চট্টগ্রাম-বরিশাল-মোংলা-খুলনা মহাসড়কের বেকুঠিয়াতে কঁচা নদীর ওপর নির্মিত প্রায় দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ ‘বেগম ফলিজলাতুননেসা মুজিব ৮ম চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু’ রোববার সকালে উদ্বোধন হতে চললেও নানমুখি প্রতিবন্ধকতায় এর সুফল পেতে অনির্দিষ্টকাল অপেক্ষা করতে হতে পারে। চীনা ৬৫৫ কোটি টাকার সম্পূর্ণ অনুদান সহ প্রায় হাজার কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মিত এ সেতুটির নির্মান কাজ ২০১৮ সলের শেষভাগে শুরু হয়ে গত ৩০ জুন শেষ হয়েছে। গত ৭ আগষ্ট চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রী ওয়াং ই’র উপস্থিতিতে ৮ম চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতুটি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোববার সকালে সেতুটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের পরে তা যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে।
চীনা প্রেসিডেন্ট-এর বাংলাদেশ সফরকালে ২০১৬ সালের ১ নভেম্বর ৮ম চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু নির্মানে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এর দু বছর পরে ২০১৮ সালের ১ অক্টোবর ‘প্রী-স্ট্রেসড কংক্রীট বক্স গার্ডার’ ধরনের এ সেতুটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
কিন্তু এ দীর্ঘ সময়েও বরিশাল থেকে ঝালকাঠী-পিরোজপুর হয়ে খুলনা সড়কটি জাতীয় মহাসড়কে উন্নীত হয়নি। অথচ চট্টগ্রাম থেকে লক্ষ্মীপুর-ভোলা হয়ে বরিশাল পর্যন্ত এবং ঢাকা থেকে ফরিদপুর হয়ে বরিশাল-পটুয়াখালীÑকুয়াকাটা মহাসড়কটিও আনেক আগে জাতীয় মহাসড়কে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু বরিশাল-ঝালকাঠী-পিরেজপুর-খুলনা সড়কটি মহাসড়কে উন্নীত করণের লক্ষ্যে সড়ক পরিবহন ও সেতু মনত্রনালয়ের একটি প্রস্তাবনা পরিকল্পনা কমিশনে ঝুলে আছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সড়ক অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল সূত্রের মতে এ সড়কটি জাতীয় মহাসড়কে উন্নীত হলে বিদ্যমান সমস্যাগুলোর বেশীরভাগের সমাধানই সহজতর হত।
বরিশাল-ঝালকাঠী-পিরোজপুর সড়কের ‘বাসন্ডা বেলী ব্রীজ’ পূণর্বাশন বা পূণঃনির্মান সহ ঐ সড়কেরই রাজাপুর-পিরোজপুর অংশের উন্নয়ন এবং মাত্র সাড়ে ৪ কিলোমিটার ‘পিরোজপুর বাইপাস’ নির্মানের ওপরই ‘৮ম চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু’র সুফল নির্ভরশীল। এমনকি এ সেতু পারপারকারী বিপুল সংখ্যক যানবাহনের চাপে পিরোজপুর শহরের বেশীরভাগ এলাকা চরম অচলবস্থার মুখে পড়তে যাচ্ছে বলেও মনে করছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞগন। অথচ দেশের ৩টি উপক’লীয় বিভাগ সহ সবগুলো সমুদ্র বন্দরের পাশাপাশি দুটি প্রধান স্থল বন্দরের সাথে সড়ক যোগাযোগ সহজতর করতেই সেতুটি নির্মানের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এসব গুরুত্ব বিবেচনায়ই চীন সরকার মূল সেতুটি নির্মানে সমুদয় অর্থ অনুদান হিসেব প্রদান করে।
এমনকি বিদ্যমান সমস্যাসমুহের দ্রুত সমাধান না হলে ‘৮ম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু কতটা কার্যকরি ভুমিকা রাখবে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে সড়ক বিশেষজ্ঞদের মধ্যে। সেতুটির মূল ডিপিপি’তে ‘পিরোজপুর বাইপাস’ নির্মানের বিষয়টি অন্তভর্’ক্তির লক্ষ্যে শুরুতেই বিভিন্ন মহল দাবী জানালেও তা আমলে নেয়নি সড়ক অধিদপ্তর সহ মন্ত্রনালয়। তবে গত ৬ বছরে এ লক্ষে একটি সমিক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। যেখানে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান পিরাজপুর বাইপাস নির্মান অত্যাবশ্যক বলে দুটি এলইমেন্টও নির্ধারন করে। কিন্তু সে আলোকেও পরবর্তি কোন পদক্ষেপ নেই। অথচ সেতুটির পশ্চিম প্রান্তে নির্মিত সংযোগ সড়কটি পিরোজপুর শহরের বাইরে বলেশ^র সেতুর সংযোগ সড়কে সংযুক্ত করলেই এ সমস্যার সমাধান মিলবে বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সড়ক অধিদপ্তরের একাধীক দায়িত্বশীল সূত্র।
এমনকি রাজাপুর থেকে পিরোজপুর পর্যন্ত সড়কটির বেশীরভাগই এখনো মাত্র ১৮ ফুট প্রস্থ। অথচ এ সড়কের ওপরই চট্টগ্রাম-বরিশাল ও খুলনা বিভাগ সহ দেশের ৩টি সমুদ্র বন্দরের সড়ক যোগাযোগ নির্ভরশীল।
অপরদিকে বরিশাল ও পিরোজপরের মধ্যবর্তি ঝালকাঠীর বাসন্ডা নদীর ওপর প্রায় ৩০ বছরের পুরেনো বেলী সেতুটি ইতোমধ্যে যানবাহন চলাচলের প্রায় অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। গত কয়েক বছরে বার বার মেরামত করতে গিয়ে কয়েক কোটি টাকা ব্যায় হলেও এখন জোড়াতালি দিয়েও সেতুটি সচল রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি বরিশাল জোনের বিভিন্ন সড়ক বিভাগ থেকে বেলী সরঞ্জাম সংগ্রহ করে সেতুটি মেরামত করা হলেও তা খুব টেকসই হচ্ছে না। ফলে এ সেতুটি সচল রাখার নিশ্চয়তার কথা বলতে পারছেন না সড়ক অধিদপ্তরের কেউ।
তবে বরিশাল সড়ক সার্কেলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ও তত্ববধায়ক প্রকৌশলী জানিয়েছেন, প্রায় ৪শ ফুট দীর্ঘ ‘বাসন্ডা সেতুর বিদ্যমান কাঠামোর ওপর ‘প্রী-স্ট্রেসড কংক্রিট গার্ডার’ পদ্ধতির সেতু নির্মান সম্ভব কিনা সে বিষয়ে ডিজাইন সার্কেলে তথ্য উপাত্ত পাঠান হয়েছে। সেখানের সিদ্ধান্তের ওপরই পারবর্তি পদক্ষেপ গ্রহন করা হতে পারে। তবে এ সেতুটি এখনো কোন প্রকল্পে অন্তর্ভূক্ত না হলেও নতুন একটি প্রকল্পে অন্তভর্’ক্তির সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন নির্বাহী প্রকৌশলী। বিদ্যমান কাঠামোর ওপরে শুধু অরসিসি ডেকস্লাব নির্মানের মাধ্যমে সেতুটি পূণর্বাশন করা হলে কাজ শুরুর এক বছরের মধ্যেই তা সম্পন্ন হবে । তবে সে ক্ষেত্রে বিদ্যমান সেতুটির পাশে ফেরি সার্ভিস চালু বা আরেকটি বেলি সেতু নির্মান করে সড়ক যোগাযোগ অব্যাহত রাখতে হবে।
কিন্তু ৪ শতাধীক ফুট দৈর্ঘের ‘প্রী-স্ট্রেসড কংক্রিট গার্ডার’ টাইপের নতুন সেতু নির্মানে নুন্যতম ৩শ কোটি টাকা ব্যায় হবে। সে ক্ষেত্রে নতুন ডিজাইন ও ডিপিপি প্রস্তুত করে তা অনুমোদন, দরপত্র আহবান সহ কাজ শেষ করতে ৫ বছর অপেক্ষা করতে হতে পারে বলেও মনে করছেন সড়ক অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল মহল। একইভাবে রাজাপুর থেকে বেকুঠিয়ায় মৈত্রী সেতু পর্যন্ত ১২ কিলোমিটারে দীর্ঘ দিনের পুরনো ছোট ও মাঝারী আরো ৫টি বেলী সেতু এ সড়কে প্রায়শই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। তবে ইতোমধ্যে পিরোজপুর সড়ক বিভাগের অধীন ২টি সেতু আরসিসি’তে পরিবর্তনের কাজ শুরু হয়েছে। অপরকটিও দরপত্র আহবান করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন নির্বাহী প্রকৌশলী। তবে ঐ ১২ কিলোমিটার সহ বলেশ^র সেতু পর্যন্ত সড়কটি এখনো জেলা সংযোগ সড়কের মর্যাদায় থাকায় তেমন কোন উন্নয়ন হচ্ছে না। প্রসস্ত মাত্র ১৮ ফুট। রাজাপুর থেকে বরিশাল পর্যন্ত ৩১ কিলোমিটার সড়কও আঞ্চলিক মহাসড়ক।
তবে বরিশাল-মোংলা-খুলনা মহাসড়কটি কবে জাতীয় মহাসড়কে উন্নীত হবে এবং বাসন্ডা সেতুর পূণর্বাশন বা পূণঃ নির্মান সহ পিরোজপুর বাইপাস নির্মানের পরে ‘৮ম চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতুটির প্রকৃত সুফল মিলবে তা বলতে পারছেন না সড়ক অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল কেউ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন