাকে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের ইপিআর বাহিনীর ডেপুটি ডাইরেক্টর জেনারেল পদে নিয়োগ করা হয়। ১৯৫৬ সালের মে মাসে কর্নেল পদে উন্নীত হন এবং দেশ রক্ষা পরিকল্পনা ও সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ের সংযোজন কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এ সময় তিনি সেন্টো ও সিয়াটোর বিভিন্ন বৈঠকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৬১ সালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রধান প্রতিনিধি ও মুখপাত্র মনোনীত হন। ১৯৬৪ সালের সামরিক বিভাগের আধুনিক ব্যবস্থা ও বৈজ্ঞানিক উন্নয়ন মূল্যায়নের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং ক্ষেপনাস্ত্র, গুলন্দাজ, সাজোয়া, পদাতিক বাহিনী ও বিমান বাহিনী কর্তৃপক্ষের অস্ত্রের বিপক্ষে নিরাপত্তা বাহিনী ও পেন্টাগনে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন।

১৯৬৫ সালে ওসমানী পাক-ভারত যুদ্ধে পশ্চিম রণাঙ্গণে ডেপুটি ডাইরেক্টর অব মিলিটারী অপারেশন হিসাবে যুদ্ধ পরিচালনা করে কৃতিত্বের পরিচয় দেন। তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দু’টি ব্যাটেলিয়ানের স্থলে ছ’টি ব্যাটেলিয়ান গঠন করেন। অনেক প্রতিরোধ ও প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েও তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উন্নয়ন ও সেনাবাহিনীতে বাঙালি সৈন্যের কোটা বৃদ্ধির ব্যাপারে সফলকাম হন। শুধু এখানেই শেষ নয়, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মার্চপাস্ট সঙ্গীতে কবি নজরুল ইসলামের জনপ্রিয় সঙ্গীত ‘চল চল, চল’কে সরকারি অনুমোদনের মাধ্যমে চালু করেন।

পাক সেনাবাহিনী হতে অবসর গ্রহণের পূর্বে ওসমানী তৎকালীন সর্বাধিনায়ক জেনারেল ইয়াহিয়ার নিকট পাকিস্তানের বাঙালি সৈন্যদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান কল্পে সুচিন্তিত ও বিস্তারিত সুপারিশমালা প্রদান করেন। এসব সুপারিশের মধ্যে লোকসংখ্যার ভিত্তিতে সেনাবাহিনীতে বাঙালিদের নিয়োগ প্রস্তাবও ছিল, যা পরবর্তী পর্যায়ে অনুমোদন পায়।

কিন্তু পাকিস্তান আর টিকেনি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে পাকিস্তান হতে স্বাধীন করার মানসে সংগ্রাম শুরু হয়। সাধারণ মানুষ, ছাত্র, আনসার, পুলিশ, ইপিআর এবং বাঙালি সেনাসহ সকল বাহিনীর লোক নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ওসমানী অত্যন্ত ধৈর্য্য, দক্ষতা, সতর্কতার সঙ্গে জাতির এ বিপর্যয়ের সময় এক বিরাট বাহিনীর নেতৃত্ব দেন। অসীম সাহস, বীরত্ব ও দক্ষতার জন্য ১৯৭১ সালে ১২ এপ্রিল ওসমানীকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীসহ মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসাবে নিয়োগ করা হয়। জেনারেল ওসমানীর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও রণ-কৌশল অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে দুর্ধর্ষ পাক-বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর।

বঙ্গবীর জেনারেল ওসমানী আজ আমাদের মধ্যে নেই। মৃত্যু সকলের জন্যই অনিবার্য। কাজেই তাঁর বেলায়ও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ১৯৮৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মহান জননেতা সমরনায়ক জেনারেল ওসমানী লন্ডনের সেন্টপল হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ২০ ফেব্রুয়ারি সামরিক মর্যাদায় তারঁ ইচ্ছায় তাঁকে শাহজালালের মাজার প্রাঙ্গনে সমাহিত করা হয়। তিনি এখানেই শায়িত।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন