সম্প্রতি ইডেন মহিলা কলেজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের কতিপয় পদধারী নেতার বিরুদ্ধে সাধারণশিক্ষার্থী নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। এদের মধ্যে ইডেন মহিলা কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভার বিরুদ্ধে দফায় দফায় ছাত্রী নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। অন্যদিকে নির্যাতনের শিকার ছাত্রীদের পাশে না দাঁড়িয়ে উল্টো তাদের গভীর রাতে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ায় কলেজ প্রশাসন চরমভাবে বিতর্কিত হয়েছে। নির্যাতনে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো এই নির্যাতনের তথ্য গণমাধ্যমে যাওয়ায় কর্তৃপক্ষ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে কারণ দর্শানোর (শোকজ) নোটিশ দিয়েছে, যা প্রকারান্তরে নির্যাতকারীদের প্রশ্রয় দেবার শামিল। ছাত্রলীগ সভাপতি রিভার নেতৃত্বে নিপীড়নমূলক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি কলেজ প্রশাসনের ভূমিকা শিক্ষার্থীসহ দেশবাসীকে হতভম্ব করেছে। এসব দেখে মনে হয়, ইডেন কলেজে বা কলেজের হোস্টেলে কোনো প্রশাসন নেই, ইডেন কলেজ যেন রিভারাই চালাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলে কলেজ অধ্যক্ষ নির্যাতনের অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি করেন, যা শুধু দুঃখজনকই নয়, অবিশ্বাস্যও বটে। প্রকৃতপক্ষে সাম্প্রতিক কিছু কর্মকাণ্ডের জন্য আলোচনায় রয়েছে ইডেন কলেজের সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের কিছু নেতাকর্মী। বিশেষ করে, শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনায় কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভা আছেন আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। গত ১৯ আগস্ট রিভা দলীয় কর্মসূচিতে না যাওয়ায় শিক্ষার্থীদের আবাসিক হলের কক্ষ থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেয়। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও হুমকি দেওয়ার একটি অডিও ফাঁস হলে তা নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রচার হয়। এ ঘটনার দায় স্বীকার করে ক্ষমা চায় রিভা। অভিযোগ ওঠে, সেই অডিও ফাঁস হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে রিভা গত ২৩ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে রাজিয়া হলের ২০২ নাম্বার কক্ষ থেকে বঙ্গমাতা হলের ১১০৭ নাম্বার রুমে নিয়ে যান দুই ছাত্রীকে। বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত সেখানে দু’জনকে আটকে রেখে নির্যাতন করার অভিযোগ উত্থাপিত হয় রিভার বিরুদ্ধে। সেখানে রিভা দুই ছাত্রীকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ভাইরাল করে দেওয়ার হুমকি দেয়। খবর পেয়ে ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ ও রাজিয়া হলের প্রাধ্যক্ষ গিয়ে নির্যাতিত দু’ ছাত্রীকে উদ্ধার করে প্রথমে হল অফিসে নিয়ে আসেন, পরে ছাত্রী দু’জনকে গভীর রাতেই গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। অথচ, অভিযুক্ত রিভার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি কলেজ প্রশাসনকে। উল্টো ভুক্তভোগীদের জিজ্ঞাসাবাদের সময়ের ভিডিও ধারণ করে গণমাধ্যমে দেওয়ার অভিযোগে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে কারণ দর্শানোর (শোকজ) নোটিশ দেন রাজিয়া হল প্রাধ্যক্ষ। নোটিশে বলা হয়, ‘গত মঙ্গলবার আনুমানিক সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় হোস্টেলের তত্ত্বাবধায়কের কক্ষে তুমি আকস্মিক প্রবেশ এবং অফিসিয়াল কথাবার্তা রেকর্ড করে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচার করেছো, যেটা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের লঙ্ঘন। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে তোমার বিরুদ্ধে কেন আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না এ ব্যাপারে নোটিশ প্রাপ্তির পর ২৫ আগস্ট, দুপুর ১২টার মধ্যে হোস্টেল কর্তৃপক্ষের নিকট লিখিতভাবে উত্তর দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো।’ এতে করে এটা সহজেই প্রতিয়মান হয় যে, হল প্রশাসন নির্যাতিতার পক্ষে নয়, রিভার পক্ষাবলম্বন করেছে, যা কোনভাবেই একজন শিক্ষকের কাছে প্রত্যাশিত নয়। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যানুসারে জানা যায়, রিভায় তটস্থ ইডেন কলেজ।
সভাপতি হওয়ার পর থেকে রিভা শিক্ষার্থীদের জোর করে দলীয় মিছিল-মিটিংয়ে নিয়ে যায়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের অভিযোগ থেকে জানা যায়, এভাবে মানসিক নির্যাতনেরই ধারাবাহিকতা ১৯ ও ২৩ আগস্টের ঘটনা। এ দুটি ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার কল্যাণেই রিভার বিষয়টি সবার নজরে এসেছে, যদিও এসব কর্মকাণ্ড চলছিল আগে থেকে। এদিকে দুই দফায় ছাত্রী নির্যাতনের পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনেও নামতে না দেওয়ার পেছনে রিভার ভূমিকায় ক্ষুব্ধ সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের অন্য একটি অংশ। অভিযোগ রয়েছে, অতীতে অনেক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে রিভা এমন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ১৯ ও ২৩ আগস্টের ঘটনা দুটির পর রিভার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা, তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পর্যন্ত দেয়নি হল প্রশাসন। তাহলে হল প্রশাসন কি ব্যর্থ? নাকি অসহায়?
এদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের কতিপয় পদধারী নেতাদের নির্যাতন যেন থামছেই না। অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী শামসুল ইসলামকে মারধরের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই আলামিন নামের আরেক শিক্ষার্থী নির্যাতনের অভিযোগ তুলেছে। ওই শিক্ষার্থী প্রাণনাশের ভয়ে পরীক্ষা শেষ না করেই বাড়ি চলে গেছে। সেখান থেকে কুরিয়ারে লিখিত অভিযোগ করেছে হিসাব বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের ওই শিক্ষার্থী। এদিকে ছাত্রলীগের মারধরের ঘটনায় অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র শামসুলের বাম কানের পর্দা ফেটে গেছে। ওদিকে নিজের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে নির্যাতিত শিক্ষার্থী তার প্রদত্ত অভিযোগপত্রটি উঠিয়ে নেবে বলে জানিয়েছে।
কুরিয়ারে পাঠানো অভিযোগ পত্রে আলামিন বলে, ১৭ আগস্ট পরীক্ষা শেষে বিশ্ববিদ্যালয় সরকার দলীয় ছাত্রসংগঠনের দুজন পদধারী রবীন্দ্র ভবন থেকে বঙ্গবন্ধু হলে ডেকে নিয়ে নির্যাতন করে। একপর্য়ায়ে নির্যাতনের ফলে আলাআমিন অবচেতন হয়ে পড়লে তার ডেবিট কার্ড দিয়ে ব্যাংক থেকে ৪৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। কী বিভৎস ও মানবতা বিবর্জিত কাণ্ড! বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নামধারীদের দ্বারা ছাত্র নাজেহাল হবে, নির্যাতিত হবে তা কি ভাবা যায়? অথচ, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসন আছে, প্রক্টর আছে, ছাত্র উপদেষ্টা আছে, প্রতিটি আবাসিক হলে প্রভোস্টের নেতৃত্বে বৈধ শিক্ষার্থীদের ভালো-মন্দ দেখভাল করার জন্য আলাদা প্রশাসন আছেন। তারপরও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হলসমূহে সিট বাণিজ্য, বৈধ ছাত্রদের হল থেকে বের করে দেয়া, বৈধ আবাসিক ছাত্রের আসবাবপত্র ও বইপত্র পুড়িয়ে দেবার ঘটনা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হবার কারণে তাদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থাও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো।
ঢাবিতে ছাত্রদের প্রতিটি হলে ছায়া প্রশাসন তৈরি করেছে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। ছাত্রদের ১৩টি হলের বেশিরভাগ পক্ষের নিয়ন্ত্রণ সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের হাতে। তাদের নিজস্ব নিয়মকানুন আছে, বিচারের ব্যবস্থা আছে (দৈনিক প্রথম আলো ২৮.৮.২২)। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, হলে কোনো প্রশাসন নেই বা থাকলেও কিছু করার ক্ষমতা নেই। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রও প্রায় একই রকম। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলসমূহের সিট নিয়ন্ত্রণ করে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের ৬ নেতা। কারা হলে উঠবে তা ঠিক করে দেয় তারাই। হলে ওঠার শর্ত একটাই, যারা হলে উঠতে চায় তাদের সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের রাজনীতিতে যুক্ত হতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, বিগত ৫ বছর যাবত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো হলে হল প্রশাসনের পক্ষ থেকে সিট বরাদ্দ দেয়া হয় না। নেতারাই ঠিক করে দেয় কারা উঠবে আর কারা উঠবে না।
অথচ, প্রতিটি হলে প্রভোস্ট আছেন, হাউজ টিউটর আছেন। তাহলে তাঁদের কাজটা কী? কী করেন তাঁরা? শুধুই কি মাস গেলে সামান্য কিছু ভাতার জন্য পদটি দখল করে আছেন? মেধার ভিত্তিতে প্রতিবছর হলে সিট বরাদ্দের দায়িত্ব হল প্রশাসনের ওপর ন্যাস্ত থাকলেও প্রশাসন সে দায়িত্ব পালন না করে ছাত্রদের হাতে এই নিয়ন্ত্রণ তুলে দিয়ে গোটা শিক্ষক সমাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
মূলত বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজসমূহের আবাসিক হলসমূহ নির্মাণ করা হয়েছে জনগণের ট্যাক্সের টাকায়, প্রতিষ্ঠানের মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিরাপদ আবাসনের জন্য। কিন্তু অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো সহাবস্থান নেই। হলে হলে সরকারি ছাত্র সংগঠনের অনৈতিক সিট বাণিজ্য ও বৈধ আবাসিক ছাত্রকে বহিষ্কারের ঘটনায় সচেতন অভিভাবকরা শঙ্কিত, সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। প্রশাসন অনেক ক্ষেত্রে দেখেও না দেখার ভান করে। শুনেও না শোনার অভিনয় করে। নামকাওয়াস্তে তদন্ত কমিটি গঠন করে ঘটনাকে ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানগণ বিশেষ করে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ভাইস চ্যান্সেলরগণ অতি মাত্রায় সরকারের লেজুড়বৃত্তি করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যায়গুলোকে মুক্ত জ্ঞানচর্চারকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছেন। নিজেরা তাঁদের কর্মকাণ্ডের জন্য ছাত্র শিক্ষক অভিভাবক কর্তৃক সমালোচিত হচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের চোখে অশ্রদ্ধার পাত্র হচ্ছেন। সার্বিকভাবে সমাজে বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে, যা মানসম্মত শিক্ষাঙ্গন তৈরির জন্য মোটেই সহায়ক নয়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। দলীয় বিবেচনায় নয়, বরং প্রতিটি শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। ক্যাম্পাসে সহাবস্থান নিশ্চিতকরণে জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
লেখক: প্রফেসর, আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
drhasnat77@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন